কোলেটেরাল বিউটি: মৃত্যুতেও সৌন্দর্য খুঁজতে শেখায় যা

অলিভিয়া নামের একটি শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তার মা মেডেলিন বসে আছেন বাইরে। কান্নায় তার দু’চোখ ভারী হয়ে আছে। পাশ থেকে এক বৃদ্ধা মেডেলিনকে বলে উঠলেন, “আপনি কি কাউকে হারাতে চলেছেন?”

মেডেলিন কিছু বলার আগেই সেই মহিলা আবার বললেন, “আপনি কাকে হারাতে চলেছেন?”

মেডেলিন বললেন, “আমার মেয়েকে।”

বৃদ্ধা বললেন, “এর ভেতরের পরোক্ষ সৌন্দর্যটাও দেখার চেষ্টা করবেন।”

‘শেষে’র একটি সৌন্দর্য আছে। সূর্যাস্ত দিন শেষের জানান দেয়। তবুও সূর্যাস্তের একটা সৌন্দর্য আছে। প্রতিকূল সময় মানুষের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে যায়। ত্যাগেও অনেক সময় অর্জন থাকে। ছেড়ে দেয়ার মাঝেও থাকে তৃপ্তি। চলে যাওয়ার মাঝে থাকে ফিরে আসার প্রেরণা। মৃত্যুর মাঝেও আছে সৌন্দর্য। ‘Collateral Beauty’ শব্দের অর্থ সেটিই। পরোক্ষ সৌন্দর্য বা সমান্তরাল সৌন্দর্য। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এ পৃথিবীর যেসব ব্যাপারকে নেতিবাচক ভাবি, পর ভাবি, অসুন্দর ভাবি- সেসব জিনিসের মাঝেও অনেক সময় একটি ইতিবাচক দিক থাকে, একটি সমান্তরাল সৌন্দর্য থাকে। 

মৃত্যু মাঝে মাঝে খুব আকস্মিকভাবে আসে। প্রকৃতির ক্রমিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, অপ্রস্তুত সময়ে। সেই কারণে বেশিরভাগ মানুষ এ ধরনের মৃত্যুর সমান্তরাল সৌন্দর্য দেখতে পারে না। দিশা হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে নিজেকে। কান্না তাদের দুঃখ ঘোচায় না। সময় তাদের ক্ষত ভোলায় না।

হাওয়ার্ড ইনলেট সেই ধরনের মানুষদের একজন। তিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান ছিলেন। হাওয়ার্ডের তিন পার্টনার হুইট, ক্লরা আর সিমনকে নিয়ে দুর্দান্তভাবে এগোচ্ছিল সংস্থাটি। কিন্তু মাঝে বাধ সাধে হাওয়ার্ডের অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা। ছয় বছরের এক ছোট মেয়ে ছিল তার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে। এরপর থেকে অফিসের কোনো কাজে মন নেই তার। মেয়ের মৃত্যুতে বেঁচে থাকার সব যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলেন তিনি।

কন্যাশোকে মনোযোগ হারানো হাওয়ার্ড ইনলেট; Image Source: IMDb

Time, Love and Death- এ তিনটিই ছিল হাওয়ার্ডের জীবনদর্শনের মূল। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুতে এসবের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন তিনি। Time,  Love, Death এর উদ্দেশ্যে লিখতে থাকেন চিঠি, উড়ো চিঠি। আর এসব চিঠিই একসময় তার বন্ধু ও সহকর্মী হুইট, ক্লরা এবং সিমনের হাতে আসে।

হাওয়ার্ডকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বিচিত্র সব চিন্তা নিয়ে এগোতে থাকেন তারা। এসবের পেছনে কোম্পানি বাঁচানোর উদ্দেশ্য যেমন ছিল, তেমনই ছিল বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার প্রবল তাড়নাও। আর এসব করতে গিয়ে তারা দ্বারস্থ হন ব্রিজিটা, এমি এবং রাফি নামের তিন মঞ্চাভিনেতার। বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চলতে থাকে হাওয়ার্ডের মানসিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে তার সহকর্মীরাও খুঁজে পেতে থাকে জীবনের নতুন নতুন দিক।

হাওয়ার্ডের সহকর্মীরা তাকে উজ্জীবিত করার আলোচনায়; Image Source: IMDb

হাওয়ার্ড কি পারবেন কন্যা হারানোর দুঃখ ভুলতে? তিনি কি পারবেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে? তার বন্ধুদের উদ্ভাবিত বিচিত্র কর্মকাণ্ডগুলো কি সফল হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই এগিয়েছে ‘কোলেটেরাল বিউটি’ সিনেমার কাহিনী।

ডেভিড ফকনারের পরিচালনায় মুভিটি মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। হাওয়ার্ডের চরিত্রে অভিনয় করেছেনে উইল স্মিথ। হলিউডের বিখ্যাত ‘পারস্যুট অব হ্যাপিনেস‘ মুভিটি যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই উইল স্মিথকে চেনেন, তার অভিনয়শৈলী সম্পর্কে জানেন। এই মুভিতেও হাওয়ার্ড চরিত্রটি উইল স্মিথের হাত ধরে অনন্য হয়ে উঠেছে। অনন্য হয়ে উঠেছে স্মিথ অভিনীত প্রতিটি দৃশ্য। 

মৃত্যুর মুখোমুখি হাওয়ার্ড; Image Source: IMDb

যেমন- পুরো মুভি জুড়ে হাওয়ার্ড (উইল স্মিথ) একবারও তার মৃত মেয়ের নাম মুখে আনতে পারেননি। শেষদিকে এসে তিনি ছল ছল চোখে প্রথমবার মেয়ের নাম একবার মুখে আনেন। তার সেই চোখের পানি দিয়েই যেন দীর্ঘদিন জমিয়ে রাখা সব দুঃখ-ব্যথা-আর্তনাদ নিমেষেই ঝরে পড়েছে। তারপর ধীরে ধীরে প্রশান্ত হয়ে উঠেছে চিত্ত। অঝোর বৃষ্টির পরে, ঘন মেঘের শেষে, সূর্যের কিরণ আকাশকে যেমন শান্ত-শুভ্র করে তোলে, ঠিক তেমন। দর্শকও এ জায়গায় এসে সিনেমার সাথে এক দৈব যোগাযোগ অনুভব করতে বাধ্য হবেন, যার কৃতিত্ব পুরোটাই উইল স্মিথের দুর্দান্ত অভিনয়শৈলীর।

হাওয়ার্ডের বন্ধু হুইটের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ফাইট ক্লাব’ খ্যাত এডওয়ার্ড নর্টন। ক্লরা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘টাইটানিক’ মুভির হার্টথ্রব কেট উইন্সলেট। এমি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান’-এর নায়িকা কেইরা নাইটলি। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন হেলেন মিরেন, মাইকেল পেনা, নাউমি হারিস প্রমুখ। অভিনয়শিল্পীদের নাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারেছেন- এটি একটি তারকাবহুল ছবি।

‘কোলেটেরাল বিউটি’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: IMDb

মুভিতে হাওয়ার্ডের মেয়ের মৃত্যুর ট্রাজেডিকে কেন্দ্র করে কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। কিন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে আরো ছোট ছোট বেদনা এবং পাওয়া-না পাওয়ার কথা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে সবকিছুর মাঝের সামান্তরাল সৌন্দর্যের কথা। কোলেটেরাল বিউটির কথা।  

কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। হাওয়ার্ডের বন্ধু ও সহকর্মী ছিল সিমন, যার ইচ্ছে ছিল সে আরো একশ বছর বাঁচবে। কিন্তু সে জানতে পারে- আর বেশি দিন তার সময় নেই। সে-ও এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। হতাশা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে। তারপর একসময় সে তার ভবিষ্যত মৃত্যুর মাঝেও এক কোলেটরাল বিউটি দেখতে পায়। হিসেবটা ছিল খুব সহজ। সে কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে। তারপর তার ছেলের বয়স যখন পঞ্চাশ হবে, তার নাতির বয়স যখন চল্লিশ হবে, আর নাতির ছেলের বয়স যখন দশ বছর হবে, তখন সিমনের আরো একশ বছর বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূর্ণ হবে। বংশধরদের মাধ্যমে। 

সিনেমার সেটে উইল স্মিথ ও কেইরি নাইটলি; Image Source: IMDb

এছাড়া হুইটের সেই অভিমানী মেয়েটি। যে রাগ করে বাবার সাথে কথা বলে না, দেখা করতে চায় না, বাবাকে ঘৃণা করে। দিনশেষে দেখা যায়- সেসব রাগ, অভিমান আর ঘৃণার মাঝেও কোলেটেরাল বিউটি আছে। ভালবাসা আছে। সেই কারণেই হুইট মেয়ের কাছে কথা বলার সময় চাইলে সে জানিয়ে দেয়, “আগামীকাল আমার অর্ধেক ছুটি।” 

সিনেমায় ব্রিজিটা, এমি আর রাফি নামের তিনটি চরিত্র আছে। চরিত্রগুলোর ধরন প্রথম থেকে বেশ ‘স্ব-প্রকাশিত’ ধরনের হলেও শেষদিকে রহস্য বাধিয়ে দেয়। সেই রহস্যের কথা এখানে আর বলা গেল না। মুভি দেখেই সেটা উন্মোচিত হোক। পরিশেষে এটুকু বলা যায়, সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের মাঝে,  প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের সমান্তরাল সৌন্দর্যের গান গাওয়া হয়েছে। কোলেটেরাল বিউটির কথা বলা হয়েছে।

Language: Bangla

Topic: This article is a review on the movie 'Collateral Beauty' released in 2016.

Featured Image: latimes.com

Related Articles

Exit mobile version