বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে একজন সত্যজিৎ রায়। বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে তিনিই নিয়ে গিয়েছেন। ‘পথের পাঁচালি’ থেকে শুরু করে ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত একে একে নির্মাণ করেছেন ৩৭টি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের গল্পগুলো সরল হলেও প্রতিটি চলচ্চিত্রে জীবনের গভীর বোধ আর সামাজিক বাস্তবতা যথাযথভাবে পরিস্ফুটিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। যতটা সহজে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র দেখে ফেলা যায়, ততটা সহজে তাঁর চলচ্চিত্রের আবহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই দর্শকের মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করে, মোহাবিষ্ট করে ধরে রেখে সমাজ এবং চারপাশকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ করে দেয়। তাই সময়ের সাথে তাঁর চলচ্চিত্রের আবেদন হারিয়ে যায়নি, বরং আরও বেড়েছে। সময়কে অতিক্রম করে একেকটি কালজয়ী চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের এক অনন্য সৃষ্টি ‘মহানগর।’ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার ১৯৬৩ সালে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলতে গিয়ে এ সমাজের রূঢ় বাস্তবতাগুলোকে অত্যন্ত নিপুণ আঁচড়ে তিনি এ চলচ্চিত্রে পরিস্ফুটিত করেছেন। নগরায়নের ফলে ষাটের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সৃষ্ট নানা জটিলতা এবং তাদের মানসিক জগতের পরিবর্তন সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’ এ রূপায়িত করেছেন। বাঙালি গৃহবধূর চাকরিজীবী হয়ে ওঠার সামাজিকভাবে সংকটপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি অসামান্য দক্ষতার সাথে চিত্রিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে।
এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প এটি। বৃদ্ধ পিতা-মাতা পুত্র সুব্রতের (অনিল চট্টোপাধ্যায়) সংসারে থাকেন। সুব্রতের স্ত্রী আরতি (মাধবী মুখোপাধ্যায়) এই চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি তাদের পুত্রসন্তান এবং সুব্রতের ছোট বোন বাণীও (জয়া ভাদুড়ি) এ পরিবারের অংশ। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অসচ্ছলতা দূর করতে এবং স্বামীর উপর চাপ কমানোর জন্য চাকরির সন্ধান শুরু করে আরতি। খুব দ্রূতই একটি নিটিং মেশিনের কোম্পানিতে সে সেলস গার্লের চাকরি পায়। দ্রূততম সময়ে সে এ চাকরিতেই সে আপন যোগ্যতায় ভাল করতে শুরু করে এবং চাকরির মাধ্যমে অর্জিত অর্থনৈতিক ও মানসিক স্বাধীনতাকে সে উপভোগ করতে শুরু করে। একসময় তার স্বামীর চাকরি চলে যায়। তখন সে-ই সংসারের হাল ধরে। তার এই স্বাধীনতা এবং স্বামীর বেকারত্ব থেকে সংসারে নানা সংকট তৈরি হয়। সাংসারিক জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তেও সে তার নীতিগত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সহকর্মী এডিথকে তার বস অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করলে সে প্রতিবাদ জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সাংসারিক দূরবস্থা সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না।
এ চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রকে পরিচালক অত্যন্ত যত্নের সাথে নির্মাণ করেছেন। জয়া ভাদুড়ি (বর্তমানে জয়া বচ্চন) প্রথম এই ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আসেন। নগর জীবনের টুকরো বিষয়গুলোর রূপায়ন, পোষাক পরিকল্পনা, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, চিত্রগ্রহণ- সবকিছুতেই এ চলচ্চিত্রে একটি আলাদা স্বাতন্ত্র্যের ছাপ বিদ্যমান। শ্বশুর-শাশুড়ী অথবা ননদের সাথে আরতির সম্পর্ক, তাদের প্রতি তার ভালবাসা দর্শকের মধ্যে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে একটি ইতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেবে। স্বামী সুব্রত ও আরতির প্রেম-ভালবাসা, একজন আরেকজনকে বোঝার প্রচেষ্টা, নানা সংকটে আক্রান্ত হয়ে তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি অথবা মায়ের চাকরি করতে যাওয়ায় পুত্রের অভিমান, তার খেলনার প্রতি আগ্রহ- প্রতিটি সূক্ষ্ম ঘটনার দৃশ্যায়নের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকারের গভীর জীবন দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আরতির বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক শ্বশুরের তার ছাত্রদের প্রতি স্নেহ থেকে জন্ম নেওয়া প্রত্যাশা এবং ছাত্রদের বৃদ্ধ শিক্ষকের প্রতি অবহেলার অংশটুকু জীবনের জটিলতাকে দেখানোর পাশাপাশি করুণরসে দর্শক হৃদয়কে সিক্ত করবে।
এই চলচ্চিত্রটির যে জিনিসটি মস্তিষ্কে সবচেয়ে বেশি অনুরণন সৃষ্টি করে তা হলো কালকে উত্তীর্ণ করে বর্তমান সময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা। ১৯৬৩ সালে এটি নির্মিত হয়েছে। কতগুলো বছর এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে। তবু এত বছর পরে এসেও চলচ্চিত্রটি দেখতে গেলে মনে হয়, এ তো বর্তমান সময়ের গল্প। সাধারণ গল্প হলেও এর উপাদান দর্শককে এখনো ভাবায়, চারপাশের জগতকে অন্য দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ করে দেয়।
‘মহানগর’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আরতির স্বামী ব্যাংকের কর্মচারী সুব্রত হঠাৎ একদিন সকালে আবিষ্কার করলো, তার ব্যাংকটি সর্বস্বান্ত হয়েছে। দিনের পর দিন ব্যাংকের টেবিলে বসে কাজ করেও সে বাইরে থেকে ব্যাংকটির অন্তঃসারশূন্যতা ধরতে পারেনি। সামান্য মাইনের কর্মচারী হিসেবে সে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছে, অথচ মালিকপক্ষ যে ক্রমশ ভেতর থেকে ব্যাংকটিকে শূন্য করে ফেলছে, তা সে অনুভবও করতে পারেনি। চলচ্চিত্রে এ দৃশ্য দেখতে গিয়ে বর্তমান সময়ে উচ্চবিত্তদের ঋণখেলাপি প্রবণতা দর্শকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে তার প্রভাব যেভাবে কর্মকর্তা এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সঞ্চয়কারীদের উপরে পড়ে, তা যথাযথভাবে এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আবার আরতি যখন ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়, তখন সুব্রতর সন্দেহপ্রবণতায় আরতির উক্তি “শোন, আর যাই করো, আমাকে ভুল বুঝো না” – দর্শককে ভাবিয়ে তোলে। বর্তমান সময়েও সংসারজীবনের পাশাপাশি নারীদের জন্য চাকরি করা যে কতটা চ্যালেঞ্জিং এবং রক্ষণশীল সমাজ নারীর চাকরী করাকে এখনো যে দৃষ্টিতে দেখে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে তার একই রকম প্রতিফলন দেখে দর্শকের মনে হবে, সমাজ বদলায়নি। এর মূল কাঠামো, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন ছিল, তেমনি আছে। সময়ের পরিবর্তনে বাইরে থেকে সবকিছুর যে পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়, তা কেবল বাইরেরই, এর ভেতরের সংস্কার এখনো সম্ভব হয়নি।
চলচ্চিত্রটির একেবারে শেষ অংশটি প্রতিটি দর্শককের চিন্তাজগতে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। আরতির সহকর্মী এডিথকে যখন তার বস অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করে, তখন আরতি এডিথের পক্ষ নিয়ে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক তীব্র চাপের মাঝেও নিজের সততা ও আত্মমর্যাদার শক্তিতে সে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বসের সামনে পদত্যাগপত্রটি দিয়ে কোনো রকমে বিল্ডিংয়ের নিচে পৌঁছালেই স্বামী সুব্রতর সাথে তাঁর দেখা হয়ে যায়। স্বামীর চাকরি নেই, এ অবস্থায় সে নিজেও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। অসহায় পরিবারটির ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কাছে মনে হয় সে ভুল করেছে। কিন্তু তার স্বামী তাকে সাহস দেয়। সুব্রত বলে ওঠে,
তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছ, সেটা কি ভুল?
তুমি যা করেছ, আমি তা করতে পারতাম না। আমার সাহসে কুলোত না।
রোজগারের তাগিদে আমরা ভীতু হয়ে গেছি, আরতি। কিন্তু তুমি তো হওনি। এটা কি কম হলো?
সময় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদের মাঝে এক দেয়ালের সৃষ্টি করেছিল, এমন এক সংকটের মাঝে নিমজ্জিত হয়ে মুহূর্তেই সেই দেয়াল ভেঙে পড়ল। দুজন একসাথে হয়ে তারা নতুন করে এক আলাদা শক্তি অনুভব করল। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েও তারা ভেঙে পড়ল না। ফলে আরতি যখন সুব্রতকে জিজ্ঞেস করল, “এত বড় শহর, এত রকম চাকরি। দুজনের একজনও কি পাব না একটা?”
সুব্রত উত্তর দিল, “চেষ্টা তো করি। আমার বিশ্বাস দুজনই পাব।” শুধু চরিত্র দুটোর মধ্যে নয়, দর্শকদের হৃদয়েও গভীর আশাবাদের সৃষ্টি করে এ চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটেছে।
বর্তমান সময়ে এসে সুব্রতর উক্তি, “রোজগারের তাগিদে আমরা ভীতু হয়ে গেছি” আমাদেরকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তোলে। এক কঠিন সময়ে আমরা এখন বাস করছি, যেখানে রোজগারের তাগিদে ভীতু হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অসহায় চাকুরীজীবীরা সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের কথা ভেবে চাকরী যাওয়ার ভয়ে শত অন্যায় নীরবে দিনের পর দিন মেনে নিচ্ছে। অসহায় ছাত্র কোন রকমে টিকে থাকার জন্য নিজের আত্মসম্মানবোধকে বলিদান করে শত অন্যায় অনিয়ম মেনে নিচ্ছে। অসহায় সাংবাদিক রাজনীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে নির্মম সত্যগুলোকে হজম করে ফেলে অসত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
রোজগার অথবা জীবনের তাগিদে ভীতু এই গোষ্ঠীর কাছে থেকে সত্য অথবা সত্যের প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ ক’জন মানুষকে আমরা পাব?
তবু এদের মাঝ থেকেই যে রোজগার, স্বার্থপরতা এবং সুবিধাবাদের শৃঙ্খল ভেঙে একদল মানুষ আপন সত্যে বলীয়ান হয়ে সকল বাধা তুচ্ছ করে মহানগরের পথে নেমে আসবে, তার যথার্থ দৃশ্যায়নের মাধ্যমে পরিচালক আমাদের মাঝে গভীর আশাবাদ সৃষ্টি করেছেন।
‘মহানগর’ নগরজীবনের গভীর থেকে উৎসরিত অনন্য এক চলচ্চিত্র। নগরের এই গল্প চিরকালীন, তাই এই চলচ্চিত্রটির আবেদন কখনোই ফুরিয়ে যাবে না।