৭৪ তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গ্র্যান্ড জুরি প্রাইজ সিলভার লায়ন জয়ের পরে ইসরায়েলের সংস্কৃতিমন্ত্রী মিরি রিগেভ এবার আরও ফুঁসে উঠলেন। নিজ দেশের ফিল্মকে দেশবিরোধী চক্রান্তের অংশ, এবং ইসরায়েলবিরোধী আখ্যান নির্মাতা হিসেবে ডিরেক্টর স্যামুয়েল মাওজকে অভিযুক্ত করলেন। জবাবে মাওজ বলেন, “If I criticize the place I live, I do it because I worry. I do it because I want to protect it. I do it from love.”
২০১৭ সালের স্যাভেজ স্যাটায়ার ফক্সট্রট ইসরায়েলের চলচ্চিত্র ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক সংযোজন। কাহিনির গভীরতা এবং বর্ণনার কৌশলের দিক থেকে ছবিটি প্রণিধানযোগ্য। এর আগে লেবানন নামে আরেক চলচ্চিত্র স্যামুয়েল মাওজকে এনে দিয়েছিল বিচক্ষণ নির্মাতার সুখ্যাতি। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি আবারও প্রমাণ করলেন নিজেকে। কাহিনির উৎকণ্ঠা ধার করলেন তার মেয়ের সাথে স্কুলজীবনে ঘটা পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে। আর প্লট সাজালেন ইসরায়েলের আর্মি তথা আইডিএফ (Israel Defense Forces) বাহিনীকে নিয়ে। এমন প্লট বাছাইয়ের কারণ হিসেবে বলা যায়, তাদের দেশের বেশিরভাগ নাগরিকই তারুণ্যের বছরগুলো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নষ্ট করে।
ড্রামা ফিকশন ঘরানার এই সিনেমার পেসিং নিয়ে কথা উঠতে পারে। অত্যন্ত স্থবির রূপক প্রকৃতি কিংবা চলচ্চিত্রের রাজনীতি নিয়েও সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু গল্পের সাবলীলতা আর কারিগরির কারিকুরি দিয়ে ফক্সট্রট তার সকল অভিযোগ আর সমালোচনাকে অসাড় প্রমাণের সক্ষমতা রাখে। মাওজ একটি ব্যক্তিগত সংকটের গল্প বলেছেন। পারিবারিক ট্র্যাজেডি গল্পের ফক্সট্রট হয়ে ওঠে অনবদ্য ফিলোসফিক্যাল পাজল। কারণ তিনি এমন একটি দেশের প্রকৃতিও উন্মোচিত করেছেন, যার নৈতিক সংকট সেই ব্যক্তিসংকটের চেয়ে কম গুরুতর নয়। এর কাহিনিকে মূলত তিনটি চ্যাপ্টারে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথম সিকুয়েন্সে, তেল আবিবের অভিজাত মাইকেল এবং ড্যাফনা ফেল্ডম্যান দম্পতি জানতে পারেন, তাদের ছেলে জোনাথন আইডিএফে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেছে। বাসায় আগত আর্মিদের থেকে মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্রই মা মূর্ছা যান। আর বাবা হয়ে পড়েন স্তম্ভিত, বিচলিত, হতবিহ্বল। অথচ ঐ মুহূর্তেই মাইকেলের সাথে শেষকৃত্য ঘিরে সরকারি আনুষ্ঠানিকতা আর পরিকল্পনার কথা শেয়ার করা হয়। এ অংশে হিউমারের সুপরিকল্পিত প্রয়োগ দৃশ্যত হয়। সৈন্যদের মূল্যহীন জীবন ও রাষ্ট্রের দায়সারা আচরণ লক্ষ্য করা যায় গিওরা বেজাজের টাইট কম্পোজিশনে। আর্মির এক সদস্য জোনাথনকে স্টাফ সার্জেন্ট সম্বোধন করায় বাবা বিস্মিত হয়!
He’s a corporal, not a staff sergeant!
He was promoted after death. A privilege for fallen Israeli soldiers.
এমতাবস্থায় মাইকেল মৃত সন্তানের লাশ দেখতে চায়। কিন্তু তারা নিয়মনীতির অজুহাতে লাশ দেখানোয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আপত্তির কথা বলে। উপরন্তু, আর্মির স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় একে অপ্রয়োজনীয় বলেও উল্লেখ করে। ক্ষুব্ধ বাবা তখন আগত অফিসারদের ভর্ৎসনা করে বলে,
A father wants to see his son before burial. How’s that unnecessary?
নিজ অতীত অভিজ্ঞতায় তিনি তখন সন্দেহ প্রকাশ করেন—
Will, he be in the coffin or only bricks?
So I feel like I’m carrying something
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় সৈন্যদের হিতাহিত জ্ঞান নিয়ে এরকম মুহুর্মুহু হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন মাওজ।
“You could play a song that he liked
we have a great sound system.”
তার কিছুক্ষণ পরে খবর আসে তাদের ছেলে জোনাথন ফেল্ডম্যান মারা যাননি, একই নামে অন্য আরেকজন মারা গেছেন। কিন্তু এতকিছুর পর তাদের নাটকীয়তায় বিশ্বাস করেন না মাইকেল। অবিশ্বাসী মন আর্জি জানায়,
I demand you bring me back my son!
Not tomorrow but immediately.
জমাট গল্পের লেয়ারে ফক্সট্রটের কারিগরি দিকগুলো আরও বেশি দুর্দান্ত, চমকপ্রদ, অভিনব, এবং নান্দনিক। অজস্র অস্বস্তিকর ক্লোজ-আপ এবং মাইকেলের অস্থিরতা দেখানোতে ওভারহেড সার্কুলার শটের বিস্তর ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। অনুরূপ, বার্ডভিউতেও বিষয়বস্তুকে উপর থেকে দেখতে চাওয়ার প্রবণতা নজরে পড়ে। সামগ্রিকভাবে, পুরো মুভির ব্যকগ্রাউন্ডে নৈঃশব্দ্য প্রাধান্য পেয়েছে। পারিবারিক উৎকণ্ঠা থেকে আকস্মিক জাম্প কাটে দ্বিতীয় অংশে পদার্পণ করে কাহিনি। তাতে দেখা যায়- জনশূন্য নির্জন ফাঁড়িতে জোনাথন এবং অন্য তিন সৈন্য একটি চেকপয়েন্ট পরিচালনা করছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই পর্বের গল্প ভূমি থেকে কয়েক ইঞ্চি ঊর্ধ্বে দোদুল্যমান। এবং দিনে দিনে তা ক্রমশ একদিকে কাঁত হয়ে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। শুনতে যাচ্ছেতাই লাগলেও আদতে তা-ই। ধীরে ধীরে তাদের যে অস্থায়ী বাসস্থান, তথা কন্টেইনার, সেটিকে প্রকৃত অর্থেই আস্তে আস্তে হেলে পড়তে দেখা যায়। দর্শকদের এটা বোঝাতে স্ক্রিনটাইমে সময়ের সাথে সাথে সিনেমাটোগ্রাফিক ফ্রেমিংয়ে কোণের প্রসারণ বাড়িয়ে কাজটি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন টেকনিকের অবতারণা করেছেন আরিক লাহাব লেইবোভিচ এবং গাই নেমেশ।
তবে এ অধ্যায়টি ইসরায়েল রাষ্ট্রের জেনোফোবিক মানসিকতার স্বরূপ উন্মোচন করে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। চেকপোস্টে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের হেনস্তার মাধ্যমে আর্মিদের অসংবেদনশীল আচরণকে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে আলাদা করে দুটি দৃশ্যের কথা বলা আবশ্যক। বৃষ্টিস্নাত রাতে বৃদ্ধ এক দম্পতিকে পাহারারত আইডিএফ সৈন্যরা গাড়ি থেকে নামিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করায়। বৃষ্টিতে ভিজে মহিলার চুল ও মেকআপ নষ্ট হয়ে যায়। নির্বাক কান্নায় পার্স মাটিতে ফেলে দিয়ে জিনিসপত্র খালি করে দেখিয়েও নিস্তার মেলে না তার। বৃষ্টিতে কাকভেজা হতে থাকার মধ্য দিয়ে পরিচালক মাওজ অসহায়ত্বকে দারুণ দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন। আবার, আরেক রাতের ঘটনায় প্রাণোচ্ছ্বল চার ফিলিস্তিনিকে চেকিংয়ের সময় বিয়ার ক্যানকে গ্রেনেড মনে করার ভুলে জোনাথনের হাতে খুন হতে হয় নিরীহ চার তরুণ-তরুণীকে। সেই রাতের পরে জোনাথন এ দুর্ঘটনার পাপবোধ আর অনুশোচনায় পোড়ে।
ফক্সট্রটের সবচেয়ে উপভোগ্য এবং ইতিবাচক দিক হলো এর সংলাপ। হিউমারে ঠাঁসা কৌতূহলোদ্দীপক নানা সংলাপ আছে সিনেমাতে। জোনাথন যেবার সত্যিই মারা গেল, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠি পড়ে মাইকেল এবং ড্যাফনা ফেল্ডম্যান দম্পতি দুজনেই অফিসিয়াল ভাষার ব্যবহার নিয়ে রসিকতা জুড়ে দিলেন।
You are invited to the unveiling ceremony in honor of your son,
Sgt Jonathan Feldman fallen in the line of duty…
ড্যাফনা পড়তে পড়তে হাসেন,
Fallen? Not died, not killed. God forbid!
জোনাথন কখন কীভাবে মারা গেল, তা জানতে হলে দেখতে হবে মুভির শেষ অবধি। ফক্সট্রটের অজানা অনেক প্রশ্নেরও উত্তর মিলবে তখন। ছয় মাস পর মাইকেল এবং ড্যাফনা তাদের ছেলের বিশতম জন্মদিনে পুনরায় একত্রিত হয়। ততদিনে ছেলের মৃত্যু ভুলে গিয়ে পুনরায় তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে। কিন্তু স্মৃতি পিছু ছাড়তে চায় না। নিজেদের কৃতকর্ম আর অতীতই যেন বার বার ফিরে ফিরে আসে। ছবি আঁকায় পারদর্শী জোনাথনের চিত্রকর্ম নিয়ে চমৎকার কিছু মেটাফোর রয়েছে ড্রামা ফিকশন এই সিনেমায়। সাথে আছে অসাধারণ অ্যানিমেশনের কাজ। কমিক বুকের মতো করে গল্প বলে গেছে। সেই গল্পে রয়েছে ফ্লাশব্যাকের আভাস।
নামকরণ নিয়ে শেষে দুয়েকটি তথ্য উল্লেখ করি। ফক্সট্রট মূলত প্রচলিত একটি নাচের ফর্ম, যাতে পারফর্মারদের শুরু ও শেষের অবস্থান অভিন্ন থাকে। হিব্রু ভাষার এই সিনেমাতেও আদতে তা-ই ঘটে। প্রারম্ভে দেখানো একটি সরু, জরাজীর্ণ মরুভূমির রাস্তায় চলমান সামরিক যানের ঐ একই দৃশ্যে ইতি টানা হয়। উল্লেখ্য, ৯০তম অস্কারে ছবিটি বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে শর্টলিস্টেড হয়।
চলচ্চিত্র: פוֹקְסטְרוֹט (Foxtrot)
সাল: ২০১৭
পরিচালক: স্যামুয়েল মাওজ
জনরা: ড্রামা ফিকশন