বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে আলোচিত তার পল্লী-প্রকৃতিঘনিষ্ঠ অসাধারণ উপন্যাসগুলোর জন্য। আমরা অধিকাংশই তাকে কেবল পল্লীবাংলার রূপকার পরিচয়েই চিনি। আদতে সব্যসাচী বিভূতিভূষণ তার সাহিত্যিক জীবনে সামাজিক উপন্যাসের সাথে একাধারে লিখে গেছেন হরর, থ্রিলার এবং দুর্দান্ত কিছু কিশোর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আমরা পাই অজপাড়াগাঁয়ের বাঙালি সন্তান শংকরের আফ্রিকা অভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনী ‘চাঁদের পাহাড়’-এ। আলোচ্য ‘হীরা মানিক জ্বলে’-ও অনুরূপ অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার ঘরানার উপন্যাস। উপন্যাসটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। কলেবর, বিস্তৃতিতে ‘চাঁদের পাহাড়’ এর সাথে তুলনীয় না হলেও রহস্যে-রোমাঞ্চে এই বইটি যে কোনো অংশে কম নয়, সেই আশ্বাস নব্যপাঠককে দেওয়াই যায়!
এ উপন্যাসের মূল অভিযাত্রী তিন বাঙালি যুবক— সুশীল, সনৎ আর জামাতুল্লা। সুশীল খানদানি বংশের সন্তান, পড়ন্ত জমিদারির উত্তরাধিকারী। কালের গর্ভে সেই জমিদারি অনেকটাই অবলুপ্ত, যা অবশিষ্ট আছে তা নেহায়েত ফাঁপা ঢাকের মতো। এরপরেও এ বংশে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করা মানা, ভারিক্কি জমিদারি চাল নষ্ট হবে যে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে খেতে একসময় ‘জমিদারি’ শব্দটাই ব্যঙ্গ করতে শুরু করে তাদের। হালচাল যখন এরূপ, তখন টনক নড়ে সুশীলের। ভাগ্য ফেরাতে কলকাতা শহরে মামার বাসায় ওঠে বেকার সুশীল। সনৎ তার মামাতো ভাই, খুব ন্যাওটা। জামাতুল্লা জাহাজের খালাসি।গড়ের মাঠে উদাসভাবে বসে থাকা সুশীলের সাথে একদিন আকস্মিকভাবেই পরিচয় হয় জামাতুল্লার। অল্প সময়েই সখ্য হয় তাদের।
সে বর্ণনা করে তার এক রোমাঞ্চকর সমুদ্রযাত্রার, যেখানে নাম না জানা এক দ্বীপে সে আবিষ্কার করে বসে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ভগ্নাংশ। জামাতুল্লার দেখানো অদ্ভুত চিত্র আঁকা সিলমোহর আর কিছু মানচিত্র এবং একজন ঐতিহাসিক কর্তৃক তার রহস্যময় বর্ণনা সাহসী সুশীলকে হাতছানি দিতে থাকে অ্যাডভেঞ্চারের। প্রাচীন সভ্যতা আর তার গুপ্তভাণ্ডার আবিষ্কারের নেশায় ভাই সনৎ, জামাতুল্লা এবং বোম্বেটে নাবিক ইয়ার হোসেনকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রযাত্রায়। মালয়, সুমাত্রা পেরিয়ে তারা পৌঁছায় ভারত মহাসাগরে ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ এক জনহীন দ্বীপে। সেখানে তারা আবিষ্কার করে প্রাচীন হিন্দু রাজ্যের রাজধানী এক প্রাচীন রাজপ্রাসাদ— চারপাশে তার খাল কাটা, সেখানে বিচরণ করে ভীষণদর্শন কুমির; বিকট প্রস্তরমূর্তি যেন জানান দেয় অশুভের।
তারা জানে, এর মধ্যেই রক্ষিত আছে এই সভ্যতার ধনসম্পদ, কিন্তু প্রত্যেক পদে পদে তাদের জন্য পাতা রয়েছে মৃত্যুফাঁদ, ভয়ংকর বিপদের আমন্ত্রণ। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সেসব ধনসম্পদ আর সভ্যতাচিহ্নের খোঁজ তারা পাবে কি? বিপুল রত্নভাণ্ডার নিয়ে পারবে কি দেশে ফিরতে? নাকি অন্য অনেক অভিযাত্রীর মতোই বরণ করতে হবে করুণ নিয়তি? টান টান উত্তেজনার সে গল্পই বলবে ‘হীরা মানিক জ্বলে’।
কিশোরদের জন্য এটি একেবারে আদর্শ অ্যাডভেঞ্চারের বই। বড়দেরও নিষেধ নেই, বিভূতিভূষণ এক টানে নিয়ে যাবেন কৈশোরের রোমাঞ্চে। অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গিতে পুরো বই জুড়ে রয়েছে বিচিত্র রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। চীনা জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি, দুর্ধর্ষ জলদস্যু, গুপ্তঘাতক, অলিতে গলিতে রহস্যে ঘেরা রেইন ফরেস্ট, প্রাচীন দুর্গ, খতরনাক জন্তু-জানোয়ার আর সরীসৃপের আড্ডা, গুপ্তধন— কী নেই বইটিতে! স্থির, স্থবির, নিস্তরঙ্গ জীবনের বিপরীতে রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার মাহাত্ম্যের যে দর্শন ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শংকরের মুখে আমরা পাই, এখানেও সুশীলের মুখে তার ব্যঞ্জনা বিন্দুমাত্র কমেনি।
তবে, এ উপন্যাসের সুশীল ঠিক ‘শংকর’ হয়ে উঠতে পারেনি। শংকরের মতো স্বপ্ন, ভাবালুতা, উপলব্ধি তার মধ্যে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্রের দৃঢ়তা সে অর্জন করে উঠতে পারেনি। হয়তো বিভূতিভূষণ সজ্ঞানেই তা করেছেন, ব্যক্তিচরিত্রকে প্রধান্য না দিয়েই রোমাঞ্চের আমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন— সেদিক দিয়ে তাকে সফলই বলব। তবে ‘চাঁদের পাহাড়’ এর মতো করে এখানেও যৌবনের যে গতিময়তা, যে সাহসিকতা, তাকে নিস্তেজ না হতে দিয়ে পুরোদমে ব্যবহার করার প্রেরণা দিয়েছেন লেখক —
“পৃথিবীর কত পর্বতে, কন্দরে, মেরুতে, অরণ্যে অজানা স্বর্ণরাশি মানুষের চোখের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে— বেরিয়ে পড়তে হবে সেই লুকোনো রত্নভাণ্ডারের সন্ধানে— যদি পুরুষ হও! নয়তো আপিসের দোরে দোরে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মতো ঘুরে ঘুরে সেলাম বাজিয়ে চাকুরির সন্ধান করে বেড়ানোই যার একমাত্র লক্ষ্য ,তার ভাগ্যে নৈব চঃ নৈব চঃ!”
পরিবেশ-প্রকৃতির বর্ণনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। চতুর্পার্শ্বকে দেখার এরকম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, আর তার অসাধারণ বিবরণের পরতে পরতে অনবদ্য জীবনদর্শন পুরে দেওয়া হয়তো শুধু বিভূতিভূষণের পক্ষেই সম্ভব। বইটির আরেকটি বিশেষ দিক হলো, প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্যের কথা। বিভূতিভূষণ তার লেখায় তুলে এনেছেন ভারতীয় রাজাদের বিস্মৃতপ্রায় এক অতীতকে, বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া ভারতীয় শৌর্য আর বীরত্বের ইতিহাসকে। আজ থেকে শত শত বছর আগে ম্যাপ বা কম্পাস ছাড়াই ভারতীয়রা যে অজানাকে জানতে বের হয়েছে, বীর যোদ্ধারা মহাসাগর পেরিয়ে দূরদ্বীপ জয় করে ভারতের ঝাণ্ডা উড়িয়েছে— সেসবের বর্ণনা দিয়ে বিভূতিভূষণ সুশীলের মানসপটে কাঠগড়ায় তুলেছেন তৎকালীন বিদেশী শাসনে পদানত পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ঘরকুনো ভারতকে।
অকল্পনীয় কিন্তু অনিবার্য অতীতের ভারতীয় গর্ব-বীর্য-শৌর্যের স্মারক সেই পুরাকীর্তিগুলো থেকে সুশীল যেন বীররস আহরণ করে নেয়, সন্নিকটে বহমান সাগরের মতোই প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার আত্মা যেন আলোড়ন তোলে সুশীলের মানসরোবরে। হৃদয়ের দীপশলাকায় জ্বলে ওঠে বৃহত্তর মহতোমহীয়ান ভারতবর্ষ! আর আমরা বরাবরের মতোই অক্লেশে আবিষ্কার করি বিভূতিভূষণের অসাধারণত্বকে।
শেষত, মহাসমুদ্রপাড়ের প্রাচীন হিন্দুরাজ্যের অরণ্যাবৃত ধ্বংসস্তুপ, বিপদজনক যাত্রা, রহস্যময় প্রাসাদ, উত্তরাধুনিক সাহিত্যের উপকরণ ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তবতা’র ঢং, নাটকীয় পরিণতি এবং জীবনের গভীর বিচিত্র রহস্যের সন্ধান— সবমিলিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চের এ বইটি পাঠককে এক ভিন্ন, তবে উৎকৃষ্ট স্বাদ দেবে, তা হলফ করেই বলা যায়।
পাঠ উপভোগ্য হোক!
অনলাইনে বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে: