মানুষ ঘুমের মাঝে স্বপ্ন কেন দেখে? নানানরকম স্বপ্নের নানান ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। তবে স্বপ্নটাই মানুষ কেন দেখে, এর কোনো স্বতঃসিদ্ধ ব্যাখ্যা আজ অব্দি নেই। ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অনুসারে, “স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশ”। মানুষ জাগ্রত অবস্থায় যে আবেগগুলো তার মাঝে লালন করে, সেসব ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন রূপে আসে। ঘুমেরও তো আবার তিনটি পর্যায় আছে। আর মানুষ যে দুঃস্বপ্ন দেখে, তা হলো তৃতীয় বা শেষ পর্যায়টিতে। স্লিপ অনসেট, লাইট স্লিপের পরই আসে ডিপ স্লিপের পর্যায়।
তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্যায় নিয়ে হয় এই ডিপ স্লিপ বা র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আর.ই.এম.)। র্যাপিড আই মুভমেন্টের ফলে মানুষ স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘুমানো অবস্থায় চোখের কালো গহ্বর প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে নড়াচড়া করে, এবং এ ঘর্ষণের ফলে মস্তিষ্কে ইমেজ তৈরি হয়। এসব আসে মস্তিষ্কে রক্ষিত স্মৃতি থেকে। সারাদিনে মানুষ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ, অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়ে যায়, মিথস্ক্রিয়া করে। সেসব জমা হয় মস্তিষ্কে। আর সে থেকেই তৈরি হয় ওই ইমেজ। স্বপ্নের ইমেজ, দুঃস্বপ্নের ইমেজ। ফ্রয়েডীয় তত্ত্বটাই পুরোপুরি খাটে এখানে।
তা সিনেমা নিয়ে বলতে এসে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের প্রকৃতি নিয়ে ‘বিষোদগার’ করতে যাওয়া কেন? কারণ, দুঃস্বপ্নটা যে এই সিনেমার গল্পের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সিনেমার গল্পট প্রথম যে প্রশ্ন উত্থাপন করে, তা হলো- যে দুঃস্বপ্ন আপনি ঘুমিয়ে দেখছেন, কী হবে, যদি সেই জগতটাই আপনার জন্য সত্যি হয়ে ওঠে? যদি তা আর দুঃস্বপ্ন না থেকে বাস্তবিক হয়ে যায়?
‘কাম ট্রু’ (২০২০) সিনেমাটি আরম্ভই হয় একটি দুঃস্বপ্নের দৃশ্য দিয়ে। একদম মিউটেড গ্রে কালার প্যালেটে ক্যামেরা খুব ধীরলয়ে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, একটা গুহার মধ্য দিয়ে। ওটা যেন সুড়ঙ্গপথ। একটু পরেই কিছুটা খোলা জায়গা সামনে পড়ল। একটা আবছা আকৃতি জায়গাটার মাঝখানে দাঁড়ানো। অদ্ভুত ভঙ্গিতে শরীরটা বাঁকানো। গা ছমছমে আবহসঙ্গীত আর ক্যামেরার ধীরলয়ে আগানো ভয়ের তৈরি করে। আদিম ভয়। ওটুকুতেই শেষ। এই গোটা অংশ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র সারাহ’র দুঃস্বপ্ন। জেগে ওঠে সে। সাইকেল নিয়ে ছুটে বেরোয়। ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রী সারাহ। সমস্যাটা হলো, ঘুম তার একদমই আসে না। ঘুমুলেই দেখতে শুরু করে নানান ভূতুড়ে স্বপ্ন। মায়ের সাথে ঘরে সে থাকে না। পার্কে, এখানে-সেখানে ঘুমায়।
অনেকটা ঘুমানোর জায়গা হিসেবেই বলা হোক, কিংবা দুঃস্বপ্নগুলোর হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যেই বলা হোক; সে ভার্সিটির একটা ‘স্লিপ স্টাডি’তে অংশ নেয়। এখানে মানুষ আসবে? আর শুয়ে ঘুমাবে। ব্যস, এটাই? সারাহ খুব দ্বিধা আর সন্দেহ নিয়ে প্রশ্নটা করে। তার জিনিসটা বিশ্বাস করতে একটু সময় লেগেছে। এবং সেটা অবশ্যই ওপাশের নির্লিপ্ত উত্তর পাওয়ার পর। তারপর প্রথম দুয়েকদিন ঠিকঠাকই ঘুমাচ্ছিল সারাহ। কোনো দুঃস্বপ্ন কিংবা ওই আকৃতি, কিছুই দেখছিল না। কিন্তু এর পরই দৃশ্যপট বদলে যায়। তার সেই দুঃস্বপ্নগুলো আরো জীবন্ত লাগছে। ভয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সারাহ’র দৃঢ়তায় এই নিরীক্ষার প্রধান গবেষক জেরেমি তাকে সত্যটা জানাতে বাধ্য হয়। জেরেমি পরীক্ষা চালিয়ে জানতে চেষ্টা করছে, মানুষ স্বপ্নে কী দেখে? দুঃস্বপ্ন দেখতে কেমন?
এসবের উপর ভিত্তি করে মানুষের মস্তিষ্কে বিদ্যমান একেবারে আদিম ভয়টার মূলে, সে যেতে চায়। জানতে চায় সে সম্পর্কে। কিন্তু ত্রুটি দেখা দেয় কিছু। বিঘ্ন ঘটে পরীক্ষায়। যতক্ষণে সেসব বোঝা গেল, ততক্ষণে অনেককিছু নিয়ন্ত্রণে আর নেই। সারাহ’র দুঃস্বপ্নের সেই আকৃতিও ততক্ষণে আরো তৎপর হয়ে উঠেছে। দুঃস্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে নামতে চাইছে সেটা। বেরিয়ে আসতে চাইছে মাথার ভেতর থেকে।
‘কাম ট্রু’ কানাডিয়ান সিনেমা। ইদানীংকালের কানাডিয়ান ইন্ডি-সায়েন্স ফিকশন সিনেমাগুলো আবার যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিচ্ছে। সাম্প্রতিকের ‘রেডিয়াস’ (২০১৭) সিনেমাটি এর যোগ্য উদাহারণ। পরিচালক অ্যান্থনি স্কট বার্নসের আগের সিনেমাটি, ‘আওয়ার হাউস’ (২০১৮), একটি আমেরিকান সিনেমার রিমেক। সেই অভিষেক সিনেমা দেখা হলে স্কটের স্বতন্ত্রতার পরিচয় পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, রিমেক হলেও তা স্বতন্ত্রতা হারায়নি এক বিন্দু। এই পরিচালক হররে পুরোপুরিই আবহভিত্তিক বা অ্যাটমোস্ফিয়ারিক থাকতে চান। পারতপক্ষে জাম্প স্কেয়ার রাখতে চান না। যে কয়টা থাকে, সেগুলো ভীতিজনক হওয়ার চাইতে পরিবেশটাকে আরো রহস্যের চাদরে মোড়াতে চায় বেশি। তাই তার জাম্প স্কেয়ারগুলো হয় নরম-সরম প্রকৃতির, যার সুযোগ্য প্রমাণ তার এই দ্বিতীয় সিনেমাটি। আর ভয়টার উদ্ভব তিনি সবসময় অন্তর্জাত অনুভূতির জায়গা থেকে ঘটান।
‘কাম ট্রু’ তার মূল অনুপ্রেরণা নিয়েছে আমেরিকান ডকু-পরিচালক রডনি আস্কারের ডকুমেন্টারি ‘দ্য নাইটমেয়ার’ (২০১৫) থেকে। স্লিপ প্যারালাইসিস বা এদেশে যেটাকে বলা হয় ‘বোবায় ধরা’, তা নিয়েই নির্মিত হয়েছিল ডকুটি। এই সিনেমাকে বলা যায় ওই ডকুর একটা নাটকীয় ভার্সন, যেটি নাটকীয় করতে সাইফাই আর হররের মিশেল ঘটানো হয়েছে। দুঃস্বপ্নটা যদি বাস্তবে চলে আসে, তবে কী হবে; সে প্রশ্ন তো এই সিনেমা উত্থাপন করেই, সাথে, কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব- তা মানুষ আলাদা করতে না পারলে কী ঘটবে; সে প্রশ্নও করে। পর্দায় ভয়টাকে আগ্রাসীভাবে দেখানো না হলেও, ভাবনার উদ্রেক ঠিকই ঘটায়। আর সেই জায়গাতেই ভীতিকর হয়ে অঠে সিনেমা। পরিবার থেকে সারাহ’র বিচ্ছিন্নতা, তার হতাশা, সেসবের সাথে চলমান দুঃস্বপ্ন এইসব কিছুই তো আসল ভয়ের উপাদান। একেবারে বাস্তবিক ভয়। এসবে বন্দী হবার অভিজ্ঞতাটা কেমন হতে পারে, তা সারাহ’র চরিত্রের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেন পরিচালক।
অ্যান্থনি স্কটের নিজের লেখা চিত্রনাট্যটি অবশ্য মোটাদাগে গল্পনির্ভর করে তৈরি হয়েছে। সংলাপ, সাবটেক্সট স্বল্প আকারে রাখা হয়েছে। ‘কাম ট্রু’ চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে বিভক্ত হয়ে চলে, তবে সরলরৈখিকভাবেই। চ্যাপ্টারগুলোর নাম নেওয়া হয়েছে মনো-চিকিৎসক এবং মনো-বিশ্লেষক কার্ল ইয়ুংয়ের তত্ত্ব হতে। ইয়ুংয়ের ‘কালেক্টিভ আনকনশাস’ টার্ম থেকে আসা ‘ইয়ুংয়িয়ান আর্কিটাইপ’-এর অন্তর্ভুক্ত ধারণাগুলো (দ্য পারসোনা, দ্য এনিমা অর এনিমাস, দ্য শ্যাডো, দ্য সেল্ফ) অনুযায়ী চ্যাপ্টারগুলোর নাম। তবে তা বোঝার জন্য মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিতে হবে, এমন কিন্তু নয়। এই দ্ব্যর্থবোধক তত্ত্বের পৃষ্ঠতলীয় প্রয়োগটাই এখানে করা হয়েছে। সূক্ষ্ম স্পর্শ রাখা হয়েছে পুরো সময়টা জুড়ে। মূলত কালেক্টিভ আনকনশাসের বিষয়টিই অধিক গুরুত্ববহ আকারে এসেছে। দুঃস্বপ্নের ন্যারেটিভ তৈরি করতেই ইয়ুংয়ের তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়েছে।
সারাহ’র দুঃস্বপ্নের প্রকৃতির অনুসন্ধান চালালেও, তার আবেগীয় মনস্তত্ত্বের গভীরে এই সিনেমা যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জুলিয়া সারাহ স্টোন সেই খামতিটাকে যতখানি সম্ভব নিজের ঘাড়ে রেখে টেনেছেন। কুব্রিকের ‘দ্য শাইনিং’ সিনেমার অনুপ্রেরণা এখানে আছে, তবে তা শুধু পৃষ্ঠতলে।
খুবই কম বাজেটের এই ইন্ডি সাইফাই, হরর করা হয়েছে মাত্র পাঁচজনের ক্রু টিম নিয়ে। পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার স্কট বার্নস্ নিজেই সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। এমনকি মিউজিকের ক্ষেত্রেও ছিলেন ছদ্মনামে। তার একা হাতে তৈরী এই সিনেমা। সিনেমাটোগ্রাফিতে বরফশীতল একটা ভাব খেয়াল করা যায়। নীল আর ধূসরের মিউটেড কালার প্যালেট চড়ানো হয়েছে দৃশ্যগুলোতে। দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো করে রাখা হয়েছে কুয়াশাচ্ছন্ন। সারাহ চরিত্রের বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরতে প্রথম অঙ্কের পুরোটা জুড়েই বলতে গেলে সিংগেল ফ্রেমিং করেছেন স্কট বার্নস্। সারাহ ফ্রেমের একেবারে মাঝখানে। আশেপাশের সবটা থেকেই সবসময় একটা দূরত্বে থেকেছে সে। কালার প্যালেটে তো সেই বিচ্ছিন্নতা আর বিষণ্ণতা স্পষ্ট হয়েছেই।
ডাবল ফ্রেমগুলো লক্ষ করলেও সারাহ’র আলাদা হয়ে থাকাটা চোখে পড়ে জুলিয়া স্টোনের শরীরী অভিনয়ে। সেট ডিজাইনও করা হয়েছে সেভাবে। সিনেমার ধীরলয়ের পেসিং স্টাইল’টা ছন্দ খুঁজে পেয়েছে সম্পাদনায়। ভেসে ভেসে চলছে যেন। সিনেমার আবহ অনুযায়ী ইলেকট্রনিক মিউজিক যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে বিকল্প কিছু চিন্তাই করা যায়নি। সবকিছু সুসংবদ্ধ হয়েই ‘কাম ট্রু’র নিজস্ব ভিজ্যুয়াল ভাষাটাকে দাঁড় করিয়েছে।
পরিচালক স্কট বার্নস্ কম বাজেটের দুটো সিনেমাতেই নিজের ফিল্মমেকিং প্রতিভার যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে বড় বাজেটে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন, তা সারাহ’র আদিম ভয়টার মতোই গভীরে প্রোথিত। বক্তব্যের দিক থেকে ‘কাম ট্রু’ একদম সমসাময়িক। বর্তমান যুবক সমাজ নিয়েই কথা বলেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মোরাল কোড নিয়ে কথা বলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, অরিজিনালিটি দেখিয়েছে জঁনরা ক্লিশেগুলোকে এড়িয়ে। ভয়টাকে একদম স্পর্শনীয় করে তুলেছে। সিনেমার গল্প তো হলো; এখন একটাই প্রশ্ন, সারাহ’র দুঃস্বপ্নে দর্শকও পতিত হবে না তো?