ইভানের শৈশব এবং স্বপ্নেরা: আন্দ্রেই তারকোভস্কির শুরু

ইভানের স্বপ্নের জগত এবং তাকে ঘিরে থাকা জান্তব যুদ্ধ-বাস্তবতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বিশ্বসিনেমার ইতিহাসের অন্যতম নামজাদা পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি নির্মাণ করেন তার প্রথম সিনেমা ইভান’স চাইল্ডহুড। স্বপ্নময় এক পৃথিবীতে বেড়ে উঠতে চেয়েছিলো ইভান অর্থাৎ আমাদের আলোচ্য সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু সে যাত্রায় বাঁধ সাধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনীর আক্রমণ। যুদ্ধতাড়িত শৈশব এবং হঠাৎ অনেক বড় হয়ে যাওয়া এক শিশুর চোখে যুদ্ধ আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা হয় আমাদের।

সিনেমার শুরুতে কালো পর্দায় দূরে কোথাও কোকিল ডেকে ওঠে। তারপর পর্দায় ভেসে ওঠে ক্লোজশটে মাকড়সার জালের আড়ালে ইভানের জিজ্ঞাসু মুখ, কোকিলের অবস্থান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ইভান। মাকড়সার জাল দেখে আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন জাগে, কিছু দ্বিধা জন্মায়। ইভান সেই জালকে অতিক্রম করে চলে যায় খানিক দূরে। তারপর সে পিছু নেয় এক প্রজাপতির। প্রজাপতির মতো ওড়ার সাধ জাগে তার। উড়তে উড়তে খানিকটা উপরে গিয়ে আবার নেমে আসে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সোনালী চুলের ইভানকে বেশ প্রফুল্ল দেখায়।

মাকড়সার জালের আড়ালে ইভান; Image Source: Mosfilm

মাটিতে নেমে আসার পর সে দেখতে পায় তার মাকে। মা-ছেলে দুজনেই একই ভঙ্গিতে কপালের চুল সরিয়ে নেয়– অদ্ভুত এক সংযোগ স্থাপিত হয় দুজনের মাঝে। কিন্তু তাতে ছেদ ঘটে নাৎসি বাহিনীর হামলার শব্দে। স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে আমাদের প্রবেশ ঘটে দুর্দান্ত এক জাম্প কাটের মাধ্যমে। ঘুম ভেঙে যায় ইভানের, আর আমরা নড়েচড়ে আবিষ্কার করি উস্কোখুস্কো চুলের জীর্ণ কাপড় পরা বাস্তবের ইভানকে। খানিক বাদেই সে পালিয়ে যাবে তার বর্তমান আশ্রয়- একটি পরিত্যাক্ত উইন্ড মিল থেকে। প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের যে বিল সাঁতরে পার হতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, বারো বছরের ইভান তা পাড়ি দেবে অনায়াসে। কারণ সে আর দশটি স্বাভাবিক বারো বছর বয়সী ছেলের মতো নয়, যুদ্ধবিগ্রহের দেশে জীবনের তাগিদে সে নিজেকে গড়ে নিয়েছে অন্য ধাতুতে।

ইভান, ফিরে এসে শত্রুপক্ষে কিছু হিসাব টুকে রাখছে; Image Source: Mosfilm

ইভানের ভালো নাম বনদারেভ। রুশ বাহিনীর কোনো কোম্পানির কাছে পৌঁছুলে তাকে খুঁজে পায় এক সৈনিক। তার মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারের ৫১ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে ইভান। কারণ হেড কোয়ার্টার ছাড়া কেউ জানে না, ছোট্ট এই বালক আদতে রুশ বাহিনীর একজন গুপ্তচর। সেখানে পূর্বপরিচিত উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারলেই এ যাত্রা নিশ্চিন্ত হয় ইভান। অনেক পীড়াপীড়িতে ফোন যায় ৫১ নম্বরে। সাময়িকভাবে নিশ্চিত ইভান ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তাকে স্বস্তি দেয় না তার স্বপ্নেরা; তারা ফিরে ফিরে আসে।

এবারও তার স্বপ্নে ফিরে আসে তার মা, সাররিয়াল এক কুয়োর ভেতর একটি তারা আবিষ্কার করে দুজনে। তারা বিষয়ে কিছু আলাপের মাঝে হানা দেয় বাস্তবের বীভৎসতা। চিৎকার করে ওঠে ঘুমের ভেতর। ঘুম ভাঙলে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইভান। পাছে কেউ জেনে যায় তার অস্বাভাবিক স্বপ্নের কথা। ইভান দেখে সেই সৈনিক ঘরের বাতি জ্বালাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে ঘুমের ঘোরে কোনো কথা বলেছিলো কি না।

মায়ের সাথে ইভান, কুয়োর ভেতর তারা খুঁজছে দুজন; Image Source: Mosfilm

এ কথোপকথন থেকেই আমরা বুঝতে শুরু করি, যুদ্ধের কী সুতীব্র আলোড়ন বয়ে গিয়েছে ইভানের ওপর দিয়ে! সে বলে, তার স্নায়ু ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ কথা বারে বারে আমরা শুনতে পাই ইভানের মুখে। পরবর্তীতে আমরা শুনতে পাই, এক সেনা অফিসার সেই সৈনিককে বলেছিলেন, আমাদের থেকে অনেক বেশি দেখে ফেলেছে এই শিশুটি।

সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা যাদের, তাদের থেকেও অনেক কাছ থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমাদের প্রোটাগোনিস্ট। আকারে ছোটখাট হওয়ার জন্য সে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ফাঁকি দিয়েছে নাৎসি বাহিনীর চোখ, তাকে যে খুব কাছ থেকে শত্রপক্ষকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়! তাদের গতিবিধি, সংখ্যা-সামর্থ্য ইত্যাদি তথ্য নিয়মিত পৌঁছে দিতে হয় হেড কোয়ার্টারে।

বিশ্বযুদ্ধের জান্তব অস্থিরতা তাই ইভানের চোখে ধরা দেয়, ধরা দেয় তারকোভস্কির ক্যামেরার কৌশলে- দিগন্তের সাথে বাঁকা হয়ে প্যান করতে থাকে ক্যামেরা। পানিতে আলোছায়ার খেলায় যুদ্ধাবস্থার টেনশন সেলুলয়েডে ধারণ করেছিলেন তারকোভস্কি।

মাই নেইম ইজ ইভান নামে সিনেমাটি মুক্তি পায় আমেরিকায়; Image Source: Mosfilm

ইভান’স চাইল্ডহুড প্রচলিত অর্থে যুদ্ধের সিনেমা নয়। বরং, যুদ্ধকালীন প্রতিক্রিয়া নানা চরিত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছে ধরা দেয়। ইভানের সাথে সাথে মাশা নামের এক নারী লেফটেন্যান্টকে ঘিরে আবর্তিত হয় সিনেমার গল্প। ক্যাপ্টেন এবং সৈনিকের খেয়ালির সাথে জড়িয়ে পড়ে মাশা। সিনেমার এই পর্বে একটি দৃশ্য ভারী চমৎকার।

বার্চ গাছের ঘন বন। এ বনের মাঝ দিয়ে চলে গেছে রুশ সেনাবাহিনীর খন্দক। কাঠঠোকরা পাখি একনাগাড়ে শব্দ করে চলে। বেশ দূর থেকে পর পর দুটি গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন খন্দকের দুই কিনারে পা ফাঁকা করে দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছেন মাশাকে। মাশা শূন্যে ঝুলে রয়েছেন ক্যাপ্টেনের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে। সেলুলয়েডে জীবন্ত করে রাখা শ্রেষ্ঠ চুমুর দৃশ্যগুলোর এটি একটি। চুম্বনের সময় ক্যামেরা প্যান করে নিচে নেমে যায় খন্দকের খানিক ভেতর। ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ছাড়া পেলে মাশা হেঁটে বেরিয়ে যান ফ্রেমের বাইরে। ফের ক্যামেরা উপরে উঠে এলে আমরা দেখতে পাই অপ্রস্তুত, ইতস্তত মাশার ভয়ার্ত মুখ। যুদ্ধাবস্থায় নারীদের অসহায়তা এবং সেনাসদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতাকে এভাবেই ফ্রেমবন্দী করেছিলেন তারকোভস্কি।

‘সন্ন্যাসী কবির যাপিত জীবনই একজন ফিল্মমেকারের জীবন’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় আন্দ্রেই তারকোভস্কি: ইন্টারভিউ বইটিতে। সাক্ষাৎকারটি নেন ফরাসি সাংবাদিক লুয়ান্স কস, ১৯৮৬ সালে। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে আসা ইভান’স চাইল্ডহুডের পেছনের গল্পগুলো যেন তারকোভস্কির সৃষ্টির প্রতি আমাদের মনোযোগ আরো নিবদ্ধ করে দেয়।

কস তারকোভস্কিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইভান’স চাইল্ডহুডের নির্মাণের শুরুটা কীভাবে করলেন? বিষয় নির্ধারণ, চিত্রনাট্য ইত্যাদি?

শুরুর গল্পটা খানিক অদ্ভুত। মসফিল্ম স্টুডিওস ইভান’স চাইল্ডহুড নির্মাণের ভার দিয়েছিলেন অন্য একজন পরিচালককে। তার সাথে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একদল অভিনয় শিল্পী এবং কলাকুশলী। সিনেমার অর্ধেকটারও বেশি সেলুলয়েডে বন্দী এবং বাজেটের অর্ধেকটা খতম। কিন্তু সিনেমার অবস্থা এমনই ভজঘট যে মসফিল্ম স্টুডিও কর্তৃপক্ষ সিনেমাটির চিত্রায়ন বন্ধ করে দিলেন এবং নতুন ডিরেক্টরের খোঁজ আরম্ভ করলেন।

ইভানস চাইল্ডহুডের পোস্টার; Image Source: Mosfilm

প্রথমে ডাক পড়লো নামী পরিচালকদের, পর্যায়ক্রমে কম-নামীদের। সকলেই এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। যে ফিল্মের অর্ধেকটার অবস্থা এমন নাচার, তাতে যত ঘি-ই ঢালা হোক না কেন, যত জোড়াতালিই দেওয়া হোক না কেন- তা পাতে তুলবার যোগ্য করে তোলা প্রায় অসম্ভব।

তারকোভস্কি তখন সবে লেখাপড়া শেষ করছেন। তার থিসিস ফিল্ম দি স্টিমরোলার অ্যান্ড দি ভায়োলিন-এর কাজও শেষের পথে। তিনি মসফিল্মের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন কয়েকটি শর্তে। সিনেমার চিত্রনাট্য যে বইয়ের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, ভ্লাদিমির বগমলোভের লেখা সে উপন্যাস তিনি আবার পড়বেন এবং সম্পূর্ণ নতুনভাবে লিখবেন সিনেমার চিত্রনাট্য। তিনি পূর্ববর্তী পরিচালকের করা শুটিংয়ের একটি শটও দেখবেন না এবং সম্পূর্ণ নতুন কাস্ট এবং ক্রুদের নিয়ে এগোবেন- যেন কাজটিকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা যায়।

মসফিল্মে কোষাগারে তখন ভাটা চলছে। তারা বেঁচে থাকা অর্ধেক বাজেটেই কাজটি শেষ করতে চান। তারকোভস্কি জানান, যদি তিনি নিজের মতো করে একেবারে শুরু থেকে সিনেমাটি তৈরি করার স্বাধীনতা পান, তবে অর্ধেক বাজেটেই সম্পূর্ণ সিনেমাটি নির্মাণ করবেন।

আন্দ্রেই তারকোভস্কি; Image Source: filmstage.com

নিজের কাজের প্রতি এমন নিষ্ঠার বলেই মাত্র সাতটি ফিচার ফিল্ম, একটি ডকুমেন্টারি এবং ছাত্রজীবনের তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিল্মের মাধ্যমেই নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন বিশ্বসিনেমার মহারথীদের কাতারে।

ইভান’স চাইল্ডহুড প্রথম প্রদর্শিত হয় ভেনিসে, ১৯৬২ সালে। ফিল্ম ক্রিটিকরা দারুণভাবে সিনেমাটিকে গ্রহণ করলেও তারকোভস্কির আক্ষেপ, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সিনেমার গল্প, ন্যারেটিভ এবং চরিত্রগুলো আলোচিত হচ্ছিলো তরুণ পরিচালকের ডেবু ফিল্ম বা প্রথম ফিল্ম হিসেবে। অর্থাৎ, তরুণ তারকোভস্কির কাজের প্রশংসা করতে গিয়ে তারা সিনেমার আসল সুর ধরতে পারেননি। ইতিহাসের দায় পরিশোধ করতে চাওয়া তারকোভস্কির আপত্তি ছিলো এখানেই।

ফরাসি তাত্ত্বিক জ্য পল সার্ত্রে ইভান’স চাইল্ডহুডের একটি দীর্ঘ সমালোচনা প্রকাশ করেন মূলত বামপন্থী ক্রিটিকদের বিরুদ্ধে; খানিকটা তারকোভস্কির পক্ষ নিয়েই। তিনি সিনেমার বিচার করেন দর্শনের আলোয়। তারকোভস্কি মনে করেন, তার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। তিনি চাইতেন, একজন শিল্পীর চোখে সিনেমার বিচার যা তখনকার ফিল্ম ক্রিটিকগণ কেউই সেভাবে করতে পারেননি। তিনি দার্শনিক তো নন! তিনি শিল্পী, তিনি যেভাবে ফিল্মটি তৈরি করেছেন, একজন শিল্পীর মননে সিনেমাটিকে তার মতো করে বুঝে উঠতে পারেননি কেউ।

পরিচালকের প্রথম সিনেমা বলে প্রথমদিকে সিনেমাটিকে খাটো করে দেখবার প্রয়াস থাকলেও তা যে ধোপে টেকেনি- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখনও তাই সিনেমা আলাপে ঘুরে ফিরে আসে ইভান’স চাইল্ডহুড। তবে পরিচালকের প্রথম সিনেমা বলে সিনেমাটির সাথে বোঝাপড়ায় কিছুটা তল পাওয়া যায়। সামনে যতো দিন যেতে থাকবে, তারকোভস্কি ততটাই মহীরূহ হয়ে নিজের আসন পোক্ত করে নেবেন বিশ্ব সিনেমায় এবং সে যাত্রায় আমাদেরকে বার বার বোকা বানাবেন, অভিভূত করবেন, আলোড়িত করবেন তার সিনেমা চিন্তায় এবং বোধে। আমরা সে যাত্রায় সঙ্গী হবার আশা রাখি।

This article is in Bangla language. It discusses about the cinema Ivan's Childhood. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: Mosfilm

Related Articles

Exit mobile version