-আমি এক নম্বরি জানি, দু’ নম্বরি জানি।
-কী?
-আমি এক নম্বরি জানি, দু’ নম্বরি জানি।
-(আনন্দের হাসি থামিয়ে, ভ্রু কুঞ্চিত করে, নাতির কাঁধে রাখা হাতটা সরিয়ে নিয়ে) কী করে জানলে, দাদু?
-বাবা জেঠুকে বলছিলো, খুব জোরে জোরে- তোমার দু’ নম্বরি আছে, আমার দু’ নম্বরি আছে, এক নম্বরি আছে। আমি শুনেছি। তোমার কী আছে দাদু? তিন নম্বরি? চার নম্বরি?
সত্তরে পা দেয়া বৃদ্ধ আনন্দমোহন মজুমদারের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো তার তৃতীয় পুত্রের একমাত্র সন্তানের সাথে। ডিঙ্গু নামের সেই ছেলে সন্তানটি কী কী জেনেছে কিংবা শিখেছে, তা বলছিলো দাদুর কাছে। সে ইয়েতি জানে, উইম্বলডন জানে। এগুলো শুনে বড়ই রোমাঞ্চিত এবং আনন্দিত হচ্ছিলেন বৃদ্ধ। এই ছোট্ট বয়সেই তার নাতি ইয়েতি জানে, খুশি হবার মতোই ব্যাপার। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারেন ডিঙ্গু দু’ নম্বরি জানে, তখন তার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। মুখটা পাংশু হয়ে যায় তার।
আনন্দমোহন একজন সৎ এবং পরিশ্রমী ব্যক্তি। তার চাকরিজীবনের পুরোটা সময় তিনি এমনই থেকেছেন। কাউকে ঠকাননি কিংবা কাউকে ঘুষ দেননি। তার এলাকার জনগণের কাছে তিনি দেবতার মতো একজন মানুষ। তাইতো তার নামে সেই উপশহরের নামকরণ করা হয় ‘আনন্দ নগর’। তিনি চান, তার সন্তানেরাও তার মতোই ক্যারিয়ারে সৎ থাকবেন। তারা তেমনি আছেন বলে তিনি ধারণা করেন। কিন্তু তার নাতির মুখে শোনা সেই বাক্যটি তাকে ভ্রম থেকে বের করে নিয়ে আসে।
এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম যখন আসে, তখন কী করে দুর্নীতি খুব দ্রুত তাদের রন্ধ্রে প্রবেশ করে? কী করে সৎ মানুষদের সরিয়ে অসৎ লোকেরা জায়গা দখল করে? কী করে সৎ রক্ত থেকে বের হয়ে আসে অসৎ রক্তের শাখা? আর সেই শাখার প্রশাখাগুলো জন্মলগ্ন থেকেই পরিচিত হতে থাকে কালো থাবার সাথে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নমুনা আকারে আমরা পাই ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা প্রশাখা’ সিনেমাতে।
সত্যজিৎ রায় প্রোডাকশনস, এরাটো ফিল্মস (প্যারিস) এবং ডি ডি প্রোডাকশনসের (প্যারিস) প্রযোজিত ১৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যের কলকাতার সিনেমা ‘শাখা প্রশাখা’। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন অজিত মজুমদার, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, রঞ্জিত মল্লিক, লিলি চক্রবর্তী, মমতা শঙ্কর এবং শিশু চরিত্রে সোহম। এই সিনেমার ক্যামেরা অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায়। এই সিনেমাতেও কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং সঙ্গীতে ছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায় নিজেই।
পরতে পরতে গূঢ়ার্থ
“তুই যে এ বাড়িতে আছিস, মাঝে মাঝে সেটা ভুলেই যাই”
আনন্দমোহনের চার ছেলে। তাদের একজন, দ্বিতীয় ছেলে প্রতাপ, বাবা আনন্দমোহনের মতে তার ছেলেদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বহুদিন আগে বিলেতে পড়তে গিয়ে প্রতাপের মোটর অ্যাক্সিডেন্ট হবার পর সবকিছু পাল্টে যায়। এখন তিনি বাবার সাথে বাড়িতেই থাকেন। নিজের ৭০তম জন্মদিবসে এই সন্তানের সাথেই দেখা করেন বাবা আনন্দমোহন। একই বাড়িতে থেকেও দেখাই হয় না বাবা আর ছেলের মধ্যে। কারণ সেদিনের সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর তার এই ছেলেটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
কিন্তু এমন মেধাবী ছেলের কথা বাবা ভুলেই যান! এর মাধ্যমে আসলে বোঝানো হয়েছে সত্যিকারের মেধাবী কিংবা আসল সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদদের কথা আমরা প্রায়শই বেমালুম ভুলে যাই। মানসিক সমস্যাকেই দেখা হয় বড় করে। আনন্দমোহনের বাকি তিন ছেলে ভালো মানের অফিসে চাকরি করছেন। বাবাকে কিছুদিন পরপর উপহার পাঠাচ্ছেন। সফলতাই আনন্দমোহনের কাছে জীবনের অন্যতম অর্থ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তার কাছে কাজটাই প্রধান হিসেবে পরিগণিত। তিন ছেলেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এছাড়া তিনি নিজেও সৎভাবে উপার্জন করে, চাকরি করে সফল ব্যক্তি হয়েছেন।
কিন্তু তার এই ছেলেটি, অর্থাৎ প্রতাপ আসলেই মেধার পরিচয় দিচ্ছিলেন বাবার প্রতিটি কথার একেকটি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে। বাবাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হবে শোনার পরেই তার প্রতিক্রিয়া ছিলো ভয়ংকর-
“নো, নো, নো ,নো ,নো……………… বাবা, বাবা,
বাজ পড়লো, বটগাছে, চোখের সামনে।
তৈরি থেকো”
পরে দেখা যায় আসলেই আনন্দমোহন তাকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তিনিই তার পরিবারের বটগাছ। প্রশান্তের সেই প্রতিক্রিয়া বাস্তবে পরিণত হয়। এখানে পরিচালক রেখে গেছেন রহস্য। আসলেই প্রশান্ত ভবিষৎবাণী করেছিলেন?
‘Work is worship. বা কর্মই সাধনা।
Honesty is the best policy’ বা সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
এই দু’টো অতিপ্রাচীন ইংরেজি প্রবাদে বিশ্বাস করতেন আনন্দমোহন। তার সফলতার মূল কারণও এই দু’টো প্রবাদ। মুখস্থ করে রাখা এই প্রবাদগুলো বারবার বলতে বলতে একসময় মুখকে বিকৃত করে ফেলেন প্রশান্ত। একধরনের অনীহা প্রকাশ করেন, কিংবা দুঃখ। আসলে এ ধরনের প্রবাদগুলো এখন আর আমাদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার চিন্তা করে না কেউ। এগুলো স্থান পায় বইয়ের পাতায়, পরীক্ষায় খাতায় কিংবা ভাইভা বোর্ডে। এই আক্ষেপ থেকেই তার এই প্রতিক্রিয়া। তার বাবা যখন বলছিলেন, তিনি কখনোই মানতে রাজি নন যে, একটা লোক যদি সৎ থাকতে চায়, তাহলে সে সৎ থাকতে পারে না।
এই কথা শেষ হবার আগেই আরেকবার অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখান প্রশান্ত। একটানা বলতে থাকেন ‘জিরো, জিরো, জিরো, জিরো, জিরো………………’। অর্থাৎ এই কথাগুলো এখন ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার বাবা এটা বোঝেন না। কিন্তু ছেলে ঘরে বসেই সব বুঝতে পারেন। আসলেই আজকের যুগে কেউ সৎ করতে চাইলেও সৎ থাকতে পারেন না।
এদিকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আনন্দমোহনের হার্ট অ্যাটাকের পরেই কাট শটের মাধ্যমে দেখানো হয় তার এক ছেলে প্রবীর ড্রিংকসের গ্লাসে বরফ নিচ্ছেন। বড় ভাইয়ের কাছে বাবার হার্ট অ্যাটাকের কথা শুনে প্রথমেই জানতে চান, বাবা মারা গেছেন কিনা? শুরু থেকেই পরিচালক দেখিয়েছেন প্রশান্ত বাদে আনন্দমোহনের অন্য ছেলেদের মনোভাব কেমন। পরিচয় করিয়েছেন তাদের কথাবার্তা এবং মানসিকতার সাথে।
বাকি ছেলেরা সবাই বাড়িতে আসেন অসুস্থ বাবাকে দেখতে। এসে ৯৩ বছর বয়সী পিতামহের সাথে দেখা করারও প্রয়োজনবোধ করেননি। তাকে উল্লেখ করেন একজন ‘ইউজলেস এক্সিস্টেন্স’ হিসেবে। আসার পরদিন ছেলে, ছেলের স্ত্রীরা এবং নাতি ডিঙ্গু দেখা করেন আনন্দমোহনের সঙ্গে, যে ঘরে তার চিকিৎসা চলছে- সে ঘরে। কিন্তু প্রতাপ দেখা করতে যাননি। এখানে একটি বিষয় দৃশ্যমান যে, কতদিন এখানে থাকতে হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন বড় ছেলে এবং তৃতীয় ছেলে। চলে যাওয়ারও প্রস্তাব দেন তৃতীয় ছেলে প্রবীর। তবে কিছুদিন সেখানেই থাকতে হয় তাদের। বাবার প্রতি তাদের উদাসিনতার এখানেই সূচনা।
তাদের বাড়িতে থাকা অবস্থানেই মূলত পরিচালক ‘শাখা প্রশাখা’ বিস্তার করা শুরু করেন। ছোট ছোট সংলাপ এবং তর্ক-বিতর্ক এই সিনেমার মূল নির্যাস দিতে থাকে। বাড়িতে আসার পর সবচেয়ে নীরব থেকেছেন সবার ছোট ভাই প্রতাপ। এর অন্যতম কারণ শুধু তার বাবার অসুস্থ হয়ে যাওয়া নয়। তার ১০ বছরের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এত ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারটা তিনি কাউকেই বলতে পারছেন না। তার বাবা চাইতেন তার সন্তানেরা ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। প্রতাপের বড় ভাইরা সবাই (প্রশান্ত ব্যতীত) ভালো চাকরি করেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বললে তার পরিবারের অন্যরা সেটি মেনে না-ও নিতে পারেন। তাই সেটি বলেননি তিনি।
“হাল বদলে গেছে, হাওয়া বদলে গেছে। তোর বাপের আদর্শ আজকের দিনে চলে না। আমরা যেটা করছি সেটাই আজকের নীতি, আজকের রীতি”
তবে প্রতাপ চাকরি ছেড়ে দেয়ার অন্যতম কারণ, তার পরিচিত ভালো মনের একজন মানুষ রমেনদা অফিসের আরেক কলিগের সাথে মিলে বিরাট জোচ্চুরি করেছেন। সেটির প্রমাণ পেয়েছেন প্রতাপ। তিনি যাকে নিজের অন্যতম একজন আদর্শ মানতেন, বড় ভাই মানতেন, সেই রমেনদা কোনো কাস্টমারের পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সেইসাথে তিনি আরও বলছেন প্রতাপের বাবার সৎ থাকার জীবনটা আজকের যুগে আর চলে না। তারা যা করছেন, সেটাই আজকের যুগের আদর্শ।
সিনেমার সবচেয়ে মূল দৃশ্যটি হলো- খাবার টেবিলে বসে সবার একসাথে খাওয়ার সময়ের আলাপ-আলোচনাটি। যেখানে বেরিয়ে আসে তাদের দুই ভাই বড় ভাই প্রবোধ মজুমদার এবং তৃতীয় ভাই প্রবীর মজুমদারের খোলস। জুয়া, রেস এবং ব্যবসার আয় নিয়ে ছোটভাই প্রবীরকে জিজ্ঞাসা করছিলেন বড়ভাই প্রবোধ মজুমদার। এসময় এগুলো নিয়ে বিস্তারিত বলেন প্রবীর। তার ছেলে ডিঙ্গু তখন খাবার টেবিলে থেকে বেশি দূরে নয়। বাবা, চাচাদের আলাপ মনোযোগ সহকারে শুনছে সে। সে শুনতে পায় তার বাবা বলছেন,
“কারচুপি শুধু ব্যবসাতেই হয় না। প্রত্যেক লেভেলে, প্রত্যেক প্রফেশনে হয়। দুনম্বরি ছাড়া আজকাল কেউ মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, ইমপসিবল”
“যারা অনেস্ট থাকতে চায় তারা রসাতলে তলিয়ে যায়”
“তুমি একটা বড় কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার, আমি একজন ব্যবসাদার। আসলে কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। দুজনেই দুনম্বরির জোরে ফুটানি করে বেড়াচ্ছি”
কথার এক পর্যায়ে প্রবীরের আয় সৎ উপায়ে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন বড়ভাই প্রবোধ। তখন রেগে গিয়ে বড় ভাইয়ের আয়ের উৎসও দুনম্বরি বলে জানান প্রবীর। সেটির বাস্তব প্রমাণও দেখান তিনি। প্রবোধের হাই স্ট্যান্ডার্ড জীবনযাপনই প্রমাণ করে তিনি তার আয়ের বাইরেও ভিন্ন উপায়ে আয় করেন।
কথাগুলোর মাঝখানে একটু পরপরই পরিচালক ক্যামেরায় দেখাচ্ছিলেন ছোট্ট বাবু ডিঙ্গুর আগ্রহ। সিনেমার নামের সাথে তখন যথার্থতা মিলিয়ে দেখতে থাকেন দর্শক। শাখার কালো ছায়া প্রশাখার দিকেও ধাবিত হচ্ছে। সেটি তাদের অল্প বয়সেই দেখা যায়। অর্থাৎ শুরু থেকেই দু’ নম্বরির সাথে পরিচিত হতে থাকে তারা। যা সমাজের ভিতরে সূচ হয়ে প্রবেশ করে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসবে। কেননা আলবার্ট বান্দুরার ‘সামাজিক শিক্ষণ’ তত্ত্ব অনুযায়ী এই শিশুদের মানসিক অবস্থা তৈরি হয় তার পারিপাশ্বিক অবস্থা দেখে, শুনে, বুঝে। ফলে কার্যত ডিঙ্গুর ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে, তা এখান থেকেই পরিচালক বুঝিয়ে দেন।
এখানে চমৎকার এক প্রতিবাদের দৃশ্য দেখান পরিচালক। এই আলাপের সময় মানসিকভাবে দুর্বল প্রতাপ টেবিল চাপড়ে জোরে জোরে আওয়াজ করছিলেন। শব্দ করে তার এই প্রতিবাদ যেনো তার ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ। আর এটি তো তার নয়, সমাজের ক্ষোভেরও একটি প্রতিফলন। এই সিনেমার এমন প্রতিবাদের দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়বে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সেই শেষদিকের আগের দৃশ্যটা যেনো সৎ মানুষদের ভেতরের হাহাকারের দৃশ্য। তারা কী ভাবছেন, কত সহজ ভাবছেন? আর দুনিয়াটা তাদের চিন্তা থেকে কত দূরে চলে গেছে। আনন্দমোহনের সৎ আদর্শে চপেটাঘাত করেছে তার দুই সন্তানের আদর্শ। এর চেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে তার প্রশাখাও শুরু থেকেই এই অসৎ এবং দু’ নম্বরি আদর্শের সাথে পরিচিত হচ্ছে। পরম এই আক্ষেপের ব্যাপারটি তাকে ফের অসুস্থ করে ফেলে।
“তুইই আমার সব রে প্রশান্ত, তুইই আমার সব”
তাকে দেখতে আসা সবাই যখন চলে যায় তখন ভেতরটা আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে আনন্দমোহনের। তার সততার এত মহান গল্প, এলাকার মানুষ রীতিমতী তাকে পুজো করে। কিন্তু সেই তারই প্রশাখা এখন পরিচিত হচ্ছে দু’ নম্বরির সাথে। তার অন্যতম সুখের জায়গা সন্তানদের চাকরি কিংবা কর্মক্ষেত্রও তার সৎ চিন্তার মতো আর নেই। তারা জড়িয়ে পড়েছেন দু’ নম্বরি বা দুর্নীতির সাথে, যেটি ছিলো তার পরম ঘৃণার বস্তু।
কিন্তু তার সুখের জায়গা এখনও আছে, বাড়িতে কার্যত মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকা তার দ্বিতীয় সন্তান প্রশান্ত। শেষমেশ তার হাতেই নিজের সততার আশ্রয় পান তিনি। এখানে চমৎকার রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন পরিচালক। সততা আজ তথাকথিত সফল ব্যক্তিদের জীবনে বিরাজ করে না। এটি বিরাজ করে সমাজের ব্রাত্যদের মধ্যে। আরেকভাবে বলা যায়, সততা আজ অনেকটাই পঙ্গু। সে আশ্রয় খুঁজে বেড়াই এখানে সেখানে। তথাকথিত সমাজে তার জায়গা হয় না। এই অবস্থায় সান্ত্বনা শুধু সমাজে যেকোনোভাবেই হোক টিকে থাকা। সততা টিকে থাকলেও সেটি আনন্দমোহনের ছোট ছেলের মতো যেকোনো সময় প্রতিবাদ করতে পারবে।
বরাবরের এই সিনেমাতেও নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন প্রত্যেকটি চরিত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী যে চরিত্রটি রূপদান করেছেন, তা যথার্থ ফুটে উঠেছে। তার চরিত্রটি ছোট্ট হলেও, সংলাপ কম থাকলেও চুপ করেও মূল প্রতিবাদটা তিনি সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। এছাড়া মমতা শঙ্করের অভিনয় ছিলো বরাবরের মতোই ভালো। দীপঙ্কর দে মনে হয় এমন চরিত্রের জন্যই অভিনয় জগতে এসেছেন। জটিল চরিত্রে তাকে ভালো মানিয়েছে, সংলাপই এর প্রমাণ।
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে এই সিনেমায় একটি ব্যাপারে অবশ্যই আলাদাভাবে বলতে হবে। ‘শাখা প্রশাখা’ সিনেমায় সত্যজিৎ রায় বাখ এবং গ্রেগরিয়ান মিউজিক ব্যবহার করেছেন। এগুলো দর্শকদের মধ্যে আলাদা আবহ তৈরি করে। এছাড়া প্রশান্ত চরিত্রের সাথেও খাপ খায়। ফলে এদিক থেকে মিউজিকেও অনন্য ছিলো ‘শাখা প্রশাখা’।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/