আপনি যদি একজন বই পড়ুয়া হন, তাহলে আপনার অবশ্যই একটা গুডরিডস অ্যাকাউন্ট থাকা উচিত। গুডরিডস (Goodreads) জিনিসটা কী? আপনার যদি চলচ্চিত্র দেখার অভ্যাস থাকে, তাহলে আপনাকে সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য বলা যেতে পারে, গুডরিডস হচ্ছে একইসাথে বইয়ের জগতের IMDB এবং Facebook।
কোনো মুভি দেখার আগে বা ডাউনলোড করার আগে অধিকাংশ মানুষ কী করে? IMDB-তে ঢুকে মুভিটা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জেনে নেয় – কাহিনী কী, পরিচালক কে, কলাকুশলী কারা, দৈর্ঘ্য কতটুকু, এবং সবচেয়ে বড় কথা, রেটিং কত? অর্থাৎ এর আগে যারা মুভিটা দেখেছে, তাদের কাছে মুভিটা কেমন লেগেছে?
গুডরিডসেও আপনি ঠিক সেই কাজটাই করতে পারবেন। না, আইএমডিবি থেকে যেরকম মুভি ডাউনলোড করা যায় না, গুডরিডস থেকেও সেরকমই আপনি বই ডাউনলোড করতে পারবেন না। কিন্তু এখানে আপনি বই সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য পাবেন। বই পরিচিতি বা কাহিনী সংক্ষেপ, লেখকের নাম, পরিচয়, তার অন্যান্য বইয়ের নাম, প্রকাশকের নাম, পৃষ্ঠাসংখ্যা, রেটিং এবং রিভিউ। এই রিভিউ এবং রেটিং কারা দেয়? আইএমডিবির মতোই এখানেও রিভিউ এবং রেটিংগুলো দেয় আপনার আমার মতো সাধারণ পাঠকরাই।
কোনো বইয়ে যদি প্রচুর রেটিং এবং রিভিউ থাকে, তাহলে বোঝা যায় বইটা প্রচুর মানুষ পড়েছে এবং সেটা নিয়ে আলোচনা করেছে। গুডরিডসে বইয়ের রেটিং দিতে হয় ৫-এর মধ্যে। কোনো বইয়ের রেটিং যদি ৪-এর উপরে হয়, তাহলে বোঝা যায় বইটা বেশ ভালো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আর যদি ৩.৫ বা ৩-এর নিচে হয়, তাহলে বুঝতে হবে বইটা মানুষের ভালো লাগেনি। ফলে নতুন কোনো বইয়ের নাম শোনার পর সেটা কেনার বা পড়ার আগে আপনি গুডরিডসে ঢুকে তার রেটিং-রিভিউ যাচাই করে নিতে পারেন।
এ তো গেল আইএমডিবির সাথে মিল। ফেসবুকের সাথে গুডরিডসের মিল কোথায়? ফেসবুকের মতোই গুডরিডসেও আপনি অন্যান্য পাঠকদেরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারবেন। বিশেষ করে আপনি যদি ফেসবুক আইডি দিয়ে গুডরিডসে সাইন-আপ করেন, তাহলে আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের মধ্যে যারা আগে থেকেই গুডরিডসে আছে, তাদের আইডি আপনি সহজেই খুঁজে পাবেন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর জন্য। কিন্তু গুডরিডসে ফেসবুকের মতো আপনার ফিডে রাজ্যের আবর্জনা এসে হাজির হবে না। এখানে শুধু আপনি দেখতে পাবেন আপনার ফ্রেন্ডরা কে কোন বই পড়ছে, কোন বইকে কত রেটিং দিয়েছে, কোন বই সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছে। নতুন এবং ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়ার জন্য এটা একটা অসাধারণ মাধ্যম।
বন্ধুদের লাইক বা রেটিং দেওয়া কোনো বই আপনার ফিডে ভেসে ওঠার পর আপনার যদি বইটা পছন্দ হয়, তাহলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে ‘Want to Read’ বাটনের উপর ক্লিক করে বইটাকে আপনার আগ্রহের তালিকায় নিয়ে নিতে পারবেন। এরপর সময় হলে সেই তালিকা থেকে একে একে বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করতে পারবেন।
গুডরিডসে আপনি লেখকদেরকেও ফলো করতে পারবেন। ফলে কোনো লেখকের যদি নতুন কোনো বই আসে, তিনি যদি কোনো বইয়ে বিশেষ কোনো ছাড় ঘোষণা করেন, তিনি যদি কোনো রিভিউ দেন, বা কোনো ব্লগ পোস্ট করেন, সেটাও আপনি সহজেই জানতে পারবেন। চাইলে আপনি লেখকদের সাথে যোগাযোগও করতে পারবেন, তাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্নও করতে পারবেন।
গুডরিডসের রিডিং চ্যালেঞ্জ নামে একটা ফিচার আছে। এর মাধ্যমে আপনি বছরের শুরুতেই নিজের বই পড়ার টার্গেট সেট করে দিতে পারবেন। ধরুন, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই বছর আপনি ৫০টা বই পড়বেন। এরপর প্রতিটা বই পড়ার পর আপনি যখন সেটাকে গুডরিডসে ‘Read’ হিসেবে মার্ক করবেন, বা সেটার রিভিউ বা রেটিং দিবেন, তখনই সেই তথ্য আপনার চ্যালেঞ্জের সাথে হালনাগাদ হয়ে যাবে। ফলে যেকোনো সময় আপনি চাইলে দেখতে পারবেন আপনার টার্গেট কতটুকু অর্জিত হয়েছে। বছর শেষ হওয়ার পর আপনি জানতে পারবেন, সারা বছর আপনি কতটা বই পড়েছেন, মোট কত হাজার পৃষ্ঠা পড়েছেন, সবচেয়ে বড় কোন বই পড়েছেন ইত্যাদি।
গুডরিডস আপনি ব্রাউজার থেকে সরাসরি ওয়েবসাইটে গিয়েও ব্যবহার করতে পারবেন, অথবা অ্যাপ নামিয়ে সেখান থেকেও ব্যবহার করতে পারবেন। আপনার ফেসবুক বা জিমেইল আইডি দিয়েই সেখানে সাইন-আপ করতে পারবেন। তবে ওয়েবসাইটের তুলনায় অ্যাপে বাড়তি একটা সুবিধা আছে, সেটা হচ্ছে বইয়ের কভার স্ক্যান করার সুবিধা। গুডরিডস অ্যাপের ক্যামেরা যেকোনো বইয়ের কভারের সামনে ধরলেই (যদি সেটা গুডরিডসের ডাটাবেজে থাকে) গুডরিডস বইটা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং রেটিং তুলে ধরতে পারে। বুক শপে গেলে নতুন বই চেক করার সময় এই ফিচারটা বেশ কাজে লাগে।
গুডরিডসের ডেটাবেজে আপনি গত কয়েক দশকের মধ্যে প্রকাশিত প্রায় সব ইংরেজি বই খুঁজে পাবেন। সেই তুলনায় বাংলা বইয়ের ডেটাবেজ এখনও তুলনামূলকভাবে কম সমৃদ্ধ। তারপরেও গত কয়েক বছরে প্রকাশিত যেসব বই মোটামুটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই সেখানে আছে। তবে সেগুলোতেও রেটিং এবং রিভিউর সংখ্যা কম। বাংলা জনপ্রিয় বইগুলোতে সর্বোচ্চ কয়েকশো রেটিং পড়ে, যেখানে ইংরেজি এই সংখ্যা লাখ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
আমরা যারা বই পড়তে পছন্দ করি, আমাদের সবার উচিত হবে যেকোনো বই পড়া শেষ করে গুডরিডসে গিয়ে রেটিং দিয়ে আসা। সবচেয়ে ভালো হয় রেটিংয়ের সাথে সাথে দুই-এক লাইন হলেও মতামত প্রকাশ করা। এতে লাভ কী হবে? নতুন যেসব পাঠক গুডরিডসে আসবে, তারা সহজেই ভালো বইগুলো খুঁজে পাবে। তাদেরকে বইয়ের গ্রুপে গ্রুপে গিয়ে পুরানো রিভিউ খুঁজে খুঁজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কষ্ট করতে হবে না। এবং আমাদের দেখাদেখি নতুনরাও যখন গুডরিডসে রেটিং-রিভিউ দিতে শুরু করবে, তখন ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর পর আমরাও সহজেই যেকোনো বই খুঁজে পাবো।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, গুডরিডসে কোনো বইয়ের রেটিং ভালো হলেই যে সে বইটার মান ভালো হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? না, সে নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু প্রচলিত অন্যান্য নির্দেশকের চেয়ে এ ধরনের রেটিং ভালো হয়। যেমন ধরুন, তারকাখ্যাতি পাওয়া কোনো লেখকের লেখা কোনো বই হয়তো তার নামের কারণেই বেস্ট সেলার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কেনার পর পাঠকের কাছে তার বই যাচ্ছেতাই মনে হতে পারে। তখন সেটা গুডরিডসের নেগেটিভ রিভিউ আর রেটিং থেকেই বোঝা যাবে।
গুডরিডসে গিয়ে আপনি যদি কোনো বই খুঁজে না পান, তাহলে আপনি নিজেও সেটা অ্যাড করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য এবং প্রচ্ছদ সরবরাহ করতে পারেন। গুডরিডসের লাইব্রেরিয়ানরা আপনার তথ্য যাচাই করে বইটা অ্যাড করে দেবে। সাধারণত নতুন বই অনুমোদন পেতে কয়েক দিন সময় লাগে। অথবা আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ যদি লেখক হয় এবং গুডরিডসে তার অথর প্রোফাইল থাকে, তাহলে তাকে অনুরোধ করেও নতুন বই যুক্ত করার কিংবা ডেটাবেজে থাকা কোনো বইয়ের ভুল তথ্য সংশোধন করানোর কাজটি করিয়ে নিতে পারেন। গুডরিডসে অথরদের লিমিটেড লাইব্রেরিয়ান অ্যাকসেস থাকে, ফলে এ ধরনের পরিবর্তন তারা মুহূর্তের মধ্যেই করে দিতে পারে।
তবে গুডরিডস ব্যবহারের সময় একটা বিষয়ে আমাদের সবার সচেতন থাকা উচিত। রেটিং দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমরা যেন সেটার অপব্যবহার না করি। আমাদের সবার উচিত নিজে সৎভাবে রেটিং দেওয়ার অভ্যাস করা এবং অন্যকেও সৎভাবে রেটিং দিতে উৎসাহিত করা। ধরুন, কোনো একজন তারকা নতুন একটা বই প্রকাশ করল। তার ভক্তরা দলে দলে সেটাতে ৫ রেটিং দিতে শুরু করল। আমরা কী করব? তাদের অতিরিক্ত রেটিংকে প্রশমিত করার জন্য বইটা না পড়েই ১ রেটিং দিয়ে আসব?
না, আমাদের উচিত হবে বইটা পড়ে এরপর যদি মনে হয় সেটা ২, ৩ অথবা ৪ পাওয়ার উপযুক্ত, তাহলে সেটাই দেওয়া। আমরাও যদি ১ দেই, তাহলে তার অপেক্ষাকৃত কম উগ্র ভক্তরা, যারা এমনিতে হয়তো ৩ বা ৪ দিত, তারাও আবার সেটার সমতা আনার জন্য ৫ দিয়ে বসবে। এই চক্র কখনোই শেষ হবে না। কাজেই কে কী রেটিং দিচ্ছে লক্ষ্য না করে আমাদের উচিত হবে বই পড়ে এরপর যোগ্য রেটিংই দেওয়া। যদি অধিকাংশ মানুষ সততা অবলম্বন করে, তাহলে অল্প কিছু অপ-ভক্তের বেশি রেটিংয়ে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
গুডরিডস ব্যবহার করা খুবই সহজ। ফেসবুক বা জিমেইল আইডি দিয়ে সাইন-ইন করার পর যেকোনো বইয়ের নাম লিখে সার্চ দিয়ে বইটির পাতায় গেলেই আপনি বিভিন্ন অপশন আপনার সামনে এসে হাজির হবে। গুডরিডস ব্যবহার করতে পারবেন ব্রাউজার থেকে সরাসরি এই লিঙ্কে গিয়ে। অথবা অ্যান্ড্রয়েড অ্যাড ডাউনলোড করতে পারবেন এই লিঙ্ক থেকে।