বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একটি অনন্য নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। জীবনকে স্বাভাবিক আঙ্গিকে পর্যবেক্ষণ না করে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন আরেকটু ভিন্ন আঙ্গিকে। তাই তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে রয়েছে সাধারণ কিছু অসাধারণভাবে দেখার প্রয়াস, রয়েছে ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া ছিল, তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম ছবি ‘হিরের আংটি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯২ সালে। ঐ একই সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘উনিশে এপ্রিল’ এর জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর একে একে ‘শুভ মহরত’ (২০০৩), ‘রেইনকোট’ (২০০৪), ‘অন্তরমহল’ (২০০৫), ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ (২০০৭), ‘খেলা’ (২০০৮), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮), ‘আবহমান’ (২০০৯), ‘নৌকাডুবি’ (২০১০), ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ (২০১১), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (২০১২), ‘জীবনস্মৃতি’র (২০১২) মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নিমার্ণের মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছেন। চলচ্চিত্রে জগতে তাঁর মৌলিকত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলো থেকেও পেয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়জগৎ, কাহিনিসৃজন, চিত্রনাট্য এবং সংগীত রচনার মতো কাজগুলোতেও তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখে গেছেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মিত একমাত্র হিন্দি চলচ্চিত্র ‘রেইনকোট’। বলিউডের জগতে তাঁর নির্মিত এই একমাত্র চলচ্চিত্রেও তিনি মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। এ চলচ্চিত্রের কাহিনি খুব ছোট, কিন্তু এর গল্পের অভিনবত্ব, আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এবং পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে থাকা বাদল দিনের কাব্যিক কোমলতা একে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। কালজয়ী আমেরিকান ছোটগল্পকার ও হেনরীর বিখ্যাত গল্প ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’য়ের ছায়া এ চলচ্চিত্রে রয়েছে। মূল গল্পের জিম ও ডেলার ত্যাগী মনোভাবের সাথে এ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র দুটির মনোভাবের মিল ব্যতীত এর চিত্রনাট্যের মৌলিকত্ব ও অভিনবত্ব অনন্য।
বেকার মনোজ (অজয় দেবগন) ব্যবসা করার জন্য তার পুরনো বন্ধুদের কাছে সাহায্য চাইতে কলকাতায় আসে। এক বৃষ্টিভেজা দিনে সে দেখা করতে যায় পুরনো প্রেমিকা নীরজার (ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন) সাথে। প্রেমের বেদনাদায়ক গল্পগুলো ঠিক যেমন হয়, এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। মনোজের চেয়ে বিত্তবান পরিবার পাওয়ায় দূর শহর কলকাতায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নীরজার। বেচারা মনোজ কোনোভাবে ঠেকাতে পারেনি সেই বিয়ে। কিন্তু প্রেম কি এত সহজে মরে যায়? বহু বছর পরেও তার শুধু একবার দেখা করবার সাধ জাগে। অবশেষে দেখা হলেই তাদের স্মৃতিময়তার দেয়ালে আঘাত লাগে। মুহূর্তেই দুজন দুজনের কাছে সেই পুরনো মান্নু এবং নীরু হয়ে ওঠে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর নিজস্ব স্টাইলে এ চলচ্চিত্রের গল্পটি বলেছেন অন্যরকম করে। বাদল দিনে গল্প করতে করতে ফ্লাশব্যাকে নায়ক মনোজের মাথায় বারবার তাদের পুরনো স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে ভাগলপুর নামের দূর মফস্বলে তাদের পুরনো প্রেম এবং তার করুণ পরিসমাপ্তির গল্প। পাশাপাশি সমান্তরালে উন্মোচিত হয়েছে বর্তমানে দুজনের করুণ অবস্থা এবং অনবরত মিথ্যা বলে সেই করুণ অবস্থা ঢেকে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। বেকার মনোজ টিভি সিরিয়ালের ব্যবসা করে তার আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের গল্প বলে নিজেকে ধনী এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও সুখী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে। অন্যদিকে ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মনে হলেও দেখা যায় নীরজার বিয়ে হয়েছে এক ভণ্ড এবং মাতাল ঋণগ্রস্ত লোকের সাথে। আর্থিক অনটন এবং মানসিক অশান্তির সাথে লড়াই করছে দুজনই। কিন্তু কেউই তা না প্রকাশ করে নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মিথ্যা গল্প করেই চলেছে।
এরপর হঠাৎ গল্পে মোড় নেয়। নীরুর অনুপস্থিতিতে বাড়ির মালিক ভাড়া চাইতে এলে নীরুর করুণ অবস্থা, সংসারের অভাব ও দারিদ্র্য মনোজের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়। দুজনের অজান্তেই দুজনের সব গোপন কথা সত্যের আপন নিয়মে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও দুজন মিথ্যা বলতে বলতে আপ্রাণ অভিনয় করে যায়। মিথ্যার আড়ালে বিষাদময় জীবনের যে হাহাকার তা দর্শক হৃদয়েও করুণরসের সৃষ্টি করে। চলচ্চিত্রটির সাথে এক অন্যরকম একাত্মতা অনুভূত হয়।
ও হেনরীর গল্পটির মতোই এ চলচ্চিত্রের গল্পের শেষে দর্শকদের জন্য একটি বড় চমক রয়েছে।
মনোজ অথবা নীরু- কারো প্রায়শ্চিত্ত বা প্রতিশোধ নয়, বরং এখানে জয় ঘটেছে প্রেমের। মোমবাতির আলোর মতো কোমল প্রেম, যাতে আশা আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা নেই বটে, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করারও সুযোগ নেই।
সবাইকে এক হালকা বিষাদে আচ্ছন্ন করে এ চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটে। বৃষ্টির দিনে বন্ধুপত্নীর দেওয়া একটি রেইনকোট এ চলচ্চিত্রের গল্পের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হওয়ায় চলচ্চিত্রটির নাম ‘রেইনকোট’।
স্বাভাবিক জীবনের আড়ালে আমাদের একান্ত নিজস্ব এক জগৎ থাকে। জীবনের কিছু গল্প হয়তো কাউকে বলা যায় না। এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো অসাধারণ ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। মনোজ যখন তাঁর বন্ধুপত্নীকে জিজ্ঞাসা করে, “বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় মেয়েরা এত কাঁদে কেন? এটা কি শুধু প্রিয়জনদের ছেড়ে আসার কষ্ট, না কি অন্যকিছু?” বন্ধুপত্নী এর উত্তর এড়িয়ে যেয়ে বলে, “বাথরুমে কান্নার সময় শাওয়ার অন করে নিলে কান্নার শব্দ বাইরে আসে না। কিছু ব্যাপার আপনারও মেয়েদের কাছ থেকে শেখার আছে।” এরপর দুজনের মাঝে নীরবতা নেমে আসে। আর কোনো কথা হয় না। এই সূক্ষ্ম প্রকাশভঙ্গিগুলো দর্শকের নিজস্ব জগতে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে।
পুরনো প্রেম এবং বৃষ্টিভেজা দিনের পারস্পরিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পরিচালক চাইলে এখানে দর্শককে বিকৃত যৌন আনন্দ দিতে পারতেন। কিন্তু এই স্নিগ্ধ প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে পরিচালক কোনোভাবেই যৌনতার আশ্রয় নেননি। দীর্ঘ ছয় বছর পর দেখা হলে প্রেমিক-প্রেমিকা শুধুমাত্র একটানা কথা বলে গেছে, তাতেই এ প্রেমের গভীরতা দর্শকের হৃদয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। দুজন দুজনের সুখে থাকার এবং বিত্তবৈভবের গল্প বলতে গিয়ে অনবরত মিথ্যা কথা বলেছে। কিন্তু সে মিথ্যা কোনোভাবেই রূঢ়ভাবে কানে লাগে না। বরং মিথ্যার সাথে লেগে থাকা গভীর বিষাদ দর্শকের হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়ে তোলে। একইসাথে এই মিথ্যা বলাকেই সমীচীন মনে হয় এবং এর প্রতি এক প্রচ্ছন্ন সমর্থন দর্শক হৃদয়ে জেগে ওঠে। ঐশ্বরিয়া রাই এবং অজয় দেবগন- দুজনেই একেবারে চরিত্রের সাথে মিশে গিয়ে অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
এ চলচ্চিত্রটিতে কোনো আধিক্য নেই। কেবল ছয়জন শিল্পীর অভিনয়েই পরিচালক এত শক্তিশালী একটি গল্প বলতে পেরেছেন। মাত্র ১৬ দিনে এ চলচ্চিত্রটির শ্যুটিং শেষ হয়েছিল। এ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানগুলো একে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। কাহিনীর সাথে মিশে থাকা বিষাদময় এ গানগুলো রচনা করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং প্রখ্যাত ভারতীয় গীতিকার গুলজার। রাধা কৃষ্ণের চিরকালীন বিরহগাঁথাকে ধারণ করে রচিত গানগুলো চলচ্চিত্রের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে গেছে। চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতও এর বিষাদময় আবহ সৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এতে থ্রিলারের মতো টানটান উত্তেজনা নেই৷ তবে পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে এক রহস্যময়তা কাজ করেছে। এই প্রেমের গল্প বলার জন্য ঠিক এমনই একটি বৃষ্টিভেজা দিনের প্রয়োজন ছিল। বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতেই তো স্মৃতিময়তার উন্মেষ ঘটে। যা কিছু হারিয়ে গেছে- পুরনো প্রেম, পুরনো মানুষ, সবার কথা মনে পড়তে থাকে। কলকাতা শহরের পুরনো এক বাড়িতে তাই বৃষ্টিভেজা এমন একটি দিন পুরনো প্রেমের সাথে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। হিন্দি ভাষায় নির্মিত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘রেইনকোট’ ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিল।
কিছু চলচ্চিত্র আছে, যেগুলোর প্রতিটি ফ্রেমে কবিতার ছন্দ থাকে। পুরোটা সময় ধরে একটা মোহাচ্ছন্নতা কাজ করে এবং চলচ্চিত্র শেষ হলেও তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। মনোজগতের গোপন কোনো দ্বারে আঘাত করে খুলে দেয় স্মৃতির ভাণ্ডার। ‘রেইনকোট’ তেমনই এক চলচ্চিত্র।
এটি শুধু কোনো চলচ্চিত্র নয়, এটি সেলুলয়েডের ফিতায় নির্মিত ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটের একটি কোমল কবিতা। তাই বৃষ্টিভেজা কোনো এক দিনে দেখতে শুরু করলে ‘রেইনকোট’ তার কোনো দর্শককেই নিরাশ করবে না, প্রেমের কাব্যিক কোমল ছোঁয়া রেখে যাবে সব দর্শকের হৃদয়ে।