কৃষ্ণকুহক: পুরাণ ও জাদুবাস্তবতায় স্বাগতম

‘কৃষকুহক’কে লেখক বলেছেন ‘ফ্যান্টাসি’ জনরার বই। আফসার ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটির ‘ভূমিকা’ অংশেই লেখক লিখেছেন,

মূলত ফ্যান্টাসি ধাঁচের এই গল্পগুলো আশা করি পাঠকদের ভাল লাগবে। বাংলায় ফ্যান্টাসি যাত্রা আরপ সুগম হোক, এই কামনা থাকল।

বইটি মূলত একটি ছোটগল্প সংকলন। ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে অবশ্যি ফ্যান্টাসি ধাঁচের খুব বেশি বই প্রকাশিত হয়নি। তবে লেখক এই বইয়ের প্রায় সবকটি গল্পই লেখার চেষ্টা করেছেন ফ্যান্টাসি উপজীব্যকে কেন্দ্র করেই। তবে এসব কিছু বোঝার আগে ‘ফ্যান্টাসি’ জনরা কী সেটা আসলে বোঝা উচিত। 

ফ্যান্টাসিকে বোঝার সহায়তায় আমাদের সাহায্য করবে বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ‘লিটারারি টার্মস’। সেখানের ফ্যান্টাসির প্রসঙ্গে লেখা আছে, 

ফ্যান্টাসি এমন একটি জনরা যা লেখা হয়ে থাকে কাল্পনিক উপজীব্যে। এটা জাদু, পুরাণ, পরাবাস্তবতা, সুপারহিরো- যেকোন কিছু হতে পারে। মূলত লেখক এই দৈনন্দিন দুনিয়ার বাইরে গিয়ে যা লেখেন সেটাই ফ্যান্টাসির মূল গল্প।

কৃষ্ণকুহকের পুরাণ

কৃষ্ণকুহকে মোট সাতটি ছোটগল্প আছে। এই গল্পগুলোর মধ্যে দুটি গল্পে নিখাঁদ পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে। এই গল্প দুটি হলো ‘রয়েছি তোমার অপেক্ষায় নেসহাত’ এবং ‘১৩ নং, আতিশখানা লেন’। এই দুটো গল্পের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো দুটি ভিন্ন টাইমলাইনের মধ্যে ‘ব্রিজিং’-এর ব্যবহার। ব্রিজিং শুনলেই অবশ্য সিনেমার আলাপ বলে ভ্রম হতে পারে। কিন্তু সিনেমাতে ব্যবহার হওয়া ব্রিজ শটকেই আমি সেই একই অর্থে এখানে ব্যবহার করছি। সিনেমাটোগ্রাফিতে দুটি আলাদা আলাদা টাইমফ্রেমের মধ্যকার সিন জোড়া দিতে ব্রিজশটের ব্যাবহার করা হয়। এখানেও সেটি করা হয়েছে। ইতিপূর্বে পুরাণবিষয়ক গল্প বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে কমই। তবে যেগুলোও বা লেখা হয়েছে সেগুলো থেকে এই দুটি গল্পকে আলাদা করেছে এই ব্রিজিংয়ের ব্যবহারই। 

Image source: Ancient Source Magazine

পুরাণের গল্পে মূলত এক প্রাগৈতিহাসিক বা পরাবাস্তব স্বর্গ-নরকের যুগের আলোচনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। দেব-দেবীর পদচারণার দুনিয়াকে মিশেই লেখা হয়ে থাকে গল্প। তবে এখানে সেটা করা হয়নি। বরং কয়েকশো বছর আগের পৌরাণিক কোনো ঘটনা কীভাবে আজকের দিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, সেই চমৎকার প্লটেই লেখা হয়েছে গল্পগুলো। এতে শুধু যে গল্পে পৌরাণিক ধাঁচেরই স্বাদ পাওয়া যাবে তা-ই নয়, বরং ঐ একই প্রেক্ষাপটকে পাঠক মেলাতে পারবেন আজকের দিনের সাথেও। দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের এই মিল গল্পের পাঠকেও বেশ উপভোগ্য করে তুলেছে। 

Image Source: Samiatul Khan/Roar Media

বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে

বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই দেখা গিয়েছে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে গল্প লিখে লেখক তা নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছেন। এই ছাপানোর সংস্কৃতি লেখক হিসেবে খুব ভাল নয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরেই এটি চলে আসছে। জনপ্রিয় সিরিজ ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ থেকে বাংলায় রূপান্তর হওয়া ‘তিন গোয়েন্দা’র গল্পের সংখ্যা এখন ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ থেকেও ঢের বেশি। এমনকি গল্পের অভাবে এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’-এর গল্পকেও তিন গোয়েন্দাতে রূপান্তর করে ফেলা হয়েছে। তবে এই রূপান্তরে সবাই বাজে যে সংস্কৃতি ছড়িয়েছে তা হলো- কখনোই কোথাও মূল লেখাকে কোনো ক্রেডিট দেওয়া হয়নি। শুধু যে দেওয়া হয়নি তা-ই নয়, বরং গল্পগুলো যে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা হয়েছে, সেটিও কোথাও কখনও উল্লেখ করা হয়নি।

এদিক থেকে কৃষ্ণকুহকের লেখক প্রশংসার দাবি রাখেন। ছোটগল্প ‘দৃষ্টি’সহ বেশ কিছু গল্প এখানে লেখা হয়েছে ‘বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে’ এবং সেটি স্বীকার করতে লেখক কুণ্ঠাবোধ করেননি। তবে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখার অবশ্যই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি ব্যাপারই আছে। ইতিবাচক ব্যাপার তো এটাই যে লেখক বিদেশি গল্পের মূল উপজীব্য বাঙালি পাঠককে বাংলা ভাষায় পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তবে নেতিবাচক দিক হলো, মৌলিক ছোটগল্পের গ্রন্থে এমন বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা গল্পগুলো গ্রন্থের ভারকে অনেকটাই হালকা করে দেয়। যেমন, কঙ্কাবতীর মতো চমৎকার একটি মৌলিক গল্প লেখক এখানে যোগ করেছেন। পাঠক এমন গল্প পড়ে আনন্দ পেতে বাধ্য। এর সাথে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা অথচ আকারের দিক থেকে ছোট গল্পগুলোকে পাঠক ঠিক লেখকের গল্প বলে মেলাতে পারার কথা নয়। এছাড়াও একটি মৌলিক গ্রন্থে শুধুমাত্র লেখকের নিজের লেখা থাকাটাই সম্ভবত সবচেয়ে জরুরি দিক। নিজের লেখার সাথে এই প্লট ধার করে ছায়া অবলন্বনে লেখা গ্রন্থকে ঠিক পুরোপুরি মৌলিক বলতে সমালোচকদের বাধা দেয়। 

লেখনশৈলী

বইয়ের লেখনশৈলী সাধারণ ধাঁচের। তবে লেখকের অনুবাদক হিসেবে কাজ করবার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্ভবত এখানে তাকে পিছু ছাড়তে পারেনি। সাধারণত অনুবাদের লেখার ধাঁচ আর মৌলিক গ্রন্থের লেখার ধাঁচের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা দেয়। লেখকের মৌলিক বেশ কিছু গল্প পড়ে এখানে মনে হয়েছে, তিনি আদতে নিজের গল্প বলছেন না। বরং অন্যের বলা গল্পই নিজের মতো করে বলছেন। যেকোন মৌলিক লেখকের গল্প বলার ও গল্প লেখার একটা নিজস্ব ঢঙ থাকে। এই ঢঙের অভাব বোধ হয়েছে লেখকের লেখাতে। 

এছাড়া লেখক লেখার সময় সময়ের হিসেবেও বেশ কিছু জায়গাতে গুলিয়ে ফেলেছেন। খুব সম্ভবত গল্প লেখার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করাটা এক্ষেত্রে একটা কারণ হতে পারে। এই ব্যাপারে একটি উদাহরণ দেওয়াটাই যথার্থ হবে। প্রথম গল্পে একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক প্রথমে বলেছেন,

কার্তিক মাসের এক ভরদুপুরে চলে এলাম পোড়োবাড়িটার সামনে

এরপর ঘটনার প্রিক্যুয়েল বর্ণনা করে আবারও ঘটনায় ফেরার পর লেখক ঐ একই ঘটনার সময় বর্ণনায় পরের পৃষ্ঠাতেই লিখেছেন,

সেদিন ছিল পৌষ মাসের সতেরো তারিখ

বাংলা ক্যালেন্ডারে কার্তিক ও পৌষের মাঝখানে আস্ত একটা অগ্রহায়ণ আছে- লেখকের আরেকটু সতর্ক থাকাটা তাই উচিত ছিল। 

লেখক

লেখক সালমান হক; Photo Credit: Boighor

‘কৃষ্ণকুহক’-এর লেখক সালমান হক। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বাংলা অনুবাদের সাথে যুক্ত আছেন। তর্কসাপেক্ষে আধুনিক অনুবাদকদের মধ্যে তিনি প্রথমসারির একজন অনুবাদক হয়েই থাকবেন। ইংরেজি থেকে জাপানি, বেশ কয়েকটি সাহিত্যের বই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ‘কৃষ্ণকুহক’ লেখকের দ্বিতীয় মৌলিক গ্রন্থ। 

This Bangla article is a book review of 'Krishnokuhok'.

Related Articles

Exit mobile version