যুদ্ধ আর নৃশংসতা বর্তমানে আমাদের পৃথিবীকে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। প্রতিদিনই বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তের হানাহানির খবর দেখা যায় টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। আর এমন বর্বরতা দেখতে দেখতে আমরাও যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷ এই অভ্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে, নতুন কোনো ভয়াবহতার খবরে আমরা আর সমবেদী হই না। বরং সে ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ না করে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
চোখের সামনে যদি প্রতিনিয়ত বৃহৎ পরিসরে অত্যাচার, সংঘাত আর মৃত্যুর মতো ঘটনা দেখি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা নিজের পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের বাঁচাতে চেষ্টা করব। মানব চরিত্রের এই সহজাত বোধ আমাদেরকে আজকের আলোচ্য সিনেমার মূল চরিত্রের সাহসিকতার মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে সহায়তা করবে।
গল্পের প্রেক্ষাপট ১৯৯৪ সাল, যখন পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় সংঘটিত হয় সর্বকালের অন্যতম নির্মম গণহত্যা। পশ্চিমা বিশ্ব তখন রুয়ান্ডার জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তাদের কানে পৌঁছায়নি নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ। যার ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দেশটির হুতু জনগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ দিতে হয় আট লক্ষেরও বেশি তুতসি জনগণকে। জাতিসংঘ সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকায় উপস্থিত ছিল। কিন্তু গণহত্যা রুখতে সরাসরি কোনো ভূমিকা নেয়নি।
এই গণহত্যা নিয়ে পরিচালক টেরি জর্জ নির্মাণ করেছেন ‘হোটেল রুয়ান্ডা’। সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রেও সংযুক্তি ছিল তার। এখানে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন নৈতিকতার উপর। পাশাপাশি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, যখন ঘাতকেরা রুয়ান্ডার নারী, পুরুষ এবং শিশুদের রক্ত নিয়ে হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল; তখন কেমন নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করেছে পশ্চিমা শক্তি। যখন তিনি এই প্রজেক্টের কাজ করছিলেন, তখনও আফ্রিকার দারফুর অঞ্চলে মানবতা মাথা কুটে মরছিল।
তাই এমন জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা বাহবা তিনি পেতেই পারেন। তার হয়তো আশা ছিল, হোটেল রুয়ান্ডা দর্শকদের হৃদয়ে কম্পন তুলবে। তারাও হয়তো মানবতাবাদী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে গলা মিলিয়ে আফ্রিকায় বছরের পর বছর ধরে চলমান এসব সংঘাত নিরসনে বিশ্বের হর্তাকর্তাদের বাধ্য করবে। এই আশার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, সেটা পাঠক বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
হতাশার কথা বাদ দিয়ে আসুন গল্পের দিকে তাকাই। পল রুসেসাবাগিনা (ডন চিডল) রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির হোটেল ডা মিলেস নামক একটি চার তারকা হোটেলে ম্যানেজার পদে চাকরি করেন। তিনি নিজের চাকরির ব্যাপারে গর্বিত এবং কাজকর্মে বেশ দক্ষ। হোটেলের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন এবং প্রতিষ্ঠানের ধনী গ্রাহকদের সকল চাহিদার ব্যাপারে খেয়াল রাখেন। কাজের প্রতি তার ভালোবাসার পরিচয় দর্শকরা পাবেন তার আচার-আচরণে। বিশেষ করে তখন, যখন তিনি কোট-টাই পরে ধোপদুরস্ত হয়ে হোটেলে আসার জন্য প্রস্তুতি নেন। সরকারি এবং সামরিক কর্তাব্যক্তিদের সামলানোর ব্যাপারেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাদের হাতে রাখার জন্য এবং গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে কালোবাজার থেকে তামাক আর মদের যোগানও তিনি নিজেই করে থাকেন। যার কারণে তার বেলজিয়ান বস তাকে খুব পছন্দ করেন।
নিজের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল তিনি। তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক এটা বোঝে যে বহুকাল ধরে চেপে রাখা অসন্তোষ, ক্রোধ, ঘৃণা এবং ভয় দেশের দুটি গোষ্ঠীকে পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে। একটি জনগোষ্ঠীর নাম তুতসি, যাদের উপনিবেশবাদী বেলজিয়ানরা পছন্দ করত। অপরটি হুতু, বর্তমানে তারাই রুয়ান্ডার ক্ষমতায় আসীন। দেশের সকল নাগরিকের কাছে একটি করে পরিচয়পত্র আছে। তাতে লেখা আছে, সে কোন গোষ্ঠীর সদস্য। এই বিদ্বেষের সূত্রপাত খুবই তুচ্ছ একটি ব্যাপার নিয়ে। তুতসিরা গাত্রবর্ণের দিক থেকে হুতুদের থেকে খানিকটা পরিষ্কার। আর এ কারণেই বেলজিয়ানরা তাদের পছন্দ করত। এই ঘটনার ঘনীভূত ক্ষোভের ফলাফল কতটা ভয়াবহতা হাজির হয়, তার প্রমাণ বিশ্ববাসী পায় ১৯৯৪ সালে।
একসময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও স্টেশন এই ঘটনার দায় চাপায় তুতসিদের উপর। শুধু দায় চাপিয়েই থেমে থাকেনি, পাশাপাশি দেশের জনগণকে আহবান করেছে এমন ‘তেলাপোকা’দের বংশ নির্মূল করে দিতে।
পল জাতিতে একজন হুতু আর তার স্ত্রী তাতিয়ানা (সোফি ওকোনেডো) তুতসি। যেদিন রেডিও স্টেশন থেকে যুদ্ধের ফরমান জারি করা হয়, সেদিন সন্ধ্যায় পল দেখতে পান ট্রাকের পর ট্রাক সৈন্য এসে তাদের এলাকায় অবস্থান নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে তারা তাদের ছেলেকে খুঁজে পান এক ঝোপের ভেতর। সে ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে, তার কাপড়চোপড়ে রক্তের দাগ।
আকস্মিকভাবেই হুতু মিলিশিয়া বাহিনী চাপাতি নিয়ে তুতসি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। এমতাবস্থায় পল প্রথমে কেবল নিজের পরিবারকে রক্ষা করবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু তার স্ত্রী ভীতসন্ত্রস্ত প্রতিবেশীদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে রাজি করান তাকে। তিনি সবাইকে নিয়ে চলে যান নিজের হোটেলে। হোটেলটি খালিই পড়ে ছিল। কারণ যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এখানকার গ্রাহকরা রুয়ান্ডা ছেড়ে চলে যায়।
প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষেই পরিচিত লোক আছে পলের। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে তিনি ঐ বন্ধুদের কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হুতু বাহিনীর এক রাগী সদস্য হোটেলে এসে পলকে বলে, কোনো তুতসি থাকলে তার হাতে তুলে দিতে। পল তাকে কোনোমতে ঘুষ দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেন। কেননা, কিছুক্ষণ আগেই এক সাহসী রেডক্রস কর্মী (কারা সিমুর) একদল এতিম তুতসি বাচ্চাকে হোটেলে নিয়ে এসেছে তাদের জীবন রক্ষা করতে। হোটেলে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে পলের ধারণা ছিল না।
তাকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এক পশ্চিমা সাংবাদিকের (হোয়াকিন ফিনিক্স) ধারণ করা একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায়, তাদের অবস্থান থেকে অদূরে অবস্থিত একটি রাস্তায় সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞ। হতভম্ব হোটেল ম্যানেজার তখন বলেন, এই ভিডিও দেখালেই তো সাহায্য আসবে! শক্তিশালী দেশগুলো এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে এগিয়ে আসবে। কিন্তু সাংবাদিককে তার মতো আশাবাদী হতে দেখা যায় না। তিনি বলেন, মানুষজন এই ভিডিও দেখে একটু সহমর্মী হয়তো হবে। তবে পরক্ষণেই আবার সব ভুলে নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
একপর্যায়ে আমরা পলকে এক কালোবাজারির কাছে প্রয়োজনীয় রসদ আনতে যেতে দেখি। উক্ত কালোবাজারি গণহত্যার সমর্থক। রসদ আনতে গেলে নদীর পাশের রাস্তাটি ব্যবহার করা নিরাপদ বলে পলকে জানান তিনি। কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশেই ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ম্যানেজার। এ সময় তার ট্রাক উঁচু-নিচু পথে যাচ্ছে বলে মনে হয়। পরে দেখা যায়, এগুলো আসলে রাস্তার উপর পড়ে থাকা শত শত তুতসির লাশ। এসব লাশের উপর দিয়ে চলার কারণে ট্রাকে ঝাঁকি লাগছিল! এসব দেখে মানসিকভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খান তিনি। হোটেলে এসে টাই বাঁধতে পর্যন্ত ভুল হয় তার। হতাশা আর বিহ্বলতায় তাকে মেঝেতে পড়ে যেতে দেখি আমরা।
রুয়ান্ডায় জাতিসংঘের বাহিনীর কানাডিয়ান কমান্ডার কর্নেল অলিভার (নিক নল্টি)। এখানে চলমান গণহত্যার ব্যাপারে বিশ্ববাসীর উদাসিনতা তাকে ক্রোধান্বিত করে তোলে। একসময় তিনি পলকে বলেন, পশ্চিমাদের কাছে পল আর তার হোটেলে আশ্রয় নেওয়া লোকদের জীবনের কোনো দাম নেই। তাদের চোখে তারা ধুলার মতো নগণ্য। তারা এসব নগণ্য মানুষের জন্য আফ্রিকার কোনো বিষয়ে নাক গলাতে চায় না।
সিনেমার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর একটির অবতারণা হয় যখন আটকে পড়া বিদেশীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার কাজ তদারক করে জাতিসংঘ। হোটেলের বন্দিত্ব থেকে আফ্রিকানরা দেখতে পায়, সৌভাগ্যবান সাদা চামড়ার মানুষেরা বাসে উঠছে। শীঘ্রই তারা চলে যাবে এই নরক থেকে। যখন পাদ্রীরা কিছু আফ্রিকান শিশুকে নিয়ে আসেন, তখন বলা হয়, কেবল শ্বেতাঙ্গদেরই নিয়ে যাওয়া হবে।
এই দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে একটুও ছাড় দেননি টেরি। কোনো রাখঢাক ছাড়া তুলে ধরেছেন শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-গরিবের মধ্যে বিদ্যমান অতলস্পর্শী পার্থক্যকে। কারো সবকিছু আছে, আছে মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেঁচে ফেরার সুযোগ। পক্ষান্তরে অন্যদেরকে যেতে হবে নির্মম, ভয়ংকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে। তারা বাঁচল কী মরল, তাতে কারো কিছু যায় আসে না।
জনরার দিক থেকে যুদ্ধ/ড্রামা ধারায় পড়লেও এখানে সরাসরি যুদ্ধ বলতে গেলে দেখানোই হয়নি। তথাপি ঐ বছরের সবচেয়ে সেরা সিনেমাগুলোর একটি হওয়া থেকে একে কেউ রুখতে পারেনি। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব যাবে টেরি জর্জ আর ডন চিডলের ঝুলিতে। এখানেই সম্ভবত ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় করেছেন চিডল। নায়কোচিত ম্যানেজার, যে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে প্রদর্শন করেছে অসীম সাহসিকতা আর অপরিসীম মমত্ববোধের; এই পল চরিত্রে তার নৈপুণ্য অনবদ্য। সংকটকালীন পরিস্থিতেও সবার কথা ভাবা, স্বার্থপর না হওয়া, ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটা- এসব গুণ তাকে করেছে মহিমান্বিত।
বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, যেমন – কর্নেল অলিভার, স্থানীয় পুলিশ প্রধান, হোটেলের বেলজিয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে তাকে ঘৃণা করা হোটেলের কর্মী, কালোবাজারি বা ঘাতক মিলিশিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে তার মিথস্ক্রিয়া; পল চরিত্রে এনেছে পরিপূর্ণতা। এত বিপদ সত্ত্বেও অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা প্রদর্শনের মাধ্যমে ম্যানেজারের দায়িত্ব ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন মানবতার বাতিঘর। পলের স্ত্রী চরিত্রে সোফির অভিনয়ও ছিল হৃদয়গ্রাহী।
পলকে ডাকা হয় ‘আফ্রিকান শিন্ডলার’ নামে। কিন্তু কেবল এই ডাকনামের দ্বারা স্বজাতির প্রতি তিনি যে গভীর মমত্ববোধ প্রদর্শন করেছেন, নিঃস্বার্থভাবে তাদের সেবা করেছেন, তার অসাধারণত্ব প্রকাশ করা যাবে না। হোটেল রুয়ান্ডা অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠায় ভরা একটি সিনেমা। টেরি জর্জ পদে পদে দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পল নিজের এবং নিজের প্রিয়জনদের জীবন বাজি রাখছেন অন্যদের জন্য।
এদের মধ্যে কেউ কেউ তার প্রতিবেশী; কিন্তু অন্যদের অধিকাংশকেই তিনি আগে কখনো দেখেননি। এখানে দেখানো হয়েছে সংকটে পড়া মানুষের জন্য প্রবল সহানুভূতি, যা খুব বেশি সিনেমায় দেখা যায় না। বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ পৃথিবীর সকল অনাচারের ব্যাপারে জেনেও পল তার বিরুদ্ধে গেয়ে যান মানবতার অবিনাশী গান। তার গলায় জমে ওঠা ক্ষোভের দলা বের হয়ে আসে এভাবে,
“আর কত মানুষ খুন হলে আপনারা তাকে গণহত্যা বলবেন?”
স্কট এ. হান্ট তার ‘ফিউচার অব পিস’ গ্রন্থে বলেছেন,
“আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়েও, অসামান্য চরিত্রের ব্যক্তিত্বরা আমাদের মাঝে ছিলেন, দেখিয়েছেন শোচনীয় ঘৃণা এবং অগ্রাসনের চক্র থেকে মুক্তি অর্জনের পথ। তারা এখনও আছেন। এসব মানুষের কাছেই আমরা আবার নিজেদের সাহস, আশা এবং অনুপ্রেরণায় পরিপূর্ণ করার জন্য যেতে পারি।”
এমনই একজন অসামান্য চরিত্রের অধিকারী পল রুসেসাবাগিনা, যিনি তার হোটেলে আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ১,২৬৮ জন আফ্রিকানের প্রাণ। আর সেই বাস্তব চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত সিনেমা ‘হোটেল রুয়ান্ডা’।