দ্য প্রফেট: ইহুদী লেখিকার মুগ্ধ বর্ণনায় রাসুল (সা)-এর জীবনী

ইউটিউবে টেড টকে একটি ভিডিও আছে, যার শিরোনাম On Reading the Koran। সেখানে দেখা যায়, এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা তার কুরআন শরিফ পড়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন। ভদ্রমহিলা ব্রিটিশ-আমেরিকান ইহুদী। কিন্তু ভিডিওটিতে দেখা যায়, তার প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি উপমায়, প্রতিটি বিশেষণে কুরআন শরিফের প্রতি তার অপার মুগ্ধতা ফুটে উঠছে।

তিনি বলেন, কুরআন শরিফের যে প্রথম সুরা, সুরা ফাতিহা, তাতে মূল আরবিতে মাত্র ২৯টি শব্দ আছে। অন্যদিকে এর ইংরেজি অনুবাদে শব্দ আছে ৬৫ থেকে ৭২টি। কিন্তু কুরআন শরিফকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যত বেশি শব্দ যোগ করা হয়, ততই যেন এর মূলভাবটা হারিয়ে যেতে থাকে।

তার মতে, মূল আরবি কুরআনের ভাষা এমন সম্মোহনী শক্তির অধিকারী যে, তা পড়ার চেয়েও শুনতে বেশি ইচ্ছে করে। বিশ্লেষণ করার চেয়েও উপলব্ধি করে বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায়। তার মতে, কুরআনের অনুবাদ কখনোই এর মূলভাব পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারে না। তা কেবলই ছায়ার মতো একটি আবহ তৈরি করে।

ভিডিও দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে এই প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক – কে এই ভদ্রমহিলা? আর কেনই বা তিনি এত আগ্রহ নিয়ে কুরআন শরিফ পড়েছেন এবং সেটা নিয়ে টেড টকে বক্তব্য দিয়েছেন?

ভদ্রমহিলার নাম লেজলি হ্যাজেলটন। তিনি একজন সাংবাদিক এবং গবেষক। ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও কুরআন শরিফ তিনি পড়েছেন মূলত গবেষণার অংশ হিসেবে। বই লেখার জন্য গবেষণা। আর এই বই সাধারণ কোনো বই না – ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনী।

লেজলি হ্যাজেলটনের সেই বইয়ের নাম “দ্য ফার্স্ট মুসলিম“। সম্প্রতি বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। “দ্য প্রফেট” শিরোনামে বইটি অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ। আর বইটি প্রকাশিত হয়েছে আদী প্রকাশনী থেকে।

লেজলি হ্যাজেলটন একজন অ্যাগনস্টিক ইহুদী। অ্যাগনস্টিক শব্দের অর্থ হচ্ছে অজ্ঞেয়বাদী। অর্থাৎ যারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত না। এই তথ্য শোনার পরেই যেকোনো মুসলমানের মনে হতে পারে, এমন একজন ব্যক্তি, যিনি একে ইহুদী, তার উপর অ্যাগনস্টিক, তিনি যখন রাসুল (সা) এর জীবনী লিখবেন, সেই জীবনী কি পড়া উচিত হবে? সেখানে তো নিশ্চয়ই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মিশ্রণ থাকবে, থাকবে ইহুদী দৃষ্টিভঙ্গি!

মূল লেখিকা লেজলি হ্যাজেলটন; Image Source: The Accidental Theologist

কিন্তু বইটি পড়লে বোঝা যায়, এই সন্দেহ পুরাই অমূলক। লেজলি হ্যাজেলটন এমনভাবে রাসুল (সা)-এর জীবনী তুলে ধরেছেন, অল্প কিছু জায়গা বাদে অধিকাংশ সময় পাঠকের মনেই হবে না যে তিনি ভিন্নধর্মী বা সংশয়বাদী কারো লেখা পড়ছেন।

যেমন ধরা যাক রাসুল (সা)-এর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির ঘটনাটি। লেজলি হ্যাজেলটনের টেড টকের ভিডিওতেও এই প্রসঙ্গটি ছিল, এবং দ্য ফার্স্ট মুসলিম বইটিও তিনি শুরু করেছেন এই ঘটনাটি বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে লেজলি নিজে যা-ই বিশ্বাস করুন না কেন, বইয়ে তিনি একাধিকবার বলেছেন, সেদিন রাসুল (সা) ওহী লাভের যে অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছেন, তা মিথ্যা হতে পারে না। তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য।

বইটির ভেতরেও তার এরকম মন্তব্য বার বার উঠে এসেছে, যেখানে তিনি রাসুল (সা)-এর বক্তব্যকে দ্বিধাহীনভাবে সত্য বলে রায় দিয়েছেন। আর দশজন পশ্চিমা লেখকের বিপরীতে গিয়ে রাসুল (সা)-কে তিনি তুলে ধরেছেন একজন সৎ, ধর্মপ্রাণ, সকলের শ্রদ্ধাভাজন মানুষ এবং নেতা হিসেবে।

মূল বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Amazon

ইউরোপ-আমেরিকার ওরিয়েন্টালিস্ট ইতিহাসবিদগণ যেভাবে আধুনিক পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থার আলোকে ইসলামকে এবং রাসুল (সা)-কে বিচার করে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন লেজলি। এবং সেটা করতে গিয়ে তিনি রাসুল (স)-এর বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, একের পর এক যুদ্ধ, একাধিক বিয়ে, নয় বছর বয়সী আয়েশা (রা)-কে বিয়েসহ এমন সব বিষয়কে সমর্থন জানিয়েছেন এবং সেগুলোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন, যেগুলো এমনিতে অন্যান্য পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের ইসলামবিরোধিতার প্রধান অস্ত্র।

লেজলির বইয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের বাইরে থেকে মানবিকভাবে রাসুল (সা)-কে দেখার চেষ্টা করেছেন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে রাসুল (সা) এর মানসিক অবস্থা কীরকম ছিল, কোনো ঘটনায় তার অনুভূতি কীরকম ছিল, সেগুলো অনুমান করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া রাসুল (সা)-এর সাথে মক্কার কুরাইশদের যে দ্বন্দ্ব, সেটাকেও তিনি নিছক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখিয়ে বরং মক্কার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিচারে তুলে ধরেছেন, যেই দৃষ্টিভঙ্গিটা অন্যান্য জীবনীকারদের লেখায় খুব বেশি উঠে আসে না।

তবে লেজলি হ্যাজেলটনের লেখা পুরোপুরি ত্রুটিমুক্তও নয়। বইটিকে ঠিক সিরাত গ্রন্থ বলা যায় না। এটা বরং এক ভিন্নধর্মের অনুসারী এক পর্যটকের মুগ্ধ দৃষ্টিতে উঠে আসা ইসলামের নবীর জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বইয়ে কিছু কিছু ঘটনার বর্ণনা সুন্নি ইসলামিক সিরাত গ্রন্থগুলোতে যেভাবে এসেছে, তার চেয়ে একটু ভিন্নভাবে এসেছে। কেউ যদি এর আগে রাসুল (সা)-এর কোনো জীবনী না পড়ে থাকেন, তাহলে তার জন্য এই বইটি না পড়াই ভালো হবে। কিন্তু যদি ইসলামের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে কারও পরিষ্কার ধারণা থাকে, এবং অন্তত একটি সিরাত গ্রন্থ পরিপূর্ণভাবে পড়া থাকে, তাহলে একজন বিধর্মীও যে রাসুল (সা)-এর জীবনকে কত মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে পারেন, সেটা জানার জন্য হলেও এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।

অনুবাদ দ্য প্রফেট বইয়ের প্রচ্ছদ

বইটিতে লেখিকা কিছু কিছু জায়গায় তথ্যগত ভুল করেছেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবং এখানেই চলে আসে বইটির যে বাংলা অনুবাদ, তার সাফল্যের কথা। বইটি অনুবাদ করেছেন “ইহুদী জাতির ইতিহাস” সহ একাধিক জনপ্রিয় বইয়ের লেখক আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ।

আব্দুল্লাহ ইবনে অনুবাদ এমনিতেই যথেষ্ট সাবলীল এবং ঝরঝরে। পাঠকের মনেই হবে না যে তিনি কোনো অনুবাদ গ্রন্থ পড়ছেন। সেই সাথে অনুবাদক যে কাজটি করেছেন, সেটা হচ্ছে, লেখিকার ভুল এবং অসম্পূর্ণ তথ্যগুলোর পাশে অনুবাদকের ফুটনোট যুক্ত করে দিয়েছেন। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ফুটনোটগুলো শুধু ভুল সংশোধনীতে সীমিত না থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যার পর্যায়ে চলে গেছে। তারপরেও এই ফুটনোটগুলো সংযুক্ত করার কারণে একেবারে নতুন পাঠকও যদি বইটি পড়েন, তাহলে ইসলামের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা ছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ মূলত মৌলিক বইয়ের লেখক হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু দ্য প্রফেট পড়ার পর বলতে হয়, অনুবাদক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সফল। ‘অনুবাদ’ হিসেবে বইটি মূল বইকে কতটুকু অনুসরণ করতে পেরেছে, মূল বইয়ের সাথে তুলনা না করলে সেটা বলা কঠিন। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মূলভাবটি তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।

অনুবাদক আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ

তৃতীয় মুদ্রণেও বইটিতে কিছু কিছু জায়গায় “সে” এবং “তিনি” বা “করেছেন” এবং করেছিলেন” এর মিশ্রণ জাতীয় ভুল রয়ে গেছে। কিন্তু প্রুফ রিডিংয়ের এই ভুলগুলো অগ্রাহ্য করলে বইয়ের অনুবাদে কোথাও বিন্দুমাত্র আড়ষ্টতা নেই। অনুবাদকের গতিশীল ভাষা এবং মূল লেখিকার আকর্ষণীয় বর্ণনার কল্যাণে একবার শুরু করলে বইটি শেষ করে ওঠা কঠিন।

“দ্য প্রফেট” বইটি “দ্য ফার্স্ট মুসলিম” বইয়ের অফিসিয়াল বাংলা অনুবাদ। মূল লেখিকা এবং পেঙ্গুইন প্রকাশনীর অনুমতি নিয়েই এই অনুবাদ করা হয়েছে। নামের পরিবর্তনও লেখিকার সম্মতিক্রমেই করা হয়েছে। লেখক অবশ্য ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করেছেন, তবুও পাঠক হিসেবে এই প্রশ্নটা থেকেই যায়, এত বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম পরিবর্তন করে ইংরেজিতেই আরেকটি নাম দেওয়া কী এমন জরুরি ছিল, যেখানে সেই নামটি আবার আরেকটি বিখ্যাত বইয়ের (খালিল জিবরানের দ্য প্রফেট) সাথে মিলে যায়?

তবে নাম যেটাই হোক না কেন, দ্য প্রফেট বইটি নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় ইসলামিক অনুবাদ সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য একটি সংযোজন, যা সকল শ্রেণির পাঠককে সমানভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। পাঠকদের অনেকেই যে বইটি পড়ে মুগ্ধ হবেন এবং সেই মুগ্ধতা থেকে লেখিকার অপর একটি বই “আফটার দ্য প্রফেট” এর অনুবাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

This article is in Bangla language. It's the review of the book "The Prophet" by Abdullah Ibn Mahmud. The book is a translation of the book "The First Muslim" by Lesley Hazleton.

Related Articles

Exit mobile version