‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’ ফিল্মের গল্পে যতটা না পাগলামি ছিল, দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ম্যাডনেস দেখা যাচ্ছে। এই ম্যাডনেসের মূল কোথায়? কেনই বা এই মুভি নিয়ে ফ্যানদের এত বিভেদমূলক আচরণ? মুভিটির এহেন প্রতিক্রিয়ার আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের আর্টিকেল।
বি.দ্র.: আর্টিকেলে ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ২’ পর্যন্ত এমসিইউ ফেইজ ফোরের স্পয়লার রয়েছে
ইনফিনিটি সাগার বিপুল সাফল্যের পরে দুনিয়া জুড়ে মার্ভেলের জয়জয়কার। ফাইগি এন্ড কোং-এর উপরে অগাধ ভরসায় সবাই নতুন এক যাত্রা শুরু করল- ফেইজ ফোর! কী আসতে যাচ্ছে ইনফিনিটি সাগার পরে? চেনা-পরিচিত হিরোদের আবার কবে দেখতে পাবে ভক্তরা? নতুন কোন হিরোদের জন্য সবাই বেশি এক্সাইটেড? পরাক্রমশালী ভিলেন হিসেবে থ্যানোসের উত্তরাধিকারী কে আসছে? কোন স্টোরিলাইন হতে যাচ্ছে দর্শকদের ঘোরের নতুন বস্তু? এসব জল্পনা-কল্পনার জ্বালানী নিয়ে ২০১৯ সালের জুনে স্যান ডিয়েগো কমিক কনে এক প্রেজেন্টেশন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মার্ভেল স্টুডিওজ-এর সর্বেসর্বা কেভিন ফাইগি। প্রেজেন্টেশনে ছিল মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের ভবিষ্যত নিয়ে একগাদা প্রকল্পের আভাস।
সেই প্রেজেন্টেশন থেকে ফ্যানদের মনে সবচেয়ে বড় দাগ কাটে একটা কথা- ‘মাল্টিভার্স’! ‘স্পাইডারম্যান: ফার ফ্রম হোম’-এ মিস্টেরিওর বানানো মাল্টিভার্স না, মার্ভেল কমিক্সের আসল মাল্টিভার্সই আসতে যাচ্ছে এমসিইউতে। ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’ টাইটেলে ডক্টর স্ট্রেঞ্জের দ্বিতীয় কিস্তির মুভিকে টিজ করা হলো এই মাল্টিভার্স মুভি হিসেবে। গত সপ্তাহে মুক্তি পেল মাল্টিভার্সের সেই মুভি, এবং দর্শকরা গভীরভাবে বিভক্ত। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। কেউ কেউ মুভির কোয়ালিটি নিয়ে অসন্তুষ্ট, কেউ অগণিত সারপ্রাইজ ক্যামিওর আশায় মুভি দেখতে গিয়ে আশাহত, কেউ মাল্টিভার্স অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে অসন্তুষ্ট, আর কিছু সংখ্যক দর্শক মুভি নিয়ে সন্তুষ্ট যারা স্যাম রেইমির প্রশংসা করছেন একটা উপভোগ্য মুভি উপহার দেয়ার জন্য।
এই মুভির মাল্টিভার্স নিয়ে দর্শকদের হতাশার কারণ বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে ফেইজ ফোরের শুরুতে। চলুন, ফেইজ ফোরে মাল্টিভার্সের জার্নিটা দেখে আসি।
ওয়ান্ডাভিশন (WandaVision)
কোভিড মহামারীর কারণে পরিকল্পনায় ৫ নাম্বারে থাকা প্রজেক্ট দিয়েই শুরু হলো এমসিইউর ফেইজ ফোর। ‘ওয়ান্ডাভিশন’ ছিল এযাবৎকালে এমসিইউর সবচেয়ে ভিন্ন ধাঁচের, অনন্য কাজ। ডিজনি প্লাসের এই লিমিটেড সিরিজে ওয়ান্ডা ম্যাক্সিমফের অসহনীয় শোক, বিষণ্নতা আর একাকিত্বের বিস্ফোরণে নিউ জার্সির ওয়েস্টভিউ শহরে তৈরি হয় এক সিটকম রিয়েলিটি, যেখানে শহরের বাসিন্দাদের ওয়ান্ডা পরিণত করে সিটকমের চরিত্রে। সিরিজের প্রতিটি এপিসোডে আমরা ওয়ান্ডার তৈরি করা এই সিটকমের ‘এপিসোড’ দেখতে পাই, সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয় এক গভীরতম রহস্যের। অবশেষে সিরিজের অষ্টম এপিসোডে আমরা জানতে পাই আসলে কী হয়েছিল, কেনই বা ওয়ান্ডা একটা শহরকে এভাবে জিম্মি রেখেছে, আর সাথে ওয়ান্ডার পাওয়ারের বিস্তার। ক্রমশ আমরা জানতে পারি ওয়ান্ডা ম্যাক্সিমফ কোনো সাধারণ সুপারহিরো নয়, বরং মহা ক্ষমতাধর ভবিষ্যদ্বাণীতে থাকা এক পৌরাণিক সত্ত্বা। এই ক্ষমতাধর নারীর তীব্র শোক, আর স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে অসাধারণ আবেগময় এক গল্প ছিল ‘ওয়ান্ডাভিশন’।
মহামারীর মধ্যে ‘ওয়ান্ডাভিশন’ হয়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাপী এক সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। প্রতি সপ্তাহে আলোচনা, থিওরি, স্পেকুলেশনের ঝড় উঠত অনলাইনে। সিরিজের এত জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল আসন্ন মাল্টিভার্স নিয়ে সবার উৎসাহ। একে তো এলিজাবেথ ওলসেনের স্কারলেট উইচ ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ২’ এর কো-লীড, তার উপর ওয়ান্ডাভিশনে এক্স-মেনের ‘কুইকসিলভার’ ইভান পিটারসের সংযোজন। এসব মিলিয়ে সবার চিন্তায় ছিল এই সিরিজেই হয়তো আমরা মাল্টিভার্সের প্রথম অধ্যায় দেখতে পাব। তো, সিরিজের ফিনালেতে যখন এরকম কিছুই ছিল না, সবাই যারপরনাই হতাশ ছিল। তা-ও পোস্ট ক্রেডিট সিনে ওয়ান্ডার ডার্কহোল্ড পড়ার সিন দেখে সবার মনে আবার আশার সঞ্চার হলো।
লোকি (Loki)
মহামারীর কবলে সিনেমা হল বন্ধ থাকায় একাধারে তিনটি সিরিজ দিয়েই শুরু হয়েছিল ফেইজ ফোর। তিন নাম্বারে আসলো সবার প্রিয় অ্যাজগার্ডিয়ান দুষ্টবুদ্ধির দেবতা ‘লোকি’। এমসিইউ-তে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী চরিত্রগুলোর মধ্যে লোকি একদম প্রথম সারির। ২০১০ সালে প্রথম ‘থর’ মুভির ভিলেন আজ অন্যতম ফ্যান ফেভারিট চরিত্র। অবশেষে লোকি পেল তার নিজের সোলো টাইটেল। ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম’-এর টাইম ট্রাভেলের এক অন্য মাত্রা আমরা দেখতে পাই ‘লোকি’ সিরিজে। ‘টিভিএ’ নামক এক আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের মাধ্যমে ব্র্যাঞ্চ টাইমলাইন, নেক্সাস পয়েন্ট ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ফিনালেতে আমাদের দেখা হয় এমসিইউ-র সম্ভাব্য পরবর্তী থ্যানোস আকারের ভিলেন, ক্যাং-এর সাথে।
সিজন ফিনালেতে সিলভি ক্যাং-এর ভ্যারিয়েন্ট কে মেরে সরাসরি মাল্টিভার্সের দরজা খুলে দিল। খুবই এক্সাইটিং মুহুর্ত ছিল ফ্যানদের জন্য সে সময়ে। ‘ওয়ান্ডাভিশন’-এর মাল্টিভার্স নিয়ে হতাশা যেন উবে গেল কারণ সবাই ধরে নিল এটাই ছিল এমসিইউ মাল্টিভার্সের দ্বিতীয় অধ্যায়। সিলভির এই কাজের ফলাফলই আমরা দেখতে পাব ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ২’-এ।
হোয়াট … ইফ? (What … If?)
এমসিইউ প্রবেশ করল অ্যানিমেশন জগতে ‘হোয়াট ইফ’ সিরিজ দিয়ে। এখানেই প্রথম ঘটা করে শুরু হলো মাল্টিভার্সের কাহিনী। প্রতি এপিসোডে আমরা দেখতে পেলাম একেকটা নতুন ইউনিভার্স, যেখানে ক্যারেক্টারদের ভিন্ন চয়েসের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন একেকটা ইউনিভার্সের জন্ম হচ্ছে। আমাদের চেনা-পরিচিত চরিত্রদের অন্য রূপ বা “ভ্যারিয়েন্ট” দেখতে পেলাম। ক্যাপ্টেন কার্টার, স্টারলর্ড টি’চালা, স্ট্রেঞ্জ সুপ্রিমের মতো ভ্যারিয়েন্টদের সাথে পরিচিত হলাম। ‘দ্য ওয়াচার’-এর বর্ণনায় জানতে পারলাম এমসিইউ মাল্টিভার্সের যত নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ। এমনকি, সিজন ফিনালেতে আলট্রনের বিরুদ্ধে মাল্টিভার্সাল সুপারহিরো টিম ‘গার্ডিয়্যান্স অভ দ্য মাল্টিভার্স’-এর যুদ্ধও দেখলাম।
দর্শকদের কাছে ‘হোয়াট … ইফ?’-কে উপস্থিত করা হয়েছিল বড় পর্দায় মাল্টিভার্স স্টোরির প্রস্তুতি হিসেবে। এখান থেকে মাল্টিভার্স সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে যাতে আসন্ন স্টোরিলাইন ফলো করতে সুবিধা হয়। তো, সবাই সিরিজ শেষ করে অধীর আগ্রহে বসে ছিল বড় পর্দায় আরো গভীরভাবে মাল্টিভার্সের ম্যাডনেস দেখতে।
স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম (Spider-Man: No Way Home)
‘নো ওয়ে হোম’ ছিল টম হল্যান্ডের স্পাইডি ট্রিলজির শেষ মুভি। এমসিইউ-তে মাল্টিভার্স খুলে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে এই মুভিতে স্পাইডারম্যানের পূর্বের সব ভিলেন, এবং বাকি দুই স্পাইডারম্যানকে নিয়ে আসা হলো। সনির আগের দুই স্পাইডারম্যান ফ্র্যাঞ্চাইজিকে এমসিইউর ভেতরেই দুই মাল্টিভার্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলো। দর্শকদের, বিশেষ করে স্পাইডারম্যান ফ্যানদের, স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মুহূর্ত ছিল তিন স্পাইডারম্যানকে একসাথে একশনে দেখা।
তবে এখানে মাল্টিভার্স খুলে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হলো ডক্টর স্ট্রেঞ্জের স্পেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। ‘লোকি’র শেষে সিলভির অ্যাকশনের কোনো প্রভাব এখানেও দেখানো হলো না। পুরো ব্যাপারটা স্পাইডারম্যান-কেন্দ্রিক রাখা হলো, আর তাতে অধিকাংশ দর্শক কোনো সমস্যাও খুঁজে পেল না। সর্বোপরি, মুভিটি স্পাইডারম্যানের লেগ্যাসির প্রতি ট্রিবিউট হিসেবেই বিবেচিত হলো।
ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস (Doctor Strange in the Multiverse of Madness)
সকল পূর্বাভাস, প্রস্তুতির পর বড় পর্দায় হাজির হলো বহুল প্রতীক্ষিত মাল্টিভার্সের পাগলামির মুভি ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’। তিনটা সিরিজ মিলে যে মুভির আগমনের আভাস দিচ্ছিল, এবং এখানেও ‘লোকি’র ফিনালের বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই! এমনকি মুভির ‘মাল্টিভার্স’ অংশে তেমন কোনো গভীরতাই আনা হয়নি। ‘হোয়াট ইফ?’-কে এই মুভির অ্যাপেটাইজার বলা হলেও মুভি দেখে ঠিক তার উল্টোটাই সত্যি মনে হয়েছে। যেন এখান থেকে মাল্টিভার্সের ধারণাটা পেয়ে আমরা ‘হোয়াট ইফ?’-এ সেটা আরো গভীরভাবে এক্সপ্লোর করতাম! এই ব্যাপারের একটা কারণ অবশ্য কোভিড। কারণ, কোভিডের আগের শিডিউলে ‘হোয়াট ইফ?’, ‘লোকি’-র আগেই ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ২’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। এই মুভির হেভি রিশুটের এটা একটা কারণ ছিল। কিন্তু রিশুটের পরও ইস্যু কোনোটাই সমাধান হয়নি।
মহামারীর কারণে ফেইজ ফোরের রিলিজ শিডিউল একদমই ওলটপালট হয়ে যাওয়ার প্রথম নেতিবাচক ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এই মুভির মাধ্যমে। বর্তমান ফেইজে মার্ভেল বিভিন্ন জিনিস চেষ্টা করে দেখছে কোনটা দর্শকদের মনে ধরে, কোনদিকে গেলে ফ্যান সাপোর্ট বেশি পাওয়া যাবে। মাল্টিভার্স স্টোরিলাইন বর্তমানে খুবই অগোছালো পর্যায়ে রয়েছে। দর্শকদের এখন অপেক্ষার পালা এই স্টোরিলাইন নিয়ে ফাইগি এন্ড কোং কোথায় যায়।