জাপানি শব্দ 生きる(Ikiru)-র ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় To Live। বাংলা করলে দাঁড়ায় বেঁচে থাকা। বর্তমান বিশ্বে জীবিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭.৯ বিলিয়ন। কিন্ত, তাদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে বেঁচে রয়েছেন কয়জন? বেঁচে থাকার সংজ্ঞাটাই বা আসলে কী?
চলচ্চিত্রের শুরুতে আমরা দেখতে পাই কাঞ্জি ওয়াতানাবেকে। তিনি একজন ব্যুরোক্র্যাট, নিজের চাকরি থেকে অবসর নেবেন কিছুদিন পর। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগেই। পরিবার বলতে রয়েছে শুধু তার একমাত্র ছেলে ও ছেলের স্ত্রী, যারা কিনা শুধুমাত্র ভবিষ্যতে তার পেনশন ভোগ করার জন্য ও উত্তরাধিকার সম্পত্তি লাভ করার জন্য তার সাথে রয়েছেন।
৩০ বছর ধরে নিজের চাকরিতে তিনি এতটাই ডুবে ছিলেন যে তার কোনো বন্ধু হয়নি। বাস্তবতার সাথে ধীরে ধীরে তার সব সম্পর্কের অবসান ঘটেছে। কিন্ত, এসব নিয়ে তিনি কখনো ভাবেননি বা ভাবার প্রয়োজনও বোধ করেননি। হঠাৎ একদিন যখন জানতে পারলেন তার পেটে ক্যান্সার ধরা পড়েছে সেদিনই তিনি তার জীবনে প্রথমবারের মতো ভাবার প্রয়োজনবোধ করলেন। এর আগে তিনি বেঁচে ছিলেন সেটা বলা যায় না, বড়জোর জীবিত লাশ ছিলেন বলা যায়।
এটা প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, মানুষ জীবনে বড় কোনো ধাক্কা খেলে কিংবা জীবনের তলানীতে পৌঁছালে বদলে যায়, কাঞ্জি ওয়াতানাবেও এর ব্যতিক্রম নন। শুরুতে তিনি একজন গল্পকারের কথামতো জীবনটাকে উপভোগ করতে টোকিওর একটি নাইটক্লাবে রাত কাটালেন। সারাজীবন যেখানে একটিবারের জন্যও মদ স্পর্শ করেননি সেখানে তিনি মদ্যপান করলেন। তবে নাইটক্লাবে একরাত কাটানোর পর তিনি বুঝলেন বেঁচে থাকা এটাকে বলে না।
আমরা কাজ করার সময় ভাবার প্রয়োজনবোধ করি না। কাজ শেষে নিজের হঠকারিতার ফল যখন হাতে পাই তখনই শুধু আমাদের মনে হয়, ‘কী করলাম এ জীবনে!’ ওয়াতানাবের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়। তিনি হতাশ হয়ে পড়েন নিজের জীবন নিয়ে। চাকরি ছাড়ার জন্য তার স্বাক্ষর নিতে আসা টয়ো নামের এক হাসোজ্জ্বল মেয়ের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বুঝলেন নিজের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা করার সময় এখনো পার হয়ে যায়নি।
বাচ্চাদের জন্য পুতুল বানানো টয়োর দিকে তাকিয়ে তিনি চিন্তা করলেন একজন ব্যুরোক্র্যাট হিসেবে মানুষের জন্য তিনি কী করতে পারেন। একটি বুদ্ধি আসলো, কিছুদিন আগে একটি পার্ক তৈরির জন্য আবেদন করতে আসা একদল মহিলার কথা তার মনে পড়লো। সেই পার্ক তৈরি করাকেই তিনি নিজের বাকি জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেললেন। নানা বাধা বিপত্তি এড়িয়ে তিনি সফলও হলেন।
একে সিনেমা বললে ভুল হবে, এটাকে Poetry in motion বলা চলে। একজন ব্যুরোক্র্যাটের জীবন নিয়ে তৈরি দুই ঘন্টা তেইশ মিনিট দীর্ঘ একটি চলচ্চিত্র এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্তিকর না লাগার ক্রেডিট অবশ্যই পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়াকে দিতে হয়। প্রধান চরিত্রে থাকা তাকাশি শিমুরার অভিনয় ছিল একদম অনন্য। কুরোসাওয়া নির্মিত সর্বমোট ৩০টি চলচ্চিত্রের ২১টিতে অভিনয় করা তাকাশি শিমুরার এটা ছিল কুরোসাওয়ার সঙ্গে নবম কোলাবোরেশান। একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন, কেঞ্জি ওয়াতানাবে চরিত্রে তিনি পুরোপুরিভাবে মিশে গিয়েছিলেন। নিজের অভিনয়ের জন্য তাকাশি শিমুরা ১৯৬০ সালের বাফটা অ্যাওয়ার্ডসে সেরা বিদেশি অভিনেতা ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পান।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক রজার ইবার্ট ইকিরু সম্পর্কে বলেছেন, “আমি বিগত বছরগুলোতে প্রতি ৫ বছরে একবার করে ইকিরু দেখেছি এবং প্রত্যেকবারই এটা আমাকে আন্দোলিত করেছে এবং ভাবিয়েছে। যতই আমার বয়স বেড়েছে ততই আমার কাছে ওয়াতানাবেকে একজন মর্মস্পর্শী বুড়োর তুলনায় নিজের অবয়ব মনে হয়েছে।”
ইকিরু থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭১ সালে ‘আনান্দ’ নামে একটি ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ২০০৩ সালে ড্রিমওয়ার্কস যুক্তরাষ্ট্রে ইকিরু রিমেক করার চেষ্টা করে, যেখানে মূল চরিত্র হিসেবে টম হ্যাংকসকে নেওয়ার কথা ছিল, তবে সেই প্রজেক্ট শেষ পর্যন্ত আলো দেখেনি। ২০০৭ সালে জাপানে টেলিভিশনের জন্য কুরোসাওয়ার আরেক চলচ্চিত্র ‘হাই অ্যান্ড লো’-র সাথে ইকিরুও রিমেক করা হয়। ২০২১ সালে ব্রিটেনে ইকিরু রিমেক করার কথা রয়েছে, যার শ্যুটিং জুন মাসে শুরু হয়। সেখানে মূল চরিত্র হিসেবে থাকবেন বিল নাই এবং আসন্ন চলচ্চিত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লিভিং’।
২০১০ সালে টাইম সাময়িকী কর্তৃক প্রকাশিত সর্বকালের সেরা ১০০টি চলচ্চিত্রের তালিকায় ইকিরু জায়গা করে নেয়। ২০১২ সালে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন সাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর সর্বকালের ২৫০টি সিনেমা নিয়ে করা ডিরেক্টরদের ভোটাভুটিতে ইকিরু ১৩২তম স্থান লাভ করে এবং সমালোচকদের ভোটাভুটিতে লাভ করে ১২৭তম স্থান। ২০১৮ সালে বিবিসির করা সর্বকালের সেরা ১০০ বিদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায়ও ইকিরু স্থান পায়। আইএমডিবির সেরা ২৫০ চলচ্চিত্রে আছে এর অবস্থান।
চলচ্চিত্রটি শেষ হলেও পরিচালক কুরোসাওয়া সাহেব কিছু প্রশ্ন দর্শকদের দিকে ছুড়ে দেন; সত্যিকার অর্থে বাঁচাটা আসলে কী বা কীভাবে আমরা সত্যিকার অর্থে বাঁচবো কিংবা আমরা যে জীবিত লাশ নই তার প্রমাণই বা কী? তাছাড়া, সেকেন্ড, ঘন্টা, দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস, বছর নিয়ে গঠিত আমাদের এই ছোট্ট জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার দায়িত্ব যে আমাদেরই সেটাই দেখিয়েছেন কুরোসাওয়া। আর এতেই নিহিত রয়েছে চলচ্চিত্র হিসেবে ইকিরুর সার্থকতা।