কোনো সম্পর্কে টিকিয়ে রাখার জন্য, দু-তিনটি বিষয় খুবই জরুরি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
– ফারিয়া প্রেমা
বাংলাদেশি এমন অনেক লেখক আছেন যারা বর্তমানে দেশের বাইরে থাকেন। হয়তো বা উন্নত জীবনযাপনের জন্য, উচ্চশিক্ষার জন্য কিংবা লুকিয়ে রাখা গোপন ক্ষোভ বা আক্ষেপ থেকে। সে যা-ই হোক, তাই বলে কিন্তু তাদের লেখালেখিটা থেমে নেই। নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে গড়ে তোলা সেসব দৃশ্যপট, চরিত্র, চরিত্রের ক্ষতসমূহ প্রত্যেককে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নাড়া দিতে বাধ্য করে। এমন নয় যে গল্পটা খুব অকল্পনীয় কিছু; এমনকি গল্পটা আপনার-আমার সবারই জানা; কিন্তু কখনো কাউকে বলতে শুনিনি কিংবা নিজে থেকেও বলতে পারিনি।
আজকের আলোচনায় সেরকম এক উপন্যাস নিয়েই কথা হবে। বাংলাদেশি লেখিকা ফারিয়া প্রেমা (যিনি বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করেন) রচিত ‘সিক্রেটস শেয়ারড’ বইটি বাংলাদেশে তেমন আলোচনায় না আসতে পারলেও জিতে নিয়েছে আমেরিকার ন্যানোরিমো পুরষ্কার ২০১৭। বিস্তারিত আলোচনার আগে চলুন কিছু পূর্বাপর ব্যাপার সম্পর্কে জেনে নেই।
পূর্বাপর প্রসঙ্গ
‘ন্যাশনাল নোভেল রাইটিং মান্থ’ যাকে সংক্ষেপে ন্যানোরিমো বলা হয় এবং এই সংক্ষেপিত নামেই আমেরিকার এই পুরষ্কারটি অধিক পরিচিত। এই প্রতিযোগিতার নিয়মটি একেবারেই সহজ। পুরো নভেম্বর মাস জুড়ে আপনাকে ৫০,০০০ হাজার শব্দ লিখতে হবে। পরবর্তীতে জুরি বোর্ডের যথেষ্ট যাচাই-বাছাই শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এই পুরষ্কার প্রদানের পেছনের কারণ হলো- কম-বেশি সবারই বলার ভাষা আছে, তবুও কিছু মানুষের জীবনের কিছু কথা গলার কাছে এসে আটকে থাকে। কোনোভাবেই সেই কথাগুলো কাউকে বলা যায় না। সেরকম মানুষেরা যেন মুক্তচিন্তায় তাদের না বলা কথাগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে পাঠক আর লেখকদের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
I was taught by mother that God made us as His most perfect creation then why am I not perfect the way I am? (আমার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর আমাদেরকে তার সবচেয়ে নিখুঁত সৃষ্টি হিসেবে তৈরি করেছেন, তাহলে আমি যে রকম সেটা কেন নিখুঁত নয়?)
– ফারিয়া প্রেমা
ডিস্ফোরিয়া হচ্ছে এমন একটি মানসিক অবস্থা যা সাধারণ জীবনযাপনের প্রতি অস্বস্তি, ধৈর্যহীনতা, অস্থিরতা, অতৃপ্তি কিংবা হতাশায় জেঁকে বসে এবং ধীরে ধীরে এটা বিভিন্ন ধরনের মানসিক অবস্থার অবনতির দিকে নিয়ে যায়। এমনকি হতাশা মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। তবে জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া বলতে আরেকটা ব্যাপার আছে, যেটাকে পূর্বে জেন্ডার আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বলেও অভিহিত করা হত।
জেন্ডার ডিস্ফোরিয়াতে রোগী নিজের শরীরে ভিন্ন লিঙ্গের উপস্থিতি অনুভব করে মানসিক অস্থিরতা এবং হতাশায় ভোগে। জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া সাধারণত জন্মের সময়ই হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে লিঙ্গের মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তির পরিচয় ঘটলেও ব্যক্তি নিজে থেকে নিজেকে ভিন্ন লিঙ্গের মানব মনে করে। সাধারণত এরা তৃতীয় লিঙ্গের মানব বলে পরিচিতি পেলেও আমাদের দেশে তাদেরকে ‘হিজড়া’ বলে সম্বোধন করা হয়; কিন্তু আদতে তারাও কিন্তু আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ।
গল্পপ্রসঙ্গ
কোনো এক শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা শীতের রাতের অর্থে জানে না ঐ কুকুর ছানাটি। একমাত্র যে ব্যাপারটা ওর প্রচন্ড আনন্দ হয় তা হচ্ছে যখন ওর মা জিভ দিয়ে ওকে চেটে দেয়। ঠিক ঐ সময়টার আনন্দটা ওকে প্রভাবিত করে দারুণভাবে। কুকুর ছানাটার জন্ম হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি, কেননা এখনো ঠিকমতো চোখটাও খুলতে পারে না ও। তবে নিজের ভাই-বোন এবং মায়ের শরীরের গন্ধটা শুঁকতে শিখে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনটি মারা গিয়েছে এবং বাকি পাঁচটিকে নিয়ে ওর মা খুবই চিন্তিত। ছানাগুলোর জন্মের পর থেকেই মায়ের খাবারদাবার হচ্ছে না ঠিকমতো। তার উপর বাচ্চাগুলোকে খাবার ছাড়া রাখাও যাচ্ছে না এক মুহূর্ত। পেটের ক্ষুধায় আর বাচ্চাগুলোর কথা চিন্তা করে মা বের হয়ে গেল খাবারের সন্ধানে। কিন্তু হয়তো এটাই মায়ের সাথে বাচ্চাগুলোর শেষ দেখা।
অন্য আর আট-দশটা দিনের মতোই সূর্যের প্রখর তাপে তানুর ঘুমটা ভাঙে। তানুর ঘরটা মূলত এই এপার্টমেন্টটার ঝুলন্ত বারান্দারই পরিবর্তিত রূপ। স্কুলের ক্রীড়া অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিস্বরূপ দ্রুত নিজেকে তৈরি করে নেয়, কেননা ও জানে ওকে তৈরি করে দেয়ার মতো কেউ নেই। চটপট তৈরি হয়ে নাস্তার টেবিলে এসে দেখে ওকে ছাড়াই সবাই বসে পড়েছে; অবশ্য এ আর নতুন কী! কোনো চেয়ারে না বসেই দুটো টোস্ট হাতে নিয়ে মূল দরজার দিকে যেতে থাকে, যেখান থেকে স্কুল বাসটার হর্ন ওকে তাড়া দিচ্ছে। ঠিক ঐরকম একটা সময়ে তানুর মা রেগে যায় ওর উপর। অবশ্য এটাও তানুর জন্য নতুন কিছু নয়।
তানুর পরিবারে সর্বমোট সাতজন মানুষের বসবাস। বাবা-মা, তানুসহ আরো তিন ভাই-বোন এবং দাদি। তানুর বোঝার বয়স থেকেই সে নিজেকে এই পরিবারের কেউ মনে করতে পারে না এবং ধীরে ধীরে এই ধারণা এতটাই বদ্ধমূল হয় যে, ও ধরেই নেয় আর কখনোই ও এই পরিবারের কেউ হতে পারবে না।
তানুর জন্মটা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, কেননা কেউ চায়নি তখন তানুর জন্ম হোক; সেই বিপদের সময়টায়, সেই অভাবের সময়টায়। কিন্তু প্রকৃতির নির্দেশে তানুর জন্ম হলো গ্রাম্য এক ধাত্রীর হাতে। ছোট থাকা অবস্থায় এই ব্যাপারগুলো কখনোই তানুর সাথে শেয়ার করা হয়নি, কিন্তু দিন যত গড়াল পারিবারিক ঝামেলার সূত্রপাত হলেই তানুকে এসব কথা শুনতে হত। প্রথমদিকে তানুর খুব কষ্ট হতো, কিন্তু ধীরে ধীরে তানু সব সহ্য করতে শিখে গেল। ওর ভেতরে কিছু একটা ভেঙে গিয়েছিল, যার ফলে ও এক নতুন মানুষে পরিণত হচ্ছিল।
A world full of unseen dreams, defiance and robustness. This world meant no harm to others, if it could just go on its own route without constant blockade and criticism. It was just like mother nature itself. The rivers, oceans and trees choose their paths naturally by the way they swoon and craves their route. (অদেখা স্বপ্ন, বাধা এবং প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ একটা জগত। এই জগত তো কারো ক্ষতি করতে চায়নি, সে যদি শুধু নিরন্তর বাধা আর সমালোচনা এড়িয়ে তার নিজস্ব পথে চলতে পারত। ঠিক যেন প্রকৃতির মতো। সব নদী, সমুদ্র, আর বৃক্ষ তাদের যার যার পথগুলো নিজেদের মতো বেছে নেয়, যে পথে তারা চলতে চায়, যেভাবে তারা চলতে চায়।)
– ফারিয়া প্রেমা
কুকুরছানাগুলো ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, অথচ মায়ের দেখা পাচ্ছে না। সোনালী রঙের কুকুরছানাটা খুবই অস্থির হয়ে উঠলো। বারবার নিজের ভাই-বোনদের গা চেটে নিজেকে আর ওদেরকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। যদিও ওদের মা খুব নিশ্চিত হয়েই ওদেরকে এখানে রেখে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষজনদের হাঁটা-চলার আওয়াজ শোনা গেল। তারা এসে ওর ভাই-বোন আর ওকে বেদমভাবে মারল, গালিগালাজ করল, সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। সোনালী রঙের কুকুরছানা মর্মাহত দৃষ্টিতে মানুষগুলোর দিকে চোখ মেলল, কিন্তু তারা নির্দয়ের মতো ওদের সবাইকে যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণ করার জন্যে ওখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে গেল। সবাই মরে গেলেও সোনালি রঙের কুকুরছানাটা বেঁচে যায় এবং ওর আশ্রয় হয় কুকুরদের আবাসস্থলে, যেখান থেকে আবার সেই মানুষেরাই ওদেরকে বন্ধু বা সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যায়। সোনালী রঙের কুকুরছানাটা ঠিক ভেবে পায় না- মানুষগুলো এমন কেন?
দিনকে দিন তানু স্কুলের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিতে পরিণত হতে থাকে। আনান নামে ওর একটা বন্ধুও জুটে যায়, যাকে মন খুলে সব বলতে পারে তানু। কিন্তু ওর জীবনে নতুন কিছুর সূচনা নিয়ে আসে নিতা। ওর প্রথম ভালোবাসা, ভালো লাগা। তানুর বর্ণহীন জীবনটাতে নতুন রঙ লাগে। বাতাসের গুন গুন সুরের ধ্বনি ওর কানে বাজে। পরিবারের অকল্পনীয় যন্ত্রণাগুলো এক নিমেষে মিলিয়ে যায় নিতার কাছে এলে। জীবন হয়তো বসন্ত দিনের সদ্য ফোটা ফুলের মতোই প্রাণবন্ত হচ্ছে- সেটাই ভাবে তানু। কিন্তু প্রতিবেশী সেলিনা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তা-ও শুধুমাত্র তানুর জন্য। অজান্তেই কেমন করে যেন সুখের পৃথিবী ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আনান শহর ছেড়ে চলে যায়, নিতা তানুকে ছেড়ে চলে যায়, আর তানু নিজের পরিবারকে ছেড়ে চলে যায় দূরে কোথাও।
সোনালী রঙের কুকুরছানাটাকে বেশ আদর-যত্নে সারিয়ে তোলা হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ আর দেখতেও সুন্দর হয়ে ওঠে কুকুরছানাটা। ব্রুনো নামের এক বয়স্ক কুকুরের সাথে ওর বেশ খাতির জমে যায়। ব্রুনো ওকে জানায়, একটা সময় ব্রুনোও দেখতে বেশ সুন্দর ছিলো। তারও একজন মানুষ ছিল যাকে ও পাগলের মতো ভালোবাসত। তার জন্য ব্রুনো কী না করেছে! নিজের সারাটা জীবন ওই মানুষটার সাথে কাটিয়েছে, ওই মানুষটার সুখে হেসেছে, দুঃখে কেঁদেছে, হৃদয়ের সমস্তটা দিয়ে শুধু… শুধুমাত্র তাকেই ভালোবেসেছে, অথচ বিনিময়ে ব্রুনো কী পেয়েছে?
ব্রুনোর শরীর যখন বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আসতে শুরু করে, চোয়ালটা যখন ঝুলে আসে, শরীরের চামড়াগুলো যখন বার্ধক্যের কাছে পরাজিত হয় তখন ব্রুনোর ভালোবাসার সেই মানুষটাই তাকে এনে এই কুকুরদের আবাসস্থলে এনে রেখে যায়। মন থেকে ভালোবাসার ফল এরকমই হবে হয়তো- ব্রুনোর জীবনী থেকে এই শিক্ষাটাই পায় ছোট সোনালী রঙের কুকুরটা।
তানু কেন নিজেকে পরিবারের কেউ ভাবতে পারে না? অনাকাঙ্ক্ষিত তানুর জন্ম কি তবে তানুর সারাজীবনের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছিল? তানুর মা-বাবা কিংবা ভাই-বোনেরা কেন তার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করে? সেলিনার সাথে তানুর এমন কী সম্পর্ক ছিল যার কারণে সেলিনা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল? আনান আর নিতাকে কি তানু সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলে? অথবা তানু পরিবারের কাছ থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়ে উঠেছিল? কী হয়েছিল তানুর অনাকাঙ্ক্ষিত অভিশপ্ত জীবনের ফলাফল? আর ঐ সোনালী রঙের কুকুরছানাটা? ব্রুনোর জীবনী কি ওর জীবনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, নাকি ও খুঁজে পেয়েছিল ওর ভালোবাসার মনিবকে? এসব জানতে হলে পড়তে হবে ফারিয়া প্রেমা রচিত ১৬০ পৃষ্ঠার বই ‘সিক্রেট শেয়ারড’।
লেখক প্রসঙ্গ
ফারিয়া প্রেমা; নামটা ছোট হলেও মানুষটার গুণের কোনো অভাব নেই। তিনি একাধারে একজন কবি, লেখিকা, গীতিকার, ঔপন্যাসিক, গায়িকা, প্রযোজক এবং সম্পাদক। লেখালেখির শুরুটা একদম ছোটকাল থেকেই বলা যায়। চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তার লেখা কবিতা এবং ছড়া ছাপা হয়েছিল স্কুলজীবনেই। আশির দশকের শেষের দিকে বিটিভির শিশুশিল্পী হিসেবেও বেশ কিছু কাজ করেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি থেকে ক্লাসিক্যাল নৃত্যের উপর বেশ কিছু কোর্সও সম্পন্ন করেছিলেন।
২০১৩ সালে অমর একুশে বইমেলায় তার প্রথম কবিতার বই বের হয় ‘অবমানবের শার্সি’ শিরোনামে। অবশ্য ২০১১ সালেই প্রথম তিনি আমেরিকান পুরষ্কার ন্যাশনাল নোভেল রাইটিং মান্থ, যাকে সংক্ষেপে ন্যানোরিমো বলে, তা জিতে নেন, যা পরবর্তীতে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বই আকারে আত্মপ্রকাশ করে ‘আরশি’ শিরোনামে। এরপর, একাধারে দুবার ২০১৬ সালে নাইন লাইভস এবং ২০১৭ সালে সিক্রেট শেয়ারড দিয়ে তিনি ন্যানোরিমো পুরষ্কার জিতেন। তবে অমর একুশে বইমেলার বেশ কিছু সম্পাদনার কাজও তিনি করেছেন।
সাহিত্যক্ষেত্রের কথা বাদ দিলে, ২০১৭ সালে তার প্রথম একক সঙ্গীত অ্যালবাম প্রকাশ পায় ‘অনেক দিন পরে জানো’ শিরোনামে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে নির্মিত বেশ কিছু মিউজিক ভিডিওর প্রযোজনাও করেছেন। এমনকি তার ইউটিউব চ্যানেল থেকে তাঁরই নির্দেশনায় নির্মিত কয়েকটি শর্ট ফিল্ম ইতিমধ্যেই বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
Love it could take ages to develop and nurture, but hatred had a power of its own. It came like a tsunami and would sweep away all things that’s good and kind. (প্রেম-ভালবাসার একটা রুপ পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়, কিন্তু ঘৃণার রয়েছে নিজস্ব ক্ষমতা। এটা জলোচ্ছ্বাসের মতো ছুটে এসে ভাল সবকিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়।)
– ফারিয়া প্রেমা
পাঠ প্রতিক্রিয়া
দুটো প্যারালাল ঘটনা সমান তালে এগিয়ে গেছে একজন মানুষ এবং একটি কুকুরছানার পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। ভালোবাসতে কম-বেশি সবাই-ই জানে, কিন্তু ক’জন সেই ভালোবাসাকে আগলে রাখতে জানে? একটি নির্দিষ্ট সময় পর ভালোবাসাটাও যেন দূরে সরে যায় নতুন কিছুর আশায়। এমন একটা ব্যাপার নিয়ে লেখিকা লিখেছেন, তবে সেটা কুকুরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কুকুরের চাইতে বিশ্বস্ত আর প্রভুভক্ত প্রাণী এ জগতে দ্বিতীয়টি নেই। মনিবকে ভালোবাসা এবং মনিবের সুখে-দুঃখে পাশে থাকাটাই যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিন মনিব ঠিকই বুড়ো কুকুরকে বিদায় করে নতুন কোনো কুকুরকে নিয়ে আসে, অথচ বুড়ো কুকুরটা সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসেছিল ওর মনিবকে।
লেখিকার লেখন শৈলীর কথা বলতেই হয়। একদম সহজ ভাষায় অকাট্য কথাগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন এমনভাবে যাতে পাঠকদের বুঝতে একবিন্দুও সমস্যা না হয়। আর সবচাইতে ভালো লেগেছে দুটো বিপরীতধর্মী প্রাণীর জীবনকে দুই দৃষ্টিতে দেখিয়ে এক দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আনার ব্যাপারটি। তবে অসংগতির ব্যাপার বলতে গেলে বলতে হয় টুকটাক শব্দগত ভুল (পুরো বই মিলিয়ে ২/৩ টা হবে) আর একই প্রবাহে গল্পটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, যার কারণে মাঝের কিছু অংশ পড়তে গিয়ে একঘেয়েমি কাজ করেছিল।
তবে ব্যাপারটি খুব দ্রুতই কাটিয়ে ওঠা যায়, কেননা গল্পের শেষটা ভালোর দিকেই এগিয়েছে। সাধারণত আমার লেখা রিভিউতে গল্পপ্রসঙ্গ ছাড়া বিস্তারিতভাবে আরো খানিকটা আলোচনা করি এই পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে। কিন্তু আজকের রিভিউতে করতে পারছি না, কারণ স্পয়লারের ভয়। তবে বইটির একদম শেষে লেখিকার একটি কবিতাও আছে। যারা মৌলিক সাহিত্য পড়ে অভ্যস্ত আশা করি তাদের ভালো লাগবে বইটি।
তাই বলা যায়, একদমই সাদামাটা জীবনের গল্প এটা। সবার জানা, সবার শোনা, সবার পরিচিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও অচেনা একটা গল্প। এই গল্পে ফুটে উঠেছে জীবনের অন্ধকার দিকগুলোর কথা, সমাজের ঘৃণিত ব্যাপারগুলোর কথা, ভালোবাসার কথা, সম্পর্কের কথা, পরিবারের কথা, আত্মসম্মানবোধের কথা, বন্ধুত্বের কথা এবং জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অজানা অধ্যায়ের কথা। তবে কেবলমাত্র দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেই যে জীবন বা পৃথিবী বদলে যেতে পারে সেরকম কথাই প্রচার হয়েছে ন্যানোরিমো পুরষ্কার বিজেতা এই উপন্যাসে।
পাঠককে আকৃষ্ট করবে যেসব কথা
১
But miracles happen and to some, they are viewed as accidents. (অলৌকিক অনেক কিছুই কিন্তু ঘটে, আর কারো কারো কাছে সেগুলোকে দুর্ঘটনা মনে হয়।)
২
A world full of unseen dreams, defiance and robustness. This world meant no harm to others, if it could just go on its own route without constant blockade and criticism. It was just like mother nature itself. The rivers, oceans and trees choose their paths naturally by the way they swoon and craves their route. (অদেখা স্বপ্ন, বাধা এবং প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ একটা জগত। এই জগত তো কারো ক্ষতি করতে চায়নি, সে যদি শুধু নিরন্তর বাধা আর সমালোচনা এড়িয়ে তার নিজস্ব পথে চলতে পারত। ঠিক যেন প্রকৃতির মতো। সব নদী, সমুদ্র, আর বৃক্ষ তাদের যার যার পথগুলো নিজেদের মতো বেছে নেয়, যে পথে তারা চলতে চায়, যেভাবে তারা চলতে চায়।)
৩
We are all beautiful creations of God. God does not make anyone ugly. It is only our visions that can turn deformed because of what we harbor in our hearts. Let go of all what is hurting you, feeding off of your anger. You will see it all in a whole new light then. (আমরা সবাই ঈশ্বরের অসাধারণ সুন্দর সৃষ্টি। ঈশ্বর কাউকে অসুন্দর করে তৈরি করেন না। আমাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিকৃতির সৃষ্টি হয়, যা কি না আমরা আমাদের হৃদয়ে লালন পালন করি। যা যা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তোমার ক্রোধকে পুষ্টি দিচ্ছে, সেসব ছেড়ে দাও, তখনই শুধু তুমি সবকিছু এক নতুন আলোতে দেখতে সক্ষম হবে।)
৪
Youth is a wondrous time where rules are broken to learn, experience and feel and that is why much burden are never on the youth for mistakes rather it is given that things will happen. (কোনোকিছু শেখার বা অনুভব করার জন্য নিয়ম ভাঙতে যৌবন একটি চমৎকার সময়। আর তাই ভুল করার জন্য যুবক-যুবতীদের উপর কখনো কোনো বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় না, বরং ধরে নেয়া হয়- এসব তো হওয়ারই কথা।)
৫
Young people will fall in love and out of love, hearts will be broken and mended, relationship with either make or break you but one thing is for sure, this is the most wonderful age group for most people, even people who are miserable their whole lives will reminiscence some moments and faces fondly in the misty memory lane. (যুবক-যুবতীরা প্রেমে পড়ে, প্রেম থেকে ছিটকে পড়ে। হৃদয় ভাঙে, দুমড়ে মুচড়ে যায়। সম্পর্ক হয় তোমাকে গড়বে নয়তো ভাঙবে, কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে, এই বয়সটা বেশিরভাগ মানুষের জন্যই সবচেয়ে সুন্দর সময়। এমনকি যেসব মানুষের পুরোটা জীবন দুঃসহ অবস্থায় কাটে, তারাও কিছু স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখবে আর স্মৃতির অলিগলিতে ঘুরঘুর করবে।)
৬
Do these humans always do this? They look for love elsewhere when love is actually staring them right on their face. (এই মানুষেরা কি সবসময়ই এরকম করে? তারা কি অন্য কোথাও ভালবাসার খোঁজ করতে থাকে, যেখানে ভালবাসা কি না একদম তাদের চোখের সামনে উপস্থিত?)
৭
Our hearts and minds need to be open and free before we let other beings reach out to us naturally, that’s why sometimes we do not hear their outcries and miss out a lot in life. (অন্য একজন মানুষকে আমাদের কাছে আসতে দেয়ার আগে আমাদের নিজেদের হৃদয় আর আত্মাগুলোকে উন্মুক্ত আর স্বাধীন হওয়া প্রয়োজন। আর সেজন্যই কখনো কখনো আমরা তাদের গভীরে লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ শুনতে পাই না আর জীবনের অনেক কিছু আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।)
বই: সিক্রেটস শেয়ারড
লেখক: ফারিয়া প্রেমা
ভাষা: ইংরেজি
প্রকাশনী: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদশিল্পী: কৌশিক জামান
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা