অ্যারিস্টটল’ তিন ধরনের বন্ধুত্বের কথা বলেছিলেন। প্রথম ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে লাভের বা উপযোগিতার ভিত্তিতে। অফিসের কলিগ, ব্যবসার পার্টনার, ক্লাসমেট- এদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে উভয়ের লাভের দিকটি আমলে রেখে। প্রকৃতি অনুযায়ী এ ধরনের বন্ধুত্বের একমাত্র কারণ, স্বার্থ। তবে কারোরই নারাজ হওয়ার সম্ভাবনা এতে নেই। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের সম্পর্ক অহরহ চোখে পড়ে। দ্বিতীয় ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে নিজের পরিতোষ বা বাসনার উপর ভর করে। স্পষ্ট ভাষায় বললে, যৌন চাহিদাই এ ধরনের বন্ধুত্বে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
আর তৃতীয় ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে সুকৃতি বা সদগুণের উপর। সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের সম্পর্ক এটি। একে অপরের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও মূল্যায়নেই সম্পূর্ণতা পায় এই বন্ধুত্ব। ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ ঘরানার বন্ধুত্ব। বাকি দুই দেখতে গেলে, স্বার্থহীন বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আলোড়িত করে একমাত্র এই তৃতীয় ধরনটি। পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা, প্রেরণার যোগান দেয় এই সম্পর্ক।
তবে অ্যারিস্টটলের এই তিনটি ধরন ছেড়ে, বন্ধুত্বের আরেক ধরন সম্পর্কে দর্শককে অভিহিত করেন সিনেমার ন্যারেটর। ন্যারেটরের ভাষায়, এই বন্ধুত্ব হলো, ‘ফ্রেন্ডশিপ অভ হিস্ট্রি’। সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শ, ভিন্ন রেখার একাধিক মানুষ কোনো একটি সময়ে কিংবা কোনো একটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষণিকের জন্য একই তলে ভেড়ে, বা একই সুতোয় আটকায়। আর ওই সুতোর সাধারণ কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে থেকেই এরা এগিয়ে যায়। এভাবেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। (আসলেই বন্ধুত্ব কি ?) অনেকসময়, ওই কেন্দ্রবিন্দুতে তৃতীয় একজন ব্যক্তিও থাকতে পারে, যে বাকি দুই মেরুর দুইজনকে ধরে সহাবস্থানে রেখেছে। আর এ ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কেই আটকা পড়েছে সিনেমার তিন চরিত্র। এ বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুশ্রী নয় মোটেও। ন্যারেটরের কন্ঠস্বরে অশুভ কিছুর আভাস প্রারম্ভিক দৃশ্যেই বলে দিচ্ছে,
“সব প্রত্যাশা পাল্টে নাও। প্রস্তুত থাকো, ভয়াবহতার চরমসীমা দেখতে পারো, তা ভেবে।”
অশুভ বাণী দিয়েই ন্যারেটর এবার চলে যান চরিত্রগুলোকে দাঁড় করিয়ে নিয়ে প্রথম থেকে গল্প বলতে। প্রথমেই দর্শক পরিচিত হয় ‘জোনাহ্’র সাথে। ভীতু আর সরল প্রকৃতির ছেলে। তবে বড়ই ইঁদুরকপাল তার। বাবা-মা মরে তো বেঁচেছে, কিন্তু তার ঘাড়ে চাপিয়েছে বিশাল দেনা। বাড়িটাও হতে চলেছে হাতছাড়া। আরেকজন হলো, রিচার্ড। ধনকুবেরের ছোঁড়া। মেজাজটাও তার রগচটা। ওই মেজাজ টাকার গরমে কি না, কে জানে। কোনোকিছু তার মনমতো না হলেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে সে। তৃতীয় চরিত্রটি হলো, রিচার্ডের প্রেয়সী ‘সাশা’। প্রেমিকের দৌলতে বহাল তবিয়তেই আছে তবে প্রেমিকের মেজাজ হারালে নিশানা তাকেই বনতে হয়। সাশা একইসাথে রিচার্ডের প্রেমিকা, রিচার্ড ও জোনাহ্’র ঝগড়া বাঁধলে রেফারি এবং ঝগড়া শেষে উভয়ের ‘মা’ হয়ে শাসায়।
ন্যারেটরের চরিত্র বর্ণনার পরপরই দেখা যায়, রিচার্ড ক্রোধে অন্ধ হয়ে জোনাহ্’র বাসায় ঢুকেই বেদম মার শুরু করল। একটি টেক্সট ম্যাসেজের সূত্র ধরে সে সন্দেহ করেছে, তার প্রেয়সী সাশা অগোচরে পরকীয়ায় মত্ত বন্ধু জোনাহ্’র সাথে। অবশ্য জোনাহ্’র মুখ ভোঁতা বানানোর পর প্রমাণিত হলো, আসলে সন্দেহ সত্যি নয়। সেই ম্যাসেজ মূলত রিচার্ডের জন্মদিনের উপহার নিয়ে। হারপুন উপহার দেওয়া নিয়ে সাশা আর জোনাহ্’র কথা হচ্ছিল বলে সাশা জানায়। জোনাহ্ ভুল শুধরে দিয়ে বলে, “হারপুন নয়, স্পেয়ার গান ওটা। স্পেয়ার গান।” যথারীতি রিচার্ডের হেয় কর্ম এত সহজে জোনাহ্ মানবে না। সাশাও না।
মনোমালিন্য কাটাতে রিচার্ড তাদের নিয়ে গেল নিজের বোটে। মূল নাটকের আগে মঞ্চ সাজানো হচ্ছিল এতক্ষণ। মূল নাটক যে এই বোটেই রচিত এবং প্রদর্শিত হবে। একদম প্রারম্ভিক দৃশ্যে এরিয়েল শটে যেই বোট দর্শক দেখেছিল, সেই বোটেই নাটকের আয়োজন। বোটে পা রাখার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যটা সামনে আসে। কত তখন? সবে ২০ কি ২৫ মিনিট পেরিয়েছে। কিন্তু নাটক শেষের যে আরো ঘণ্টা বাকি ! এ তো ছিল প্রস্তাবনা দৃশ্য। সত্য দিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করার সবরকম প্রস্তুতি যেন আজ তারা নিয়েই পা রেখেছে বোটে। সত্যের নির্মমতা কম মনে হলে হারপুন তো আছেই বাকিটুকু পুষিয়ে দিতে। দুঃখিত, স্পেয়ার গান!
হারপুন এই সিনেমায় আক্ষরিক অর্থে উপস্থিত তো আছেই, রূপকার্থেও উপস্থিত আছে। বন্ধুত্বের উষ্ণ-আর্দ্র গল্প বয়ানের প্রতিজ্ঞা কখনোই করেনি এই সিনেমা। শুরুর ভয়েসওভার ন্যারেশানেই আঁচ করতে পারা যায়, অন্যকিছু তার মাথায় চলছে। কিছুটা লাইট টোন উপহার দিলেও খুব শীঘ্রই সারভাইভাল জনরার সিনেমার আদলে নিজেকে সাজায় হারপুন। আবার সেটুকু ঝেড়ে শেষ অব্দি ‘ক্যাম্পি’ সিনেমার অঞ্চলে ভিড়ে হারপুন। ‘বি-মুভি’ বা ‘জনরা’ সিনেমার উপাদানগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে হারপুন, যেন জনরা সিনেমার অলংকারগুলোর এতদিনকার গৎবাঁধা ও জীর্ণ ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত করতে নেমেছে। জনরা সিনেমার প্রতিটি অলংকারকেই উল্টে ব্যবহার করেছে হারপুন।
দর্শক যখনই ভাবছে, সিনেমা এখন এই মোড় নেবে, তখনই সে প্রত্যাশাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে হারপুন। সবসময় এক কদম এগিয়ে থেকেছে দর্শকের প্রত্যাশার পাড় ছুঁয়ে। এবং এমনটি সম্ভব হয়েছে চিত্রনাট্যের জোরে। ভায়োলেন্সকে ভায়োলেন্স দ্বারা প্রতিহত করার মাঝেই এই সিনেমা তার শক্তি খুঁজে পেয়েছে। হারপুন এখানে আনুষঙ্গিক, ভায়োলেন্স হলো অবশ্যম্ভাবী।
পূর্বনির্ধারিত সামাজিক রীতিবদ্ধ ধারণাগুলো যখন ধ্বসে পড়ে, মানুষ কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে- তারই বয়ান রাখে হারপুন। তবে রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি এবং করাল পরিস্থিতির সুচিন্তিত প্রকাশের ধারায়, হারপুন যেন এডগার অ্যালান পো’র কোনো গল্পকে নতুন আঙ্গিকে দৃশ্যায়িত করছে। হারপুনে ‘দ্য লাইফ অভ পাই’ সিনেমা, পো’য়ের রেফারেন্স সরাসরিই ব্যবহার করা হয়েছে, সংলাপে। ব্ল্যাক কমেডির পরতযুক্ত সব সংলাপ। অসাধুতার ইতিহাস নিজেদের মাঝে প্রোথিত রাখা এই চরিত্র তিনটির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বগুলোকে ব্ল্যাক কমেডির নির্যাসে ডুবিয়েছেন চিত্রনাট্যকার এবং সিনেমার পরিচালক, ‘রব গ্র্যান্ট’।
সেইসাথে মেটা ন্যারেশান যোগ করে সিনেমার প্রচণ্ডভাবে ‘আত্ম-সচেতন’ প্রকৃতিকে প্রগাঢ় করেছেন রব গ্র্যান্ট। চ্যাপ্টারে বিভক্ত করার মতো সিনেমার টাইটেল কার্ডগুলোকে উদ্দেশ করে ন্যারেটর ‘ব্রেট গেলমান’-এর বিদ্রূপাত্মক উক্তি রসবোধের প্রকৃতিটাকে আরো গূঢ় করে। তিনটি টাইটেল কার্ডে ব্রেট গেলমানের ন্যারেশানকে তিন উপায়ে ব্যবহার করেছেন রব গ্র্যান্ট, যা সিনেমার সাথে আলাদা করে অডিও কমেন্টারি জুড়ে দেওয়ার অনুভূতি জাগায়। এবং সিনেমার তিন অংকেই, ডকুমেন্টারিতে যেভাবে ‘র-ফুটেজ’ ব্যবহার করা হয়, তেমনভাবেই ক্যামেরার পেছনের চিত্র, সম্পাদনায় ছেঁটে ফেলা দৃশ্য যোগ করেছেন রব গ্র্যান্ট, যা তার ফিল্মমেকিং দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার পাশাপাশি এ-ও বলে দেয়, কতটুকু পরিশ্রম তিনি দিয়েছেন গোটা সিনেমাটি নির্মাণে।
ক্রিস্টোফার গ্রে, এমিলি টায়রা এবং মুনরো চ্যাম্বার্স-এর রসায়ন ও চরিত্রের প্রতি সৎ অভিনয়ে ধরে রেখে তৃতীয় অংকে নিগূঢ় রসবোধের খোলটুকু ছেড়ে আদ্যোপান্ত হরর হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে হারপুন। রব গ্র্যান্ট টোনের এই পরিবর্তন ঘটিয়েছেন একেবারে নিখুঁত উপায়ে। সিনেমার গম্ভীর ভাবকে নাকচ করে, হাতের ফাঁক গলে চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ার মতো বিদ্রূপকে মুঠোয় ধরে দর্শকের মাঝে ‘অপ্রিদর্শন’ ভাব জাগাতেই শেষ অব্দি সচেষ্ট ছিলেন রব গ্র্যান্ট।