চলচ্চিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ জনরা। জনরা, ক্যাটাগরি এবং ব্যাপ্তির ভিন্নতা একেকটি চলচ্চিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয় একেক বিশেষণে। বহির্বিশ্বের চলচ্চিত্রে বহু রকম এক্সপেরিমেন্ট হলেও বাংলাদেশে জনরার দিক থেকে খুব একটা তারতম্য দেখা যায় না। ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রি সচরাচর রোমান্টিক আর অ্যাকশনের আবর্তেই ঘুরপাক খায়। এরপরও বিভিন্ন সময়ে নির্মাতারা ব্যূহ ভেদ করেছেন গতানুগতিক এ আবর্তের। সময়ের দাবি পূরণ করে নির্মাণ করেছেন প্রথমবারের মতো ভিন্ন কোনো জনরার চলচ্চিত্র। আজকের এ লেখায় থাকছে বংলাদেশে বিভিন্ন জনরায় প্রথমবারের মতো নির্মিত এমনই কিছু ছায়াছবির কথা।
প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র
স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী যা নির্মিত হয় ১৯৮০ সালে। সেই বিবেচনায় ছবিটির পরিচালক বাদল রহমানই হচ্ছেন শিশু-কিশোরদের নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক। এরিখ কাস্টনারের মূলগল্প থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয় এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী। খুলনা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসে কিছু টাকা হারায় কিশোর এমিল। ঐ টাকা উদ্ধার করতে গঠিত হয় কিশোর গোয়েন্দার দল। শুরু হয় তাদের রোমাঞ্চকর উদ্ধার অভিযান। এই চলচ্চিত্রের দেখানো পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে ছুটির ঘণ্টা, পুরষ্কার, দীপু নাম্বার টু, ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিচ্ছু বাহিনী, কাবুলীওয়ালা, লিলিপুটরা বড় হবে, দূরত্ব, দূরবীন, আমার বন্ধু রাশেদ, বৈষম্য, রাজপুত্তুর সহ আরো অনেক শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
প্রথম সাইকো-থ্রিলার চলচ্চিত্র
বিশ্বের অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ভুরি ভুরি উদাহরণ থাকলেও বাংলাদেশের দর্শকরা প্রথমবারের মতো সাইকো-থ্রিলার ফিল্মের দেখা পায় পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের বিশ্বপ্রেমিক (১৯৯৫) সিনেমার মধ্য দিয়ে। প্রয়াত প্রথিতযশা অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদিকে ফিল্মে সাইকোর ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি এমন একজন সিরিয়াল কিলার যে কিনা গলায় তিল আছে এমন মেয়েদের টার্গেট বানিয়ে খুন করে। এবং সেই তিল কেটে নিয়ে তিলের মালা বানিয়ে সংগ্রহে রাখে। বিশ্বপ্রেমিকের পর বহু বছর আর কোনো ভালো মানের সাইকোথ্রিলারের দেখা মেলেনি। তবে সর্বশেষ অনিমেষ আইচের জিরো ডিগ্রী (২০১৪)-র মাধ্যমে সাইকো-থ্রিলার ফিল্মে আবার আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র
বিশ্বের অন্যান্য দেশে সায়েন্স ফিকশন জনরার সিনেমা নির্মিত হলেও আমাদের দেশের নির্মাতারা এক্ষেত্রে দীর্ঘকাল পিছিয়ে ছিলেন। প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে ২০ জুলাই ২০১৫ সালে মুক্তি পায় দেশের সর্বপ্রথম সায়েন্স ফিকশন এপার্টমেন্ট 5D, যার নির্মাতা অমিত আশরাফ। ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ফিল্ম আকাশ নামে এক রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যে একাকী জীবনে তার খালি বাড়িতে বায়ার্সদের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গ্লাস পরিয়ে বাড়িকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সজ্জিত করে দেখায়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে একসময় সে তার 5D এপার্টমেন্টে সেরিনা নামে এক নারীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। অতঃপর রহস্যময়ী সেরিনা তাকে নিজের স্বামী বলে দাবি করে। আকাশ কি গ্রহণ করবে নাকি প্রত্যাখান করবে এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি! এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে এপার্টমেন্ট 5D’র কাহিনি।
তবে এপার্টমেন্ট 5D মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সায়েন্স ফিকশন ফিল্ম হলেও সর্বপ্রথম ২০১২ সালে আমাদের দেশে সাইফাই নির্মাণ শুরু হয় স্বপন আহমেদেরপরবাসিনী‘র মাধ্যমে। বিগ বাজেটের এই মুভিতে ১২টি দেশের অভিনয়শিল্পীদের উপস্থিতি আছে। যাদের মধ্যে রিত মজুমদার, উর্বশী রাউতেলার মতো তারকারাও ছিলেন। ১৬টি দেশে দৃশ্যায়িত এ সিনেমায় আছে ৪৮ মিনিটের ভিএফএক্স। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে নির্মিত হয় নায়িকা ববি অভিনীত, ইফতেখার চৌধুরীর চলচ্চিত্র বিজলী।
[কিন্তু নাগনাগিনীর সিনেমা অথবা সুপারহিরো ঘরানার তথা ড্যানি সিডাক অভিনীত সুপারম্যান কিংবা মান্না অভিনীত মাথানষ্ট ফিল্মগুলোকে আমলে নিলে বাংলাদেশে সাইফাই সিনেমা নির্মাণ অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে!]
প্রথম ভৌতিক চলচ্চিত্র
সাইফাইয়ের মতো এই জনরাতেও বাংলাদেশের প্রথম ফিচার ফিল্মের হদিস বের করা দুরূহ। ভূত-প্রেতকে নানাভাবে ফিল্মে ব্যবহার করা হলেও ভৌতিকতাকে উপজীব্য করে কোনো ফিচার ফিল্ম ২০০৮ সালের আগে আর্কাইভে ছিল না। এ জনরায় খায়রুন সুন্দরী খ্যাত নির্মাতা এ. কে. সোহেল প্রথম নির্মাণ করেন ডাইনী বুড়ি। মুভিতে দেখা যায়— যমুনা নামে এক মহিলা তান্ত্রিকের বোন শেফালী এক যুবকের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে। যমুনার গুরু ডাইনী বুড়ির সহযোগিতায় তার বোনের মৃত আত্মাকে পঞ্চ আত্মার রূপ দিয়ে শিষ্য চান্ডালের সহযোগিতায় পাঠিয়ে দেয় কলেজ হোস্টেল বসবাসরত পাঁচ সুন্দরী যুবতীর উপর। সেই পাঁচ সুন্দরী রাত গভীর হলেই বীভত্স রূপ ধারণ করে হোস্টেলের রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় যুবকদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। যদিও দুর্বল কাহিনী, মেকাপ এবং এডিটিংয়ের জন্য চলচ্চিত্রবোদ্ধা মহলে হরর হিসেবে সেটি খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরবর্তী সময়ে শাহীন সুমনের সেদিন বৃষ্টি ছিল এবং রিকিয়া মাসুদের নির্মিত দ্য স্টোরি অব সামারা-কে হরর ধাঁচের নির্মাণের প্রচেষ্টা বলেই ধরা হয়।
প্রথম স্পোর্টস চলচ্চিত্র
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম স্পোর্টস ফিল্মের সংযোজন ঘটে ২০১০ সালে জাগো: Dare To Dream’র মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে উৎসর্গ করা এ ছবির পরিচালনায় ছিলেন খিজির হায়াত খান। মুভিটিতে খেলা মূল একটি অংশ ধরে রাখলেও প্রেম, ভালোবাসা, পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, দারিদ্রের কষাঘাত আর জীবনের কঠিন দিকগুলোর অস্তিত্বও তুলে ধরেছেন পরিচালক। ত্রিপুরা একাদশের বিরুদ্ধে কুমিল্লা একাদশের ফুটবল লড়াই দেখানোর পাশাপাশি স্ফূরণ ঘটেছে দেশের হয়ে বিজয়ের প্রত্যাশায় একঝাঁক তরুণের স্বপ্ন আর অদম্য দেশপ্রেম। খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে এরপর আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত না হলেও সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ন ডরাই-কে কেউ কেউ স্পোর্টস ফিল্ম ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করেন।
প্রথম অপরাপর জাতিসত্তার ভাষায় চলচ্চিত্র
অং রাখাইন নির্মিত বাংলা ব্যতীত ভিন্ন ভাষার (চাকমা) প্রথম ফিচার ফিল্ম মর থেঙ্গারি (মাই বাইসাইকেল, ২০১৫)। যান্ত্রিক বস্তু যে কখনো অযান্ত্রিক হয়ে মানুষের আবেগের জায়গা কেড়ে নিতে পারে, এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম সেই গল্পই বলে। চলচ্চিত্রে একটি সাইকেলের প্রতি প্রেম অন্য সব প্রেমের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। মর থেঙ্গারি আমাদের দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যেখানে পাহাড়ি জীবনকে অত্যন্ত স্বতঃফূর্তভাবে দেখানো হয়েছে। তবে সেন্সর বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী ফিল্মের অরিজিনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা অথবা ইংরেজি না হবার কারণসহ নানাবিধ বিধিনিষেধের দরুণ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে উত্সবে প্রশংসিত এই ছবিটির ছাড়পত্র এখনও মেলেনি।
প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র
১৯৭১ সালের আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ওরা ১১জন। বাংলাদেশের প্রথিতযশা পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম ছবিটি নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিজেরাই অভিনয় করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু। ছবিটি ১৯৭২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ওরা ১১ জন-এর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অসাধারণ আরও অনেক নির্মাণ পরবর্তীতে দেখা যায়। তার মধ্যে সংগ্রাম (১৯৭৩), আগুনের পরশমণি (১৯৯৪), হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭), শ্যামল ছায়া (২০০৩), জয়যাত্রা (২০০৪), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), খেলাঘর (২০০৬), অস্তিত্বে আমার দেশ (২০০৭), আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১), গেরিলা (২০১১), মেঘমল্লার (২০১৪), অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫ ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাংলা ভাষাভাষীদের গৌরবময় আরেক অধ্যায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে এযাবৎ চলচ্চিত্র হয়েছে মোট তিনটি— জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), বাঙলা (২০০৬) ও ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯)।
প্রথম অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র
আমাদের দর্শকরা ডিজনী পিক্সার, সনি পিকচার্রস এনিমেশন, স্টুডিও জিবলি (2D), ড্রিমওয়ার্কস স্টুডিও কিংবা স্টুডিও ফলিমেজের এনিমেশন দেখে যখন মুগ্ধতা প্রকাশ করে, তখন অজান্তেই আক্ষেপ হয়। এই আক্ষেপ ঘোচাতেই কিনা ২০১৪ সালে নির্মাতা অমিত আশরাফ কাজ শুরু করেন ফিল্ম ড্রিমস্টেইজ নিয়ে। স্বপ্ন ও ফ্যান্টাসি নিয়ে শিশুতোষ অ্যানিমেশনটি নির্মাণে সহযোগিতা করেছে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বন্ধুরা।
অবশ্য ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের নাম মুজিব আমার পিতা। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রযোজনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বই ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। ৮ মে, ২০২২ নিউইয়র্কে ফিল্মটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র
বাংলাদেশের প্রথম ইংরেজি ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র গোর ( The Grave)। গোর ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরিচালক গাজী রাকায়েত নিজেই। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চাহিদাসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় বিভিন্ন দেশেই এখন ইংরেজি ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ভাষা ইংরেজি হলে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের বেস্ট পিকচার সেকশনের প্রতিযোগিতায় (ব্যতিক্রম কোরিয়ান চলচ্চিত্র— প্যারাসাইট, যা কিনা অস্কার ইতিহাসে একমাত্র বেস্ট পিকচার পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র যার ভাষা ইংরেজি নয়।) প্রেরণে বিশেষ কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না।
সেই সুবাদে চলচ্চিত্রটি ৯৪ তম একাডেমি পুরস্কার তথা অস্কারের সাধারণ বিভাগে প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র হিসেবে প্রতিযোগিতা করার জন্য জমা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের ৪৫ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে গোর মোট ১১টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এ ছবিতে নবাগত রোজালিন দীপান্বিতা মার্টিন অসাধারণ অভিনয় করে বিশেষ নজরে আসেন।