১৪৫৩ সালের ২৯ মে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ সেই সময়কার অন্যতম শক্তিশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করে কনস্ট্যান্টিনোপলের যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, তা গোটা মানবজাতির ইতিহাসেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মাত্র ২১ বছর বয়সে সদ্য কৈশোর পেরোনো মুহাম্মাদ পূর্ণ করেন হযরত মুহাম্মদ (স) এর ভবিষ্যৎবাণী।
নিশ্চিতরূপে তোমরা (মুসলিমরা) কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করবে। কতই না উত্তম হবে সেই শাসক! কতই না উত্তম হবে সেই সেনাবাহিনী!
ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে তুর্কি সুলতানরাও কনস্টান্টিনোপল জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের চেষ্টা চালান সুলতানের পিতা দ্বিতীয় মুরাদ এবং পিতামহ বায়েজিদও। তারও আগে তেইশবার চেষ্টা করে উসমানীয়রা। কিন্তু কোনোবারই চূড়ান্ত সফলতা এসে ধরা দেয়নি।
মাত্র ২১ বছর বয়সে বিজয়ীর বেশে কনস্টান্টিনোপল শহরে প্রবেশ করেন তুর্কি এই সুলতান। আয়া সোফিয়াতে জুমার খুতবা দিয়ে এক নতুন দিনের বার্তা দেন বিশ্ববাসীকে। নামের সাথে যুক্ত হলো ‘ফাতিহ’ বা ‘বিজয়ী’। পূর্বপুরুষরা যা পারেনি, অদম্য মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে তা করে দেখালেন তিনি। কিন্তু এই অসাধ্য কীভাবে সাধন হলো? এই বিষয়ে জানতে হলে পড়তে হবে এই বইটি, বুঝতে হবে কীভাবে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। বইটিতে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহর শৈশব থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা উঠে এসেছে।
খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে পরিকল্পনা সাজিয়ে বিজয়ের নিশান ছিনিয়ে আনতে হয়, কনস্ট্যান্টিনোপল শহরের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে ইস্তানবুল বিজয়ের গৌরবগাঁথা অধ্যায়ের প্রতিটি ধাপ বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে।
সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৪৫১ সালে সিংহাসনে বসেন। এর পূর্বেও তিনি একবার সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ হলে পুনরায় সালতানাতের হাল ধরেন পিতা দ্বিতীয় মুরাদ। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতারোহণ করেই তেজী, আত্মবিশ্বাসী এবং চৌকস সুলতান মুহাম্মাদ পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন কীভাবে ইস্তানবুল বিজয় করা যায়!
তরুণ মুহাম্মাদের মতিগতি বুঝতে পেরে সম্রাট কনস্ট্যানটাইনও প্রস্তুতি শুরু করলেন। সাম্রাজ্য রক্ষায় সারা ইউরোপের কাছে সাহায্য চাইলেন। সাহায্য চাইলেন পোপের কাছেও। অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত ইউরোপ তার ডাকে আশানুরূপ সাড়া দেয়নি।
দীর্ঘ দুই বছরের প্রস্তুতি শেষে ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ করে উসমানীয়রা। তাদের ছিল প্রশিক্ষিত সৈন্য, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তৎকালীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব্যাসিলিকা কামান। তবুও তুর্কিরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অপরাজেয় থিউডিয়াস দেয়ালের কোনো ক্ষতি করতে পারছিল না। উসমানীয় জাহাজগুলোও কোনোভাবে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করতে পারছিল না। কারণ সমুদ্রের তলদেশে বাইজেন্টাইনরা শিকল ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আর বিশাল এই তুর্কি নৌবহর গোল্ডেন হর্নের প্রবেশ করতে না পারলে চূড়ান্ত আক্রমণ করাও সম্ভব না।
সুলতান এবার ব্যতিক্রমী এক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন পরিকল্পনা বোধহয় ইতিপূর্বে কেউ করেনি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- জাহাজগুলোকে পাহাড়ের উপর দিয়ে টেনে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করানো হবে! সুলতানের আকাশ-কুসুম চিন্তাকে অনেকেই পাত্তা দিল না। কিন্তু সুলতান তার সিদ্ধান্তে অনড়। একরাতে ৭০টি জাহাজ টেনে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করানো হলো! এ দৃশ্য দেখে পরদিন সকালে বাইজেন্টাইনদের চক্ষু চড়কগাছ।
এরপরও সফলতা পাচ্ছিল না তুর্কিরা। এবার তারা মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশের চিন্তা করেও ব্যর্থ হলো। দীর্ঘ সময় অবরোধ, খাদ্যের সংকট, বার বার ব্যর্থতায় দুর্বল হয়ে পড়ল উসমানীয় বাহিনী। কিন্তু মনোবল হারালো না। সুলতান মুহাম্মাদ চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে দূত পাঠিয়ে সম্রাট কনস্ট্যানটাইনকে আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানান। কিন্তু কনস্টানটাইন তার সাম্রাজ্য রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
২৯ মে মধ্যরাতের পর থেকে চূড়ান্ত আঘাত হানে উসমানীয়রা। নৌ বাহিনী ও স্থল বাহিনীর যৌথ আক্রমণে পর্দুযস্ত হয়ে পড়ে বাইজেন্টাইনরা। ক্ষিপ্র আক্রমণের মুখে একপর্যায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং শহর উসমানীয় সৈন্যদের অধিকারে চলে আসে।
বইটির মূল পাঠ্য বিষয় সুলতান মুহাম্মাদ সম্পর্কিত হলেও এখানে বর্ণিত হয়েছে বিস্তারিত ইতিহাস। উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে সুলতান মুহাম্মাদ পর্যন্ত প্রত্যেক শাসকের সমকালীন ইতিহাস ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কীভাবে এক যাযাবর গোষ্ঠী উসমান বে-র নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করল এবং পরবর্তী শাসকরা বিস্তৃত এশিয়া-ইউরোপের বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি হলেন, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বইটির প্রথমাংশে উঠে এসেছে।
কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় ছাড়াও সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহর অন্যান্য অবদান এবং সমগ্র জীবনের বিভিন্ন অভিযান, শাসননীতি ও রাষ্ট্রনীতি বর্ণনা করা হয়েছে বইয়ে। নিঃসন্দেহে এটি একটি সুখপাঠ্য বই। সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তার বর্ণাঢ্য জীবনীর প্রতিটি ঘটনা জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়।
চমৎকার এই সুখপাঠ্য বইয়ে পাঠক হিসেবে কিছু অপূর্ণতা অনুভূত হয়েছে। প্রথমত, বইটির বাক্যগঠনে বেশ কিছু অপ্রচলিত এবং অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই পড়ার গতি শ্লথ করে দেয়। তাছাড়া খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের অন্তর্কোন্দল এবং বাইজেন্টাইনদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে, যা ক্ষেত্রবিশেষে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির কারণও হতে পারে। তবে বইয়ে ঐতিহাসিক বর্ণনার ধারাবাহিকতা খুব সুন্দরভাবে রক্ষা করা হয়েছে, যা ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়।
বইটির লেখক সম্পর্কে দু-কথা না বললেই নয়। ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হকের জন্ম কক্সবাজারে, ১৯৭৬ সালে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ২০০৩ সালে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ড. যুবাইর ধর্ম, ভাষা, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে লেখালেখি করেন। দেশি-বিদেশি জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটি। ‘সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ’ লেখার পূর্বে তিনি আরও পাঁচটি গ্রন্থ নিয়ে কাজ করেছেন।
সামগ্রিকভাবে উসমানীয় সালতানাতকে জানতে এবং সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহর বীরত্বপূর্ণ অবদানগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে এ বইটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য একটি বই। তথ্যভিত্তিক ও চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি সম্পন্ন এই বইটি পাঠককে নিয়ে যাবে উসমানীয়দের দুনিয়ায়!
…
বইটি সংগ্রহ করতে
বই: সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ
লেখক: ড. যুবাইর মুহাম্মাদ এহসানুল হক
প্রকশনা সংস্থা: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
প্রথম প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৯২ পৃষ্ঠা
নির্ধারিত মূল্য: ২০০ টাকা