বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের পছন্দের লেখকের তালিকায় একেবারে প্রথমের দিকেই থাকবেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তুলনামূলক প্রাঞ্জল লেখনী তাকে কমবয়সী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তার লেখা অনেক অনেক বই জুড়ে আছে আমাদের শৈশব। গল্পের সেসব চরিত্রের সাথে কখনো যুদ্ধের মাঠে, কখনো গুপ্তধন কিংবা ডাইনোসরের ফসিল খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে পাঠকের মন। শহর থেকে গ্রামে আসা রাশা, গণিতে তুখোড় তপুর কষ্ট, বৃষ্টির পাগল বাবাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছে। অন্যদিকে রাজু আর আগুনালীর সেই রূপসী ভূতের গল্প, কিংবা টুকি ও ঝায়ের হাসির কাজগুলোও পাঠককে আকর্ষণ করেছে। তার অন্য সব লেখার মাঝে, কিছু বিশেষ বই কখনোই ভোলার নয়। সেগুলোকে নিয়েই থাকছে সামান্য আলোচনা।
টুকুনজিল
রতনপুর গ্রামের স্কুল নীলাঞ্জনা, সেখানেই পড়ে বিলু। ক্লাসে প্রতিবার স্থান করার পাশাপাশি জেলা বৃত্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করে নিলেও কী হবে? তার বাবা একটু পাগল স্বভাবের। সদ্য বাজার থেকে কিনে আনা রুই মাছ হোক কিংবা রাস্তার ধারের গাছ হোক, সবার সাথেই কথা বলতে পারেন তিনি। এসব নিয়ে লোকে হাসাহাসি করে, একটুও ভালো লাগে না বিলুর। এ সময় তাদের বাসায় বেড়াতে আসে বিলুর অবস্থাসম্পন্ন ছোট খালা। তিনি বিলুকে নিয়ে যেতে চান তার সাথে। পাগল বাবাকে অবাক করে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে খালার গাড়িতে বিলু ঢাকা যায়।
এখানে পাঠক হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফটিক’ গল্পের সাথে মিল খুঁজে পেতে পারেন। খালার ছেলেটাও মেনে নিতে পারে না বিলুকে। ফটিক কেন? অনেক কিশোরের জীবনই মিলিয়ে নেওয়া যায় বিলুর সাথে। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা কিংবা হোস্টেলে ওঠার দিনগুলোতে বিলুর মতোই উত্তেজনা কাজ করে। পাশাপাশি একাকীত্বটাও চলে আসে। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল জটিল ভঙ্গিতে বিলুর গল্প বলেননি। শুধু বিলুর মনের কথাগুলো লিখেছেন, দিনপঞ্জির মতো করে। পুরো উপন্যাসটিতে বিলু নিজেই তার গল্প বলে গেছে।
যারা গল্পটি পড়েননি তাদের জন্য দ্রষ্টব্য, গল্পটি কিন্তু সায়েন্স ফিকশন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেশিরভাগ সায়েন্স ফিকশনের মতো এর প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন কোনো গ্রহ, ভিন্ন কোনো সময় নয়। বর্তমানের সময়েই বিলুর কাছে আসে ছোট্ট এক এলিয়েন। বিলু আর এলিয়েনের মাঝে বন্ধুত্ব, তাদের ছোটখাট দুঃসাহসিক অভিযান রূপকথার মতোই শোনাবে।
বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর
কিশোর থাকতেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন রইস উদ্দিন। তার ভয়ে অফিসের বস তটস্থ। একবার শখ করে পুষেছিলেন একজোড়া সাপ। চিড়িয়াখানায় বাঘের কান চুলকে দেন অবলীলায়। কিন্তু তার একমাত্র ভয় বাচ্চাকাচ্চাকে। পৃথিবীর সব বাচ্চাই যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। বাচ্চাকাচ্চার ভয়ে জীবনে বিয়েই করেননি তিনি। বিজ্ঞাপন ফার্মে দিনের নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চাকরি করে ভালোভাবেই যাচ্ছিল তার দিনকাল। একদিন সব উল্টাপাল্টা করে দিলো মোল্লা কফিল উদ্দিন বিএবিটি নামে একজনের চিঠি। সে চিঠিতে লেখা শিউলি নামের অতি দুষ্টু মেয়ের পুরো পরিবার নৌকাডুবিতে মারা গেছে। শিউলি নাকি রইস উদ্দিনের ভাতিজি। কফিল উদ্দিন চিঠিতে লিখেছেন শিউলিকে নিয়ে যেতে।
যেহেতু রইস উদ্দিনের ভাই বা ভাইয়ের মেয়ে কিছুই নেই তাই তিনি গুরুত্ব দিলেন না বিষয়টিকে। তারপর আবারও চিঠি এলো। মানুষকে ভূত সেজে ভয় দেখানো বা চেয়ারম্যানের নামে কুকুর পোষা সব কিছুতে সে পারদর্শী! এমন মেয়েকে না নিয়ে গেলে কফিল সোজা মামলায় দিয়ে দেবেন রইস উদ্দিনের নামে। তারপর আরো একটি চিঠি! সেখানে কফিল জানিয়েছেন তিনি শিউলির কিডনি বিক্রয় করতে চান আড়াই হাজার টাকায়। কিডনি বিক্রয় করার পর তা নাকি টিকটিকির লেজের মতো আবার গজিয়ে যায়। রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন রইস। যেভাবেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।
বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর ভালোবাসার গল্প। আলাদা আলাদা মানুষদের একটা পরিবার হয়ে ওঠার গল্প। সহজ সুরে লেখা রইস আর তার বাচ্চাকাচ্চা দলের প্রতিদিনকার গল্প পড়ে পাঠক স্বস্তি পাবেন তার নিশ্চয়তা দেয়া যায়।
শান্তা পরিবার
শান্তা যখন খুব ছোট, তখন তার বাবা মারা গেল। মাত্র চার বছর বয়সে ক্যান্সার কেড়ে নিল তার মাকেও। ছোট্ট শান্তাকে তখন কে দেখবে? আত্মীয়রা ধীরে ধীরে সরে গেল। ছোট ফুপুর বাসায় অনেকটা কাজের মেয়ের মতো অনাদরে বড় হচ্ছিল শান্তা। এদিকে লেখাপড়ায় সে আবার ভীষণ ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ করে ভালোবেসে বিয়ে করলো শওকতকে। এত মেধাবী শান্তা, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হয়ে যেতে পারতো! কিন্তু শান্তার বায়না তার আধ-ডজন বাচ্চা হবে। তাকে কখনো কেউ আদর করেনি। তাই সে সকল বাচ্চাকে বসে বসে আদর করবে, কোনো চাকরি করবে না। আধডজন না হলেও পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা হলো শান্তার। শান্ত মেয়ে শাওলী, দার্শনিক সাগর, চঞ্চল বন্যা, বিজ্ঞানী সুমন আর সবার ছোট পরীর মতো ঝুমুর। সুখেই ছিল শান্তা পরিবার, কিন্তু একদিন মতিঝিলের সামনে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেল শান্তা। ভীষণ একা করে গেল তার ভালোবাসার পরিবারকে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই গল্পটি মানুষের বেঁচে থাকার গল্প। প্রিয় মানুষ হারানোর চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে প্রতিদিন বেঁচে থাকতে শেখা, পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠা।
দীপু নাম্বার টু
দীপুর বাবার কিছুতেই এক জায়গায় মন বসে না। এক জায়গায় থাকতে থাকতে নাকি তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। তাই ফলে বছর বছর স্কুল বদল করা লাগে দীপুর। ক্লাস এইটে এসে সে ভর্তি হলো মজার এক স্কুলে। প্রথম দিনেই শিক্ষক তাকে পুরো ক্লাসের সামনে লেকচার দিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দীপুর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছোটবেলার স্কুলগুলোর নাম এখন আর মনেই করতে পারে না। দীপুর বাবা তার সন্তানকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান সারাদেশ। কিন্তু তার মা? দীপু বলে তার মা মারা গেছে। প্রতিবার, প্রতি স্কুলেই একই কথা বলে আসছে। কিন্তু দীপুর মায়ের আসল রহস্য কী? প্রথম দিনেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া দুরন্ত ছেলে তারিকের সাথে কি তার আদৌ বনিবনা হবে? যদি সবাইকে নিয়ে মানিয়েও নেয়, লাভ কী? বছর শেষে তো তাকে ছাড়তেই হবে স্কুল!
অসাধারণ এই গল্পটিও কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালের আর পাঁচটা বইয়ের মতোই প্রাঞ্জল সুরে বলা। দীপুদের পরিবারের মতো একটা ভেঙে যাওয়া সংসারের, উদাস পিতার ছেলের জটিল সমীকরণ হয়তো এত সহজে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো না, যেটা সম্ভব করেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। গল্পের ভাষার মতোই বুঝতে কঠিন হবে না দীপুর অনুভূতিগুলো। গল্পের মুগ্ধতায় পাঠক জড়িয়ে ফেলবেন নিজেকে।
আমার বন্ধু রাশেদ
রাশেদের আসল নাম রাশেদ নয়। লাড্ডু। লাড্ডু আবার কোনো নাম নাকি? রাশেদ যখন ইবুদের স্কুলে এসে ভর্তি হলো, ক্লাসের শিক্ষক ঘটা করে লাড্ডুর নাম বদলে রাখলেন ‘রাশেদ হাসান’। রাশেদের বাবা একটু পাগল স্বভাবের কিনা, ছেলেদের ঠিকমতো নাম রাখেননি তিনি। রাশেদের আরেক ভাইয়ের নাম চমচম। রাশেদের মতো কিশোরদের হয় ঠিকমতো লেখাপড়া করার কথা, নয়তো সারাদিন দুষ্টুমি করার কথা। কিন্তু রাশেদ তাদের সবার চেয়ে আলাদা। তার বাবাকে ইংরেজি পত্রিকা পড়ে সে রাজনীতির খবর শোনায়। এলাকার গুন্ডা কাচু ভাই তাকে মায়া করেন। ইবুদের শখের বিস্কুটের ফ্যাক্টরি দেখে তার মনে হয় এই বিস্কুট গরীব বাচ্চাদের দেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকেও সচেতন সে। এমন সময়ে আসে ৭১। সারাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়।
এটি দেশকে ভালোবাসার গল্প। দেশের জন্য ভালোবাসা মানুষকে কতটা উদার হতে শেখায় তার গল্প।
ফিচার ইমেজ- List Challenges