প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ছিল পৃথিবীর প্রথম একক নির্মিত সভ্যতা। পিরামিডের মতো বিশাল স্তম্ভই তাদেরকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্মাতার স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সংস্কৃতি এখনকার যুগের মানুষদেরও ভাবায়। হাজার হাজার বছর আগে তারা কী করে এতটা উন্নত আর আধুনিক জীবনযাপন করেছে, তা এখনও এক রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।
সতেরো শতকের একদম শেষভাগে ফরাসি সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিশরে বিজয়ের পতাকা ওড়ান। তার এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে মিশরতত্ত্ব বা মিশরীয় পুরাতত্ত্ব, আধুনিক সময়ের হিসেবে নতুনরূপে পুনরায় উত্থাপিত হয়। ইংরেজিতে তা ‘ইজিপ্টোলজি’ নামে পরিচিত। ঠিক দু’শো বছর পর ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার মিশরের তেহবান পাহাড়ের রাজাদের উপত্যকা বা ভ্যালি অভ দ্য কিংস থেকে তুতেনখামুনের সম্পূর্ণ রক্ষিত সমাধি এবং সমাধিস্থ গুপ্তধন আবিষ্কার করেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে তা এক অবিস্মরণীয় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ছিল। এরপর থেকেই মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই প্রাচীন মানবসভ্যতার রহস্যময় জীবন অনুসন্ধানে ছুটে আসতে শুরু করেন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে।
প্রত্নতাত্ত্বিক আর ইতিহাসবিদগণ মিশর সম্পর্কে একটি প্রবাদবাক্য বলে থাকেন; মিশর এমন এক অঞ্চল, যেখানে প্রতিদিন মরুভূমির খানিকটা বালি সরালেই বেরিয়ে আসে কোনো এক অতীত ইতিহাস। কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। এই তো ২০২০ সালের গ্রীষ্মতেও কায়রোর দক্ষিণে সাকারা নেক্রোপলিস থেকে উদ্ধার করা হলো প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রাচীন কফিন। সাথে পাওয়া গেল ৪০টিরও বেশি সোনার ভাস্কর্য-মূর্তি আর প্রতিমা।
বর্তমানে মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় অনেকগুলো দল নির্দিষ্ট ইতিহাস বা ব্যক্তি কিংবা সময়ের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সন্ধানে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেউ আবার প্রাচীন এসব ইতিহাস আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর এসব প্রত্নতাত্ত্বিক দলের সঙ্গে রয়েছে বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ক্যামেরা দল। একদম ফ্রন্টলাইনে থেকে ন্যাটজিওর করা এসব ভিডিওগ্রাফি মিলিয়েই তৈরি করা হয়েছে ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘লস্ট ট্রেজার্স অফ ইজিপ্ট’। আজকের আয়োজন এই ডকুসিরিজকে কেন্দ্র করেই। তবে তার আগে খানিকটা ইতিহাস জেনে নেয়া যাক।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার মূল সময়সীমা হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৫২৫ অব্দ পর্যন্ত। উত্তরে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে নুবিয়ার মরুভূমি, পূর্বে লোহিত সাগর এবং পশ্চিমে লিবিয়ার মরুভূমি ঘিরে রয়েছে দেশটিকে। তবে এরকম একটা শুষ্ক অঞ্চলে নীলনদ প্রাণ আর প্রাচুর্য দিয়েছিল। এভাবেই মিশরে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। মূলত খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকেই মিশরীয়রা নীলনদের তীরে বসতি স্থাপন করে। এবং জীবিকা নির্বাহে কৃষিকাজ শুরু করে। ৫০০০-৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও মিশরে কোনো ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রকাঠামো ছিল না। তখন মিশর দু’ভাগে বিভক্ত ছিল- অভিজাত এলাকা (Upper Egypt) এবং সাধারণ জনগণের এলাকা (Lower Egypt)।
তবে এই সময়ের মধ্যেই মিশরের অধিবাসীরা অনেকটা আধুনিক হয়ে উঠেছিল। লিখন পদ্ধতি, প্যাপিরাস ও কালি এবং ক্যালেন্ডারের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করেছিল তারা এই সময়েই। ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দুই মিশর একত্র হয় এবং এক রাষ্ট্রকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে বৈশিষ্ট্যের বিচারে প্রাচীন মিশরের ইতিহাসকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়।
আর্কাইক বা প্রাচীনতম যুগ ৩১১০-২৭৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, প্রাচীন রাজবংশ বা ওল্ড কিংডম ২৭৭০-২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, প্রথম আন্তঃযুগপর্ব বা ফার্স্ট ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড ২২০০-২০৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, মধ্য রাজবংশ বা মিডল কিংডম ২০৫০-১৭৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, দ্বিতীয় আন্তঃযুগপর্ব বা সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড ১৭৮৬-১৫৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং নতুন রাজবংশ বা নিউ কিংডম ১৫৮০-৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে মিশর পারস্যের অধীনে চলে যায়। এরপর প্রায় দু’হাজার বছর মিশর রোমান, গ্রিক, আরব এবং তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
অতীত ছেড়ে বরং বর্তমানে ফেরা যাক। ন্যাটজিওর এই ডকুসিরিজ দুই সিজনে বিভক্ত, আছে ১৪টি এপিসোড। প্রতি এপিসোডের গড় সময় ৪৪-৪৫ মিনিট করে। কিন্তু একবার দেখতে বসলে মুহূর্তেই যেন ফুরিয়ে যায় ঘণ্টার কাছাকাছি এই সময়ও। প্রতিটি পর্বের চিত্রনাট্য তিনটি আলাদা ভাগে সাজানো হয়েছে। অর্থাৎ, কেবলই একটা গল্পকে কেন্দ্র করে এগোয়নি গল্প। বরং বৈচিত্র্যের জন্যই তিনটি আলাদা গল্প মিলিয়ে একটা পর্ব দেখানো হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, ডকুমেন্টারি হলেও চিত্রনাট্যে ছিল ফিকশনের মতোই বৈচিত্র্য। তাছাড়া, প্রতি এপিসোডের শেষে দর্শকদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে রহস্যকে যেভাবে ঘনীভূত করে রাখা হয়েছে; সত্যিই তা প্রশংসার দাবিদার।
প্রথম সিজনের প্রথম পর্ব মিশরের বিখ্যাত এবং তরুণ ফারাও তুতেনখামুনের সমাধি এবং সংরক্ষিত গুপ্তধনকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি আসওয়ানের প্রাচীন নেক্রোপলিস কুবেত-আল-হাওয়াতে স্প্যানিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আলেহান্দ্রো প্রায় ৪,০০০ বছর পুরনো এক কফিন আবিষ্কার করে। কিন্তু কফিনটির মালিক কে? দ্বিতীয় পর্বে গিজার পিরামিডের ছায়ায় এক কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। যেহেতু পিরামিডের কাছে তাই ধরেই নেয়া যায় যে, ফারাওয়ের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ ছিলেন এই কবরের মালিক। কিন্তু কে সে? তৃতীয় পর্বটির নাম ক্লিওপেট্রা’স টম্ব। মিশরের অন্যতম রহস্যময়ী এই নারীর জীবন সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায়নি; তেমনই মৃত্যুর পর তার সমাধির ঠিকানাও এখন অবধি উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক ক্যাথলিনের কাছে কিছু সম্ভাব্য জায়গার হদিস আছে; যেখানে হলেও হতে পারে ক্লিওপেট্রার শেষ সমাধি।
চতুর্থ পর্বের নামই হচ্ছে ‘টম্ব রেইডার’। খুব সহজ বাংলায় বললে কবর চোর। এমনকি ফারাওদের সময়েই এদের অস্তিত্ব ছিল। কোনো সমাধিতে ঢুকে সেখানকার সোনাদানা লুট করার পর মমির অভিশাপ থেকে বাঁচতে সেগুলোকে আগুনে জ্বালিয়ে দিত তারা। এভাবেই অসংখ্য মমি আর সমাধি ধ্বংস করেছে তারা। পঞ্চম পর্বে উঠে এসেছে এক সাহসী নারীর কথা, যিনি আদতে একজন ফারাও ছিলেন। ফারাও প্রথম থটমোসের কন্যা ছিলেন হাতশেপসুত। একজন সফল ফারাও হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব আর অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে গিয়েছিলেন, সম্ভবত বিশ্বের প্রথম এই নারী শাসক। কার্নাকের বিখ্যাত এভিনিউ অভ র্যামসও তারই করা। তাছাড়া, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পাহাড় কেটে তিনি যে দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তা সত্যিই এক আশ্চর্য।
ষষ্ঠ পর্ব প্রাচীন মিশরীয়দের মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের অভিশাপকে কেন্দ্র করে বানানো। কী ছিল তাদের ধর্মবিশ্বাস? আর কেনই বা তারা যাপিত জীবনের পুরোটাই ব্যয় করতো মৃত্যু পরবর্তী জীবনের আশায়?
সত্যিকার অর্থে ইতিহাসপ্রেমী যে কেউ যদি প্রথম সিজন দেখার পর ভাবে, দ্বিতীয় সিজন নেই; তাহলে আশাহত হবারই কথা। কেননা, ন্যাটজিওর এই ডকুসিরিজ থ্রিলার সিনেমার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। প্রথম সিজন শেষ করামাত্রই দর্শক খাতা-কলম আর প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের গ্রন্থ নিয়ে বসে পড়বে হিসেব মেলাতে। অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই প্রথম সিজনটা শেষ করেছে ন্যাটজিও কর্তৃপক্ষ। তবে খুব বেশিদিন সেজন্য অপেক্ষা করতে হয়নি উৎসুক দর্শককে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের পরবর্তী মৌসুম শেষ হবার আগে আগেই দ্বিতীয় সিজন প্রকাশ করে তারা। প্রথম সিজনে কেবল ছয় পর্ব থাকলেও দ্বিতীয় সিজনে ছিল আটটি।
দ্বিতীয় সিজনের শুরুও প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার তুতেনখামুনকে নিয়েই। রহস্য সমাধানের পাশাপাশি দারুণ একটা সুসংবাদ ছিল এ পর্বে। মিশর সরকার প্রথমবারের মতো গিজাতে দ্য গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম বা গিজা মিউজিয়াম নামে একটি যাদুঘর এবং গবেষণাকেন্দ্র চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে তুতেনখামুনের সমাধিতে প্রাপ্ত প্রায় পাঁচ হাজার শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হবে দর্শনার্থীদের জন্যে। এটি কেবলই যাদুঘর নয়, বরং উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন এক গবেষণাগারও বটে।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম একটি রহস্য হচ্ছে স্ফিংস। সিংহের আদলে মানুষের মুখ দেয়া এক পৌরাণিক প্রাণী, যাকে মিশরীয়রা পিরামিডের রক্ষাকর্তা বলেই বিবেচিত করত। কিন্তু স্ফিংসের নির্মাণের পেছনে মূল কারণ কী? স্ফিংসের রহস্য সমাধানের চেষ্টাই করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্বে।
ক্লিওপেট্রার কথা মনে আছে? প্রথম সিজনে ক্যাথলিন বেশ কিছু জায়গা নির্ধারণ করেছিল তার সমাধি খুঁজে পাবার আশায়; কিন্তু খননকাজ চালানোর আগেই তার অনুমতির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় সিজনের তৃতীয় পর্বে তাই ক্যাথলিন ফিরে এসেছে পুনরায় প্রাচীন মিশরের এই রহস্যময়ী নারীর সমাধির খোঁজে। তার এই চেষ্টা কি সফল হয়? প্রাচীন বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের একটি এবং বর্তমানে একমাত্র টিকে থাকা স্থাপত্য হচ্ছে দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা। মূলত ফারাও সম্রাটদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্মিত হয়েছিল এই বিশালাকার সমাধিসৌধ। কিন্তু এই স্থাপত্যশৈলীর পেছনে কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে? এই দৃষ্টিনন্দন, অথচ জটিল স্থাপত্যশৈলীর পথিকৃৎ স্থপতি কে ছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সাজানো হয়েছে চতুর্থ পর্ব।
প্রাচীন মিশরের আরেক রহস্যময়ী নারী রানী নেফারতিতি। ফারাও আখেনাতেন স্ত্রী ছিলেন তিনি। নেফারতিতি সম্পর্কেও খুব বেশি তথ্য ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বারবারই নেফারতিতির জীবন ইতিহাসের পাতা থেকেই মুছে গিয়েছে। তার সম্পর্কে দারুণ আর চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য নিয়ে নির্মিত পঞ্চম পর্ব। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সফল ফারাওদের তালিকা তৈরি করা হলে সবার উপরে চলে আসবে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের কথা, যাকে রামেসিস দ্য গ্রেট নামেও ডাকা হয়। প্রথম সেতির পুত্র রামেসিস প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ব্যাপক প্রভাবশালী এক ফারাও হিসেবেই গণ্য। কিন্তু তার এত সফলতার পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাল্ট। সেসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ষষ্ঠ পর্বে।
সপ্তম পর্ব মূলত চতুর্থ পর্বের দ্বিতীয় ভাগ বলা চলে। এ পর্বেও পিরামিড নিয়ে সর্বশেষ আবিষ্কার এবং তথ্যের কথা প্রকাশ করা হয়েছে। আর সিজনের শেষ পর্ব ছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুকে ঘিরে। আর তা হচ্ছে মমি। প্রত্নতাত্ত্বিক আলেহান্দ্রো যে মমিগুলো উদ্ধার করেছে, সেগুলো স্ক্যান করে দারুণ সব তথ্য দিয়ে বিশ্বকে অবাক করতে সক্ষম হয়েছে সে। সিজন শেষ হলেও একটা রেশ রয়েই যায় নতুন আর পরবর্তী সিজনের আশায় আর অপেক্ষায়।
লাইভ অ্যাকশন সিনেমাটোগ্রাফি হওয়াতে এই সিরিজের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল টানটান উত্তেজনাময়। খননকারীরা খুঁড়ছে, আর আপনি যেন ক্যামেরার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। নতুন কিছু পাবার যে আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দ, সেটা যেন পর্দার এপার থেকেও অনুভব করা যায়। পাশাপাশি নতুন আবিষ্কারের প্রথম কৃতিত্ব স্বয়ং প্রত্নতাত্ত্বিক আর দ্বিতীয়ত আপনার। কেননা, প্রত্নতাত্ত্বিক একা না গিয়ে ক্যামেরার সঙ্গে আপনাকেও সেই সাড়ে চার হাজার বছরেরও প্রাচীন সমাধিতে নিয়ে যায়। আবার, একইসঙ্গে অনেক কষ্ট করে খনন শেষে যখন দেখা যায়, ভেতরে কিছুই নেই; তখন বিষণ্নতা ভর করে দর্শকের উপরও।
পুরো সিরিজ জুড়েই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের চিন্তাচেতনা ও নানা দিক ফুটে উঠেছে। দর্শক অনেক অজানা ইতিহাসও জানতে পারবে এর মাধ্যমে। ফারাওরাও যে জনগণের অগোচরে অদ্ভুত সব কাল্ট পালন করতেন, সেসব উঠে এসেছে এ সিরিজের গল্পে। মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে তাদের এত ভাবনা কোথা থেকে বা কী করেই এলো? সেসব নিয়েও আছে বিস্তর আলাপ-আলোচনা।
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, এ জীবন নশ্বর; মৃত্যু-পরবর্তী জীবন হচ্ছে অবিনশ্বর। তাই তারা এই নশ্বর জীবনের পুরোটাই ব্যয় করতো অবিনশ্বর জীবনে একটুখানি সুখের আশায়। সেজন্যই মৃত্যুর পর তারা নিজেদের দেহ সংরক্ষণের জন্য মমি করাত। এবং পরবর্তী জীবনে যা যা প্রয়োজন, তা দিয়ে সমাধিস্থ করা হতো তাদের। এগুলো ছাড়া আরো কিছু বিষয় ছিল, যেগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিত তারা।
প্রথমটাকে বলা হয় রেন, যার অর্থ মৃত ব্যক্তির নাম বা পরিচয়। মৃত ব্যক্তি ততদিন অবধি জীবিত থাকবেন, যতদিন জীবিতরা তার নাম জপবে। ইব হচ্ছে হৃদয় যা আত্মার মূল চালিকাশক্তি। এটি আবার মৃতের দুই জীবনেরই ভালো কাজের সঙ্গী। শেউট হচ্ছে ছায়া; ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি, যা প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে নতুন করে জন্ম নেয়। বা হচ্ছে ব্যক্তির অনন্য ব্যক্তিত্ব, যা পাখির রূপে প্রতিদিন রাতে এবং মৃত্যুর পর দেহ ছেড়ে চলে যায়। কা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান, যা ব্যক্তিকে মৃত্যুর পরও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে। এবং খাত হচ্ছে শরীরি অবয়বের নাম, যা মূলত মমি করে সংরক্ষিত করতে হবে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সফলতার জন্য।
উপরোক্ত কথাগুলো কারো ব্যক্তিগত অভিমত নয়; বরং এটি সিরিজের একটি পর্বের ব্যাখ্যা। দর্শকদের বোঝার সুবিধার্থে এমনই গবেষণামূলক কাজ করেছে ন্যাটজিওর চিত্রনাট্যের দল। পাশাপাশি আরো ভালো করে বোঝানোর জন্য নেওয়া হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতা। থ্রি-ডি ডিজাইনে যখন প্রাচীন মিশরের রূপ দেখানো হয়, তখন সত্যিকার অর্থেই মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয় যেন দর্শক ফিরে যায় সেই হাজার বছর অতীতে। থ্রি-ডি ডিজাইনগুলো অত্যন্ত নিখুঁত এবং অ্যানিমেটেড ছিল। এই থ্রি-ডি ডিজাইনগুলো এমনকি তেহবান পাহাড়ের গহিনে খনন করা ভ্যালি অভ দ্য কিংসে সমাধিস্থ বিভিন ফারাওয়ের চেম্বারেও নিয়ে যায় দর্শকদের।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা কালের পরিক্রমায় বিলীন হয়ে যাওয়া কোনো স্থাপত্যশৈলীর থ্রি-ডি রূপ সত্যিই মুগ্ধ করে। তাছাড়া আগে মমি করা লাশের ভেতরটা পরীক্ষা করার জন্য লিনেনের পরত খুলতে হতো। কিন্তু বর্তমান এক্স-রে প্রযুক্তির কল্যাণে তা আর করতে হয় না। মমি অক্ষত রেখেই এক্স-রে যন্ত্রে দেখা যায়, ভেতরে কী আছে এবং মমি আসলে কার? সিরিজে দেখানো এই প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো সত্যিই অভাবনীয়।
যদি ইতিহাসপ্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এই ডকুসিরিজ আপনারই মতো দর্শকদের জন্য। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট হবে না, তার নিশ্চয়তা থাকছে। এমনও হতে পারে, সিরিজ দেখে নতুন করে আবারও প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রেমে মজে যেতে পারেন। তবে সাম্প্রতিককালে নেটফ্লিক্স প্ল্যাটফর্মেও একটা ডকুফিল্ম প্রকাশ পেয়েছে, ‘দ্য সিক্রেট অফ সাকারা টম্ব’ নামে। চাইলে ওটা আগাম দেখে নিতে পারেন।
এই যে প্রাচীন মিশরীয়রা পরবর্তী জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এত এত কর্মযজ্ঞ সাধন করেছিল, আসলে কি তারা সফল হয়েছিল? যদি সফলই না হবে, তাহলে এখনও কেন ফারাওদের নাম নেই আমরা? কিংবা এখনও কেন তাদের অতীতের জীবন নিয়ে আমাদের এত কৌতূহল?