গল্পের শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে। সে সময়ে ‘ওয়াল্ট ডিজনি ফিচার অ্যানিমেশন’ এ জন ল্যাসেটার নামের এক ভদ্রলোক অ্যানিমেটর হিসেবে কাজ করতেন। কোনো একদিন নিজের বন্ধুদের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ‘ট্রন’ নামক সাই-ফাই অ্যাকশন মুভির সাথে পরিচয় ঘটে তার। আর সে মুভির এক বিশেষ দৃশ্য দেখে আধুনিক কম্পিউটার জেনারেটেড অ্যানিমেশনের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ দেখতে পান তিনি। আর সে চিন্তাধারা থেকে ‘দ্য ব্রেভ লিটল টোস্টার’ ( পরে ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়) নামের অ্যানিমেশন মিউজিক্যাল ফিল্মকে সম্পূর্ণ কম্পিউটার ভিত্তিক করে তৈরি করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। কিন্তু কাজের কাজ তো কিছু হয়নিই, বরং ডিজনি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ডিজনি থেকে বের হবার পর প্রথমে তিনি লুকাস ফিল্মে কাজ করতে শুরু করেন। এরপর ১৯৮৬ সালে ‘পিক্সার’ এর যাত্রা শুরু হলে তিনি একদম প্রথম থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে পড়েন। আর এভাবেই নিজের বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেন জন।
প্রথমে ‘লুক্সো জুনিয়র’ নামে কম্পিউটার জেনারেটেড অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম দিয়ে ১৯৮৬ সালে ‘বেস্ট অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম’ ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নেন। তারপর ১৯৮৯ সালে ‘টিন টয়’ নামের অন্য আরেক অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্মের জন্যও একই ক্যাটাগরিতে অস্কার জেতেন তিনি। এটিও ছিল সম্পূর্ণ কম্পিউটার জেনারেটেড অ্যানিমেশন ফিল্ম। আর তখনই টনক নড়ে ওঠে ডিজনির। ডিজনিতে ‘দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি’ নামে নতুন গড়ে ওঠা দল তখন ল্যাসেটারকে ফিরে পেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু ল্যাসেটার ততদিনে স্টিভ জবসের (পিক্সারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা) বিশ্বস্ত কর্মচারী। তিনি এত সহজে পিক্সার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। ডিজনিও ততক্ষণে বুঝে গেল, সিনেমা নির্মাতা হবার লোভ দেখিয়ে ল্যাসেটারকে নিজেদের ঘরে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। তাই তারা নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে এতদিন ধরে বজায় রাখা ধারার বাইরে এসে পিক্সারের সাথে চুক্তিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সাধারণত ডিজনি সবসময় নিজেদের সব মুভির কাজ নিজেদের ঘরের ভেতরেই করেছে। এর আগে শুধু টিম বার্টনের ‘দ্য নাইটমেয়ার অব ক্রিসমাস’ মুভির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। ডিজনি ও পিক্সারের চুক্তি সে ব্যতিক্রমী ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ডিজনির ইতিহাসে নতুন এক যুগের আর্বিভাব হয়। ১৯৯১ সালে ডিজনিকে তিনটা সিনেমা বানিয়ে দেবার শর্তে ২৬ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে পিক্সার কোম্পানির সই করার মধ্য দিয়ে সেই নব যুগের পথচলা শুরু হয়েছিল। আর এ নব যুগ অ্যানিমেটেড ফিল্মকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিতে ‘টয় স্টোরি’ নামক এক কালজয়ী পুরোপুরি কম্পিউটার জেনারেটেড ফুল লেন্থ অ্যানিমেটেড মুভির জন্ম দেয়।
‘টয় স্টোরি’ মুভি সৃষ্টির পেছনের গল্প বলতে গেলে আরও অনেক কথাই বলতে হয়। ডিজনি ও পিক্সারের একসাথে সিনেমা নির্মাণের চুক্তির পর সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব এসে পড়ে পিক্সারের জন ল্যাসেটার, অ্যান্ড্রু স্ট্যান্টন ও পিট ডকটার এর কাঁধে। জন ল্যাসেটারের পরিচয় আগেই দেওয়া হয়েছে। সে সময়ে স্ট্যান্টন ও ডকটারের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। তবে পরবর্তীতে স্ট্যান্টন ‘ফাইন্ডিং নিমো’, ‘ফাইন্ডিং ডোরি’ ও ‘ওয়াল-ই’ এর মতো অ্যানিমেশন দুনিয়ার নামকরা সব সিনেমার নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া আরও অনেক মুভিতে গল্পকার ও সহ-প্রযোজক হিসেবেও ছিলেন। পিটার ডকটারও কিন্তু কম এগিয়ে নেই। ‘মনস্টার ইঙ্ক’, ‘মনস্টার ইউনিভার্সিটি’, ‘ইনসাইড আউট’ তো আছেই, এমনকি অ্যানিমেটেড সিনেমার মাস্টারপিস ধরা ‘আপ’ এরও সৃষ্টিকর্তা তিনি।
তবে ‘টয় স্টোরির’ আসল প্লট ও কাহিনী নির্বাচনটা অত সহজভাবে হয়নি। তিন গল্পকারের প্রাথমিকভাবে লেখা প্লট ডিজনি বাতিল করে দেয়। ডিজনি স্টুডিওর হেড জেফরি ক্যাটজেনবার্গ তখন ল্যাসেটারকে ক্ল্যাসিক কিছু বন্ধুত্ব নির্ভর গল্পের সিনেমা দেখার পরামর্শ দেন ও সেভাবেই কাহিনী তুলে ধরার উপদেশ দেন। ‘টিন টয়’ ফিল্ম থেকে শিশুদের খেলনা ভিত্তিক প্লট নিয়ে সিনেমা তৈরির আগ্রহ জাগে। এ সিনেমার মূল থিম ছিল, “খেলনা চায় শিশুরা তাদের নিয়ে খেলুক, আর এ আকাঙ্ক্ষা তাদের আশা, ভয় ও কার্যকলাপকে তাড়িত করে থাকে।” আর এ থিমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্লট ডিজনির কর্তাদের মনমতো না হওয়া অবধি সিনেমার চিত্রনাট্য বহুবার বদলাতে থাকে। এভাবেই চূড়ান্ত সংস্করণে আসতে আসতে মূল পান্ডুলিপিতে অনেক পরিবর্তন আসে।
‘টিন টয়’ সিনেমার সিক্যুয়েল বানানোর কথা মাথায় রেখে প্রথমে সিনেমার মূল চরিত্র হিসেবে টিনি ও অন্যের অনুকরণে কথা বলা এক পুতুলের (উডি) কথা ভাবা হচ্ছিল। টিন টয়ের টিনি ছিল এক ওয়ান ম্যান ব্যান্ড পুতুল, আর অনুকরণে কথা বলা পুতুল বলতে আসলে উডির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু একসময় ল্যাসেটারের মনে হতে থাকে, টিনির চরিত্রটা বড্ড বেশি সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি ওই চরিত্রকে পাল্টে প্রথমে এক মিলিটারি অ্যাকশন ফিগার নিয়ে আসেন ও পরে এক স্পেস থিম যুক্ত করে এক স্পেস রেঞ্জারকে নিয়ে আসেন। আর এভাবেই টয় স্টোরিতে আগমন ঘটে বাজ লাইটইয়ারের। উডি চরিত্রকে প্রথমে ল্যাসেটার নিজের ছোটকালে দেখা ‘ক্যাসপার দ্য ফ্রেন্ডলি ঘোস্ট’ এর চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাজালেও, পরে ক্যারেক্টর ডিজাইনার বাড লাকির পরামর্শে কাউবয়ের রূপ দেন। ওয়েস্টার্ন ও সাইফাই জনরার মিশ্রণে দারুণ কিছুর আভাস পেয়েছিলেন তিনি। সিনেমার কাহিনী ‘মিডনাইট রান’ ও ‘দ্য অড কাপল’ সিনেমা দুটো থেকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
১৯৯৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ক্যাটজেনবার্গ চিত্রনাট্য চূড়ান্ত বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সম্মতি দেন। তখন সিনেমার প্রতিটা চরিত্রে কন্ঠ দেওয়ার জন্য শিল্পীদের বাছাই করতে শুরু করেন ল্যাসেটার। উডির চরিত্রের জন্য একদম প্রথমে পল নিউম্যানকে নেওয়ার কথা থাকলেও পরে টম হ্যাঙ্কস এ চরিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। চরিত্রগুলোর জন্য একদম মানানসই কণ্ঠের শিল্পী খোঁজার ক্ষেত্রে ল্যাসেটার ডিজনির কমন এক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তিনি ‘টার্নার অ্যান্ড হুচ’ মুভির ফুটেজ থেকে হ্যাঙ্কসের কণ্ঠ অ্যানিমেটেড ক্যারেক্টারের অ্যাকশন ফিগারের উপর প্রয়োগ করে দেখেন কতটা মানিয়েছে। আর এ পরীক্ষার পর তার কাছে মনে হয় উডি চরিত্রের জন্য টম হ্যাঙ্কস থেকে যুতসই আর কেউই হতে পারে না। বাজ লাইটইয়ারের চরিত্রের জন্য সবার প্রথমে বিল ক্রিস্টালকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। যদিও টয় স্টোরি যখন এতটা সাফল্যের মুখ দেখে এ নিয়ে আফসোসের সীমা থাকে না তার। এরপর বিল মুরে, জিম ক্যারিসহ আরও অনেককে এ চরিত্রের জন্য ভাবা হলেও শেষমেশ ল্যাসেটার টিম অ্যালেনের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি তা গ্রহণ করেন।
এখানেই টয় স্টোরির মসৃণ যাত্রার শুরু নয় কিন্তু। সিনেমার কাজ শুরু হওয়ার পর দুই সপ্তাহ অন্তর ল্যাসেটার ও তার দল ডিজনিকে নিজেদের কাজের অগ্রগতি জানাতে সদ্য ধারণকৃত ফুটেজ নিয়ে দেখাতেন। ডিজনি তাদের টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও প্লট নিয়ে কোথাও যেন একটা অসন্তুষ্টি তাদের ভেতর রয়েই গিয়েছিল। পিক্সারের ডিজনির কাছে পেশ করা প্রতিটি প্রেজেন্টেশন ক্যাটজেনবার্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাদেরকে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে একদম বিস্তারিত মতামত লিখে পাঠাতেন। এভাবে ডিজনি ও পিক্সারের অনেকগুলো বৈঠক শেষে উভয় পক্ষই বুঝতে পারল, গল্পের উডি চরিত্রটাকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয়ে উঠছে না। এমনকি টম হ্যাঙ্কসও এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে সিনেমার অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হলে ল্যাসেটার সেটি ডিজনি কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করেন। তারপর কাহিনী একেবারে অন্যদিকে মোড় নেয়। ডিজনির অন্য এক নির্বাহী কর্মকর্তা স্নাইডার সিনেমাটিকে জগাখিচুড়ি বলে আখ্যায়িত করে ক্যাটজেনবার্গকে বাইরের লোকদের হাতে অ্যানিমেটেড মুভি নির্মাণে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দোষারোপ করতে থাকেন। এভাবেই পথিমধ্যে এসে থেমে যায় টয় স্টোরির প্রথম অভিযান।
কিন্ত ল্যাসেটারও এত সহজে হার মানার পাত্র নন। তিনি ক্যাটজেনবার্গ থেকে বলে কয়ে দুই সপ্তাহের সময় নেন যাতে স্ক্রিপ্টকে নতুনভাবে সাজাতে পারেন। কিন্তু নতুন করে স্ক্রিপ্ট লিখতে তাদের প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়। এ তিন মাসের মধ্যে স্নাইডার যেমন এ সিনেমার কাজ চিরতরে বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, পিক্সারের অ্যানিমেটরাও তেমনি রাত-দিন এক করে নতুন গল্প লিখতে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ক্যাটজেনবার্গের সহযোগিতার জন্য অবশ্য ডিজনি ও পিক্সারের মধ্যকার চুক্তি টিকে গিয়েছিল।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে টয় স্টোরি সিনেমার কাজ পুনরায় শুরু করা হয়। কণ্ঠশিল্পীরাও একে একে আবার নিজেদের নতুন লাইন রেকর্ডিং করতে ফিরে আসেন। সিনেমার পেছনে কাজ করা কর্মীদের সংখ্যা ২৪ থেকে ১১০ এ এসে পৌঁছায় এবার। ২৭ জন অ্যানিমেটর, ২২ জন টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, ৬১ জন শিল্পী ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে টয় স্টোরির টিম গঠন করা হয়েছিল।
অবশেষে অনেক বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বরে লস অ্যাঞ্জেলসের ‘এল ক্যাপ্টেল থিয়েটার’ এ টয় স্টোরির শুভ উদ্বোধন ঘটে। এরপর ২২ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২,২৮১টি থিয়েটারে এটি মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি প্রদর্শনীতে দেওয়ার পর মার্চে পুরো দুনিয়াব্যাপী এটি মুক্তি পায়।
এরপর টয় স্টোরির চলার পথে আর কোনো ধরনের প্রতিকূলতা তো আসেইনি, বরং অ্যানিমেটেড সিনে দুনিয়ায় নতুন এক দিগন্তের আগমন ঘটিয়েছিল টয় স্টোরি। এখন পর্যন্ত টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির চারটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যেগুলোর কাহিনী তো পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত বটেই, এমনকি মূল চরিত্রগুলোও সবক’টা সিনেমাতে একই থেকেছে। ‘আইস এজ’, ‘মাদাগাস্কার ‘, ‘শ্রেক’ কিংবা সমসাময়িক যেকোনো অ্যানিমেটেড মুভি ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে জনপ্রিয়তা ও শৈল্পিকতা উভয় দিকে ‘টয় স্টোরি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি অনেক এগিয়ে আছে।
এবার তাহলে টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা হয়ে যাক।
টয় স্টোরি (১৯৯৫)
উপরে এতক্ষণ এ সিনেমা নিয়েই মূলত কথা বলা হয়েছে। যেহেতু টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমা এটি, তাই এর মান ও ঐতিহ্য অন্যগুলো থেকে কয়েকগুণ বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। জেনে রাখা ভালো, এ সিনেমা মুক্তির প্রায় দশ বছর পর অর্থাৎ ২০০৫ সালে সিনেমাটি যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস কর্তৃক ‘ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি’তে সংরক্ষণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রি হলো অনেকটা সিনেমা জগতের জাদুঘরের মতো। সেখানে ইতিহাসের সব অলংকারতুল্য সিনেমাকে স্থান দেওয়া হয়। ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’, ‘সিটি লাইটস’ কিংবা ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ’ এর মতো যুগান্তকারী সিনেমাগুলো ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রির তালিকাতে রয়েছে।
টয় স্টোরি সিনেমার প্লট অ্যান্ডি নামের এক বাচ্চা ছেলে ও তার রকমারি খেলনা নিয়ে গড়ে উঠেছে। বাল্যকালে প্রতিটি শিশুর জীবনে তার নিজস্ব খেলনাপাতি তার ছোট্ট জীবনের একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকে। অনেকগুলো মায়া, স্মৃতি ও আবেগ জড়িয়ে থাকে সেগুলোর সাথে বাচ্চাদের। আর সবচেয়ে বড় কথা, একজন মানুষের জীবনে কাছের কিংবা প্রিয় অনেক মানুষ থাকলেও তাদের মধ্যে একজনই কিন্ত থাকে সবার চেয়ে প্রিয়, যাকে ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব যেন হারিয়ে যায়। আর ছোটকালে শিশুদের জন্য তেমনই থাকে সবথেকে প্রিয় একটি খেলনা। শিশুরা সেটিকে নিয়ে খায়, ঘুমায়, এমনকি প্রথম প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলে সেটিকে না নিয়ে স্কুলে যেতে কান্নাকাটি করে থাকে। আবার সময়ের সাথে মানুষের জীবনে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি আসে তার পছন্দ ও ভালোলাগার ব্যাপারগুলোতেও।
নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহ স্বভাবতই মানুষের বেশি, আর শিশুদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবনে যেমন সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন মানুষের আনাগোনা শুরু হয়, অনেক সময় এসব নতুন মানুষের ভিড়ে পুরনো মানুষগুলো অল্প অল্প করে দূরে সরে যায়, শিশুদের ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। তবে শিশুদের বেলায় এক্ষেত্রে জীবের তুলনায় জড় বস্তুরাই প্রাধান্য পায়। নতুন চকমকে জামা পেয়ে অনেক শিশু আগের প্রিয় জামাটা আর পরতে চায় না। তেমনি নতুন খেলনা পেলে আগের প্রিয় খেলনার প্রতি আগ্রহও কমে যায়। আচ্ছা, খেলনা যদি জড়বস্তু না হতো? খেলনার যদি একটা মন থাকত? খেলনা যদি নিজের মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারত, তাহলে? এমনই চিন্তাধারা থেকেই মূলত ল্যাসেটার টয় স্টোরি সিনেমার প্লটটি মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন।
অ্যান্ডির খেলনাগুলোর কিন্তু নিজস্ব একটা জগত আছে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত, একে অপরের সাথে হাসিঠাট্টা ও খুনসুটিতে মেতে থাকত। শেরিফ উডি ছিল অ্যান্ডির সবচেয়ে প্রিয় খেলনা। অ্যান্ডি যেমন তাকে খুব ভালোবাসত, সে-ও অ্যান্ডিকে খুব ভালোবাসত। আর অ্যান্ডির বাকি খেলনারাও সেটা মেনে নিয়েছিল। অ্যান্ডির খেলনার জগতে উডি ছিল অনেকটা নেতা গোছের। সবাই তার কথা শুনত, তাকে আলাদাভাবে সম্মান দিত। এভাবেই হেসেখেলে অ্যান্ডির সাথে দিন কেটে যাচ্ছিল উডি ও তার বন্ধুদের। কিন্তু সবকিছু পাল্টে গেল যখন জন্মদিনের উপহার হিসেবে অ্যান্ডি সে সময়ের বাজারে শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে বাজ লাইটইয়ার নামের অ্যাকশন ফিগার পেয়ে বসে। নতুন খেলনা পেয়ে আট-দশটা শিশুর মতো সে-ও আনন্দে আটখানা হয়ে উডিকে ভুলে যায়। কিন্তু উডি কীভাবে অ্যান্ডিকে ভুলবে? আর নিজের জায়গাই বা কীভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসা লাইটইয়ারকে দিয়ে দেবে? ব্যস, এই তো বেঁধে গেল খেলনায় খেলনার মহা প্রলয়।
৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে নির্মিত টয় স্টোরি সিরিজের প্রথম সিনেমা ওয়ার্ল্ডওয়াইড বক্স অফিস থেকে ৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। সর্বকালের সবথেকে আয় করা সিনেমার তালিকায় এর অবস্থান ৩২৫ তম।
রটেন টমেটোসে ৮৪টি ক্রিটিক রিভিউয়ের ভিত্তিতে সিনেমাটি ১০০% রেটিং পায়। রটেন টমেটোসে আর কোনো মুভি সিরিজ এত বেশি সমালোচক দ্বারা নন্দিত হয়নি। এমনকি মেটাক্রিটিকেও সিনেমাটি ২৬টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৫% রেটিং লাভ করে। মেটাক্রিটিকেও এ মুভি সিরিজের রেটিং অন্যান্য সব মুভি সিরিজ থেকে সর্বোচ্চ।
টয় স্টোরি সিনেমাটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ‘বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে’, ‘বেস্ট অরিজিনাল মিউজিক্যাল অর কমেডি স্কোর, ‘বেস্ট অরিজিনাল সং’ ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন লাভ করে। এছাড়া জন ল্যাসেটার এ সিনেমার পেছনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার জন্য তাকে অস্কার থেকে ‘স্পেশাল অ্যাচিভমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। তাছাড়া গোল্ডেন গ্লোবে ‘বেস্ট মোশন পিকচার’ এ মনোনয়ন পাওয়াসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার ও মনোনয়ন পেয়েছিল সিনেমাটি।
টয় স্টোরি টু (১৯৯৯)
টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির দ্বিতীয় সিনেমা টয় স্টোরি টু প্রথম সিনেমা রিলিজের চার বছর পর মুক্তি পেয়েছিল। জন ল্যাসেটার এ সিনেমার পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন।
এ সিনেমার প্লট শেরিফ উডির কিডন্যাপ হওয়ার গল্পকে কেন্দ্র করে। একজন টয় কালেক্টর উডিকে ধরে নিয়ে গেলে অ্যান্ডির বাকি সব খেলনারা দলবল নিয়ে তাকে উদ্ধার করতে বেরিয়ে পড়ে।
মজার ব্যাপার হলো, এ সিনেমাটিকে কিন্তু মোটেও থিয়েটারে মুক্তি দেওয়ার জন্য বানানো হয়নি। এ সিনেমাটি সিনেমা নয়, বরং টয় স্টোরির সিক্যুয়েল ভিডিও হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখা গেল ৬০ মিনিটের ভিডিও এ গল্পকে ৯০ মিনিট দৈর্ঘ্যের দারুণ প্লটের একটা সিনেমা রূপে পরিবেশন করা সম্ভব, তখন একে থিয়েট্রিক্যাল ফিল্ম হিসেবে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আর এ সিদ্ধান্ত যে বিন্দুমাত্র ভুল ছিল না তা প্রমাণ করতে ৯০ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে নির্মিত এ সিনেমা বক্স অফিস থেকে ৪.৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার তুলে আনে। এছাড়া সর্বকালের সেরা সিনেমার তালিকাতে ১২৯ তম স্থানটিও ছিনিয়ে নেয়।
রোটেন টমেটোসে ১৬৯টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ১০০% রেটিং ও মেটাক্রিটিকে ৩৪টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮৮% রেটিং লাভ করে সিনেমাটি।
তাছাড়া ৭২ তম অস্কারে ‘বেস্ট অরিজিনাল সং’ ক্যাটাগরিতে নমিনেশন ছাড়াও গোল্ডেন গ্লোবে বেস্ট মোশন পিকচার-মিউজিক্যাল অর কমেডি শাখাতেও মনোনয়ন পায় সিনেমাটি।
টয় স্টোরি থ্রি (২০১০)
টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির তৃতীয় সিনেমাটি দ্বিতীয় সিনেমা রিলিজের প্রায় ১১ বছর পর মুক্তি পায়। তবে এবার ল্যাসেটারের স্থানে লী আনক্রিখ সিনেমাটি নির্মাণের ভার নেন। তবে এতে কিন্তু এ ফ্র্যাঞ্চাইজির মহত্বের বিন্দুমাত্র ঘাটতি পড়েনি। বরং আগের দুটোর চেয়েও এ সিনেমা এনে দিয়েছিল চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব।
এ সিনেমার প্লট বরাবরের মতো অ্যান্ডি ও তার খেলনাদের নিয়েই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ সিনেমাতে দেখানো হয় যে, অ্যান্ডি এখন বড় হয়ে গেছে। তার বাসা ছেড়ে কলেজে পাড়ি জমানোর সময় এসে গেছে। আর ঘটনাপ্রবাহে অ্যান্ডি খেলনাগুলো এসে একটা ডে কেয়ার সেন্টারে আস্তানা গড়ে। কিন্তু ভাগ্য তাদের প্রতি যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়। একে তো অ্যান্ডিকে ছেড়ে চলে আসা, তার উপর নতুন এ বাড়িতে দুষ্ট ছেলেমেয়েদের সীমাহীন অত্যাচার। এভাবেই টয় স্টোরি থ্রি নতুন এক চমৎকার গল্প নিয়ে এক দশক পর হাজির হয়।
এ সিনেমার বাজেট যেমন আগের দুটো থেকে অনেকগুণ বেশি ছিল, আয়ও তেমনই ছিল। ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বানানো এ সিনেমা বিশ্বজুড়ে দারুণ ব্যবসা করে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কামাতে সক্ষম হয়। এটাকে পিক্সারের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে গণ্য করা হয়। সর্বকালের সেরা সিনেমার তালিকায় এর স্থান হয় ২৮ তম।
রটেন টমেটোসে ৩০৪টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৮% ও মেটাক্রিটিকে ৯২টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯২% রেটিং পায় সিনেমাটি। তবে সিনেমাটির সেরা অর্জন ছিল ৮৩ তম অস্কারে সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্মের পুরস্কার জিতে নেওয়া।
এ বছরের জুন মাসে মুক্তি পেয়েছে টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির চতুর্থ সিনেমা। এখন পর্যন্ত বক্স অফিসে আয় থেকে শুরু করে ক্রিটিক রেটিং সবকিছু ভালোই চলছে। তৃতীয় সিনেমার প্রায় ৯ বছর পর মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমা বলে দিতে পারে সামনে টয় স্টোরি ফ্র্যাঞ্চাইজির চলার পথ কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।