“সরলতা, স্পষ্টতা, একত্ব: এগুলো এমন বৈশিষ্ট্য যা আমাদের জীবনকে শক্তি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আনন্দ দেয়, কারণ এগুলোও দুর্দান্ত শিল্পের চিহ্ন”
– রিচার্ড হলোওয়ে
‘বিকামিং মিনিমালিস্ট’ ব্লগের রচয়িতা এবং ‘দ্য মিনিমালিস্ট হোম’, ‘দ্য মোর অব লেস’ বইয়ের লেখক জসুয়া বেকার তার ওয়েবপেজে লিখেছেন,
“আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, মিনিমালিজম কী? এটি এমন একটি প্রশ্ন যা আমি নতুন পরিচিত বা পূর্বপরিচিত সব ধরনের মানুষের কাছ থেকেই শুনতে পাই। আমি সাধারণত তাদেরকে সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিই:
মিনিমালিজম হলো স্বল্প দখলদারিত্ব। মিনিমালিজম হলো তা-ই যা আমার জীবনযাপনে সত্যিকারভাবেই প্রয়োজন- সেই জিনিসগুলো যা আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। আমি আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস আমার জীবন থেকে দূর করেছি, যাতে করে আমি শুধু সেই বিষয়গুলোতেই আরও নজর দিতে পারি যা আমার জন্য সত্যিকার অর্থেই গুরুত্ব বহন করে।”
জসুয়া মিনিমালিজমকে আরও গভীর ও তাৎপর্যতার সাথে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, যা তার সরলতম জীবনযাত্রাকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে- মিনিমালিজম হলো স্পষ্ট এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঐ সকল ইচ্ছা দ্বারা চিহ্নিত জীবনযাপন প্রক্রিয়া, যা আমাদের নিকট সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। এবং সাথে সাথে এই জীবনযাত্রাকে বিভ্রান্ত করে এমন সমস্ত কিছু সরিয়ে ফেলা। এটি এমন একটি জীবন যা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে আসে, এবং ফলস্বরূপ, এটি জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নতি করতে সহায়তা করে।
স্বাভাবিকভাবেই অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো একেক মানুষের জন্য একেকরকম। কারণ দুজন ব্যক্তি কখনোই একরকম হয় না, কিন্তু স্পষ্ট লক্ষ্যে ফোকাস করতে আমাদের প্রত্যেককে আরও গভীরভাবে আমাদের মূল্যবোধ এবং আবেগ সম্পর্কে জানা দরকার।
আধুনিক সংস্কৃতি এই মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরিত করে ফেলেছে যে, সুখী হওয়া বা ভাল থাকার মূলমন্ত্র হলো অঢেল জিনিসের অধিকারী হওয়া । তারা বিশ্বাস করে যে, যার যত (সম্পত্তি) আছে সে-ই তত সুখী মানুষ। এবং অজান্তেই এই ধারণাটি গ্রহন করেছে যে, সুখ বুঝি কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কেনাকাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিনিমালিজমের গ্রহণ এসব দখলদারিত্বের আবেগ থেকে মুক্তি নিয়ে আসে। এটি ভোগবাদের ট্রেডমিলকে সরিয়ে দেয় এবং অন্য কোথাও সুখ খুঁজতে আপনাকে সাহসী করে তোলে। এটি পারস্পরিক সম্পর্ক, অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেয় এবং আত্মোপলব্ধি শেখায়।
এটি আমাদের সেই সকল জিনিসকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যা আমাদের কাছে আগে থেকেই আছে এবং আমাদের সেসকল জিনিসের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে মনে করিয়ে দেয়। এটি করতে গিয়ে আমরা আরও প্রাচুর্যময় জীবন খুঁজে পাই।
এটি আধুনিকতার উন্মাদনা থেকে আমাদের স্বাধীনতা দেয়
আমাদের পৃথিবী যেন এক প্রবল উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমরা সবাই খুব ব্যস্তময় জীবনযাপন করি এবং সার্বক্ষণিক চাপের মধ্যে থাকি। লম্বা লম্বা বিল পরিশোধের জন্য আমরা রোজ উৎসাহী হয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করি, কিন্তু তারপরেও প্রতিদিন গভীর ঋণের নিচে চাপা পড়ে যাই। আমরা প্রতিনিয়ত এক কাজ থেকে অন্য কাজের মধ্যে ছুটে চলি, এমনকি মাল্টিটাস্কিংও বাদ দেই না, তবুও মনের মধ্যে অস্থিরতা, শূন্যতা, অসন্তুষ্টি রয়েই যায়। সবসময় মনে হয় যেন কিছুই করা হলো না। আমরা আমাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অন্যের সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগ রাখি, অথচ খুব কাছের মানুষটির খবর রাখি না বা সত্যিকার অর্থে যে সম্পর্কগুলো আমাদের জীবনে গুরুত্ব বহন করে তা কৌশলে এড়িয়ে চলি।
মিনিমালিস্ট হয়ে ওঠা জীবনকে অনেকখানি ধীর করে দেয় এবং আমাদের “কখনো না থেমে দ্রুত এগিয়ে চলা বা শুধুই ছুটে চলার” এই উন্মাদনা থেকে মুক্তি দেয়। এটি জীবনে ছাড় দেওয়ার স্বাধীনতা দেয় এবং কেবল গুরুত্ববহ জিনিসগুলো রাখার চেষ্টা করে, যা জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে সহায়তা করে।
এটি দ্বৈত জীবনাচার থেকে মুক্তি দেয়
বেশিরভাগ মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করে না অথবা বুঝতেই পারে না যে তারা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। যেমন- তারা তাদের পরিবারের অভ্যন্তরে একরকম, সহকর্মীদের সাথে একরকম, এবং প্রতিবেশীদের সাথে আরেকরকম জীবনযাপন করে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে জীবনযাত্রা বেছে নেয়। অন্যদিকে, একটি মিনিমালিজম বা সাধারণ জীবন অবিচ্ছিন্ন এবং ধারাবাহিক। এটি এমন একটি জীবনযাত্রা যা পরিস্থিতি নির্বিশেষে সম্পূর্ণ স্থানান্তরযোগ্য, এবং যা কি না শুক্রবার সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের মাঝে অথবা রবিবার সকালে অফিসের কলিগদের মাঝে কোনো ব্যতিক্রম হয় না। এটি সৎ, স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য এবং অপরিবর্তনীয় একটি জীবনধারা, যা সব পরিস্থিতিতে কাজ করে।
এটি বর্তমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে
আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে তারকাদের দেবতাতুল্য মনে করা হয়ে থাকে। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের জন্য তাদের ছবি তোলা হয়, পত্রিকা বা রেডিওতে তাদের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয় এবং টেলিভিশনে রেকর্ড করা হয়। তাদের জীবনযাপনকে স্বর্ণের মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, এবং যা কি না অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। সরল জীবনযাপন করে এমন ব্যক্তিরা মিডিয়াতে একইভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় না। তারা বিভিন্ন সংস্থা এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা প্রচারিত ভোগবাদী সংস্কৃতিতে খাপ খায় না। তবুও, তারা আকর্ষণীয় একটি জীবনযাপন করে যা অন্যকেও উৎসাহিত করতে পারে।
বেশিরভাগ লোকেরা যখন সাফল্য, গ্ল্যামার এবং খ্যাতির পেছনে পেছনে ছুটছে, তখন মিনিমালিজম একটি এমন কণ্ঠস্বর যা তার শান্ত কণ্ঠে আমাদের ডাকে। এটি আমাদেরকে ধীরগতিতে জীবনকে উপলব্ধি করে বাঁচতে শেখায়; কম ভোগ করেও কীভাবে জীবনকে আরও উপভোগ করা যায় তার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এবং যদি আমরা সরল জীবনযাপনকারী কারও সাথে মুখোমুখি হই তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা সারাজীবন সোনার হরিণ ধরার মতোই ভুল জিনিসগুলো অনুসরণ করে চলছি।
এটি বাহ্যিক নয়, তবে অভ্যন্তরীণ
মিনিমালিজম বাহ্যিক বিশৃঙ্খলা থেকে মানুষকে স্বাধীনতা পেতে সহায়তা করে। জসুয়া বলেছেন, “আমি শিখেছি এই জীবনধারাটির সাথে অভ্যস্ত হওয়া আসলে মনের একান্ত ইচ্ছাশক্তির বিষয়। বাহ্যিক বিশৃঙ্খলা অপসারণের পরে, আমরা মনের গভীর সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য জায়গা তৈরি করি।”
একই মুদ্রার দুই পিঠ যেমন, তেমনই সহজ-সরল, তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু উপভোগ্য এই মিনিমালিজম জীবনযাপনের সমালোচনাও কম নেই। সেসব নিয়ে নাহয় আরেক দিন বলা যাবে।
জসুয়া বেকার এবং তার মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল নিয়ে জানতে ঘুরে আসতে পারেন তার ওয়েবসাইট।এছাড়া তার ইউটিউব চ্যানেলে রয়েছে এ সংক্রান্ত অসংখ্য ভিডিও।