সহজ পাঠের গপ্পো- নাম শুনে প্রথমেই হয়তো মনে হবে, কচিকাঁচাদের নিয়ে বানানো কোনো সিনেমা! অবশ্য বিভূতিভূষণের তালনবমী পড়ে থাকলে এই সিনেমার প্লট খানিকটা আন্দাজ করা যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ধ্বসে পড়া চলচ্চিত্র জগতে আর্টফিল্মগুলোই এখন একটুখানি ভরসা। তবে সহজ পাঠের গপ্পো সিনেমার পরিচালক মানস মুকুল পাল ‘তারকা’ অভিনয়শিল্পী না নিয়েও শুধুমাত্র দু’জন নবাগত শিশু আর কয়েকজন নতুন মুখ নিয়ে যে এমন একটি সিনেমা বানিয়ে ফেলবেন, এ কথা অনেকেই ভাবতে পারেননি। এই সিনেমায় নেই কোনো চাকচিক্য, কোনো বিখ্যাত মুখ কিংবা বড় বাজেট। তবু সিনেমাটি হয়ে উঠেছে অনন্য ও স্বকীয়ভাবে সুন্দর।
সিনেমার প্রথম দৃশ্যে আমরা দুই দরিদ্র নন্দলালের দেখা পাই। তাদের বড়জনের নাম গোপাল, ছোটজনের নাম ছোটু। ক্যামেরার দুর্দান্ত কাজ আর দৃশ্যায়ন প্রথম দৃশ্যেই দর্শকের নজর কেড়ে নেবে। গুমোট মেঘলা দিনে হাড় লিকলিকে গায়ে ময়লা মাখা দুটো ক্ষুধার্ত বাচ্চা, বিষণ্ণ মুখে ঝিলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। ছোট ছেলেটি কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল খানিক, “বাবা কি আর বাঁচিবি নে দাদা?” বাচ্চাটির অসামান্য অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় নেই এটিই তার জীবনের প্রথম কাজ। দু’ভাই খিদের কষ্ট, বাড়ির অভাব অনটন, দুর্দশা এসব নিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতেই ওদিকে আবার বড়শিতে একটা বড় মাছ এসে পড়ল। গোপাল সে মাছ তুলতে পারার আগেই, বড়শিখানা ছিঁড়ে গেল। একটু আগে যে ছোটু শয্যাশায়ী বাবার কথা ভেবে দুঃখ করছিল, সে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল।
শিশুদের হাসিকান্নার এমন সরল সমীকরণকে উপজীব্য করেই এই সিনেমা। চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়, এমন সিনেমা আজকাল খুব বেশি তৈরি হয়না। বহুদিন পর সহজ পাঠের গপ্পো অভিব্যক্তির ভাষায় শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে এসে আবার সেই আনন্দ আপনাদের ফিরিয়ে দেবে।
এই সিনেমার সাউন্ড এডিটিং ছিল দুর্দান্ত। প্রতিটা দৃশ্যের শব্দের প্রযুক্তিগত কুশলী চারপাশের পরিবেশের সাথে দর্শকদের পরিচিত ও অভ্যস্ত করে তোলে। প্রতিটি দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ব্যাকগ্রাউন্ডে কখনো আজানের ম্রিয়মাণ শব্দ, কখনো সন্ধ্যারতির শব্দ বা ভোরের পাখির ডাক অনেকটা রূপকথার মতো মনে হয়।
কিছু দৃশ্য দর্শক হিসেবে আপনার সংবেদনশীলতার পরীক্ষা করবে। খিদে পেলে গোপাল যখন ভাইকে নিয়ে ডিম চুরি করতে যায়, ছোট্ট ছোটু বারবার বলে, “ঠাকুর পাপ দিবে যে!” গোপাল ছোটুকে উত্তরে বলে, “খিদে পেলে ঠাকুর খাইতে দেয়?” এরপরের দৃশ্যে ল্যান্ডস্কেপের কাজটা বড় পর্দায় এককথায় জাদুময় দেখায়। দূর থেকে একটু বড় গোপাল তার সাথে সাথে হাঁটতে থাকা শিশু ছোটু, পেছনে সুবিশাল আকাশ, সবুজঘেরা দিগন্তরেখা। এই দৃশ্য দেখে মনে হতেই পারে, এই শিশু দু’টোর হয়তো বড় বাড়ি নেই, থাকার অপ্রতুল জায়গা নেই, কিন্তু এদের মাথার ওপরে মস্ত বড় এক আকাশ আছে।
পাপ-পুণ্য আর সত্য-মিথ্যার পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া আর সবই পুণ্যের কাজ। মাথার ওপর যে স্রষ্টার কথা ভাবা হয়, সে সকলকে খেতে দিতে না পারলেও পাপ আর পুণ্যের বেড়াজাল থেকে কাউকেই মুক্তি দেয় না। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া গোপাল তাই খুব শিখে গেছে; ক্ষুধা মেটানোই জীবনের অর্থ।
সিনেমার এক দৃশ্যে গোপাল ভোররাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। স্কুলে যেতে না পারার দুঃখে তার চোখে চিকচিক করা জল দেখে দর্শকের মন খারাপ হবে। বিশেষ করে যারা ছোটবেলায় স্কুলে না যেতে চাওয়ার জন্য কাঁদতেন।
গোপালের দুঃস্বপ্নটা যে ‘স্বপ্ন’, দর্শকের সেটা বুঝতে খানিকটা সময় লেগে যায়। এই সিনেমায় ‘স্বপ্ন’-এর মতো একটি মেটাফোর ব্যবহার করে পরিচালক আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন দারিদ্র্য মৃত্যুর চেয়েও বেশি বেদনার। মৃত্যুভয়, মৃত্যুশোক একদিন কেটে যায়, দারিদ্র্য কাটে না। গোপালের সেই দুঃস্বপ্নে মৃত্যু আর দরিদ্রতার মাঝের একটা অন্তঃপট, একটা গভীর যোগাযোগ দেখানো হয়েছে সিনেমাটিতে।
গোপাল আর ছোটুর মায়ের চরিত্রটা দেখতে গিয়ে দর্শক বারবারই ভুলে যাবে এটা একটা সিনেমা; এতই স্বতঃস্ফূর্ত তার অভিনয়। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্নেহা বিশ্বাস।
সেই দুঃস্বপ্নের জীবন দেখে বেড়ে ওঠা আর কৈশোরসুলভ অভিমান ভরা গোপাল নিজের মা-বাবার প্রতি একটা স্নেহ, প্রেম আর দায়িত্ব অনুভব করে। সেই একটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়েই যেন গোপাল রাতারাতি খুব বড় হয়ে যায়। কিংবা ঐ একটা দুঃস্বপ্নই গোপালকে বুঝিয়ে যায় সে তার বাবা-মাকে কতটা ভালোবাসে, শিখিয়ে যায় এখন জীবনে অন্নসংস্থান করাই তার নিয়তি। আর নিয়তিকে স্বীকার করে নেয়াই তার একমাত্র পথ।
সহজ পাঠের গপ্পো সিনেমায় দুই ভাইকে প্রায় পুরোটা সময় একসাথে দেখা গেলেও তাদের বয়েস ও বুদ্ধিভেদে পরিচালক তাদের মধ্যে চারিত্রিক তুলনা এঁকেছেন নিখুঁতভাবে। গোপাল চরিত্রে সামিউল আলম, ছোটু চরিত্রে নূর ইসলামের অভিনয় আপনাদের কখনো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সারল্যের সৌন্দর্যে, কখনো বা ভরিয়ে দেবে হাহাকারে। অভিনয়শিল্পীদের থেকে কাজ আদায় করায় মানস মুকুল পাল অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।
তালনবমী গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো হলেও, সিনেমা হিসেবে আপন গতিতে এগিয়ে গেছে সহজ পাঠের গপ্পো। কোথাও গিয়ে সিনেমাটিকে শুধুই গল্পের সিনেমাটোগ্রাফি বলে মনে হয়নি। পুরো সিনেমাটা নিজেই যেন রক্তমাংস নিয়ে জীবন্ত হয়ে ছিল।
যা-ই হোক, সহজ পাঠের গপ্পো- এ আমরা ঠিক কোন সহজ পাঠটা দেখতে পাব? বয়সে খানিক বড় গোপাল যে কিনা ছোটো ভাই ছোটুর চাইতে দরিদ্রতাকে একটু বেশি দেখেছে, বাবা-মায়ের সংগ্রাম একটু বেশি দেখেছে, বড় বড় লোকেদের ছোট মানসিকতার সত্যিটুকু একটু বেশি জেনেছে, ঠকে যাওয়ার ভয় যার মধ্যে আরও আগেই বাসা বেঁধেছে, সেই গোপাল খুব বেশিদিন স্কুলেও যায়নি। কিন্তু, জীবন জীবনের স্বাভাবিক স্রোতধারায় তাকে যে সহজ পাঠটুকু শিখিয়ে গেছে আমরা সেই গল্প দেখতে পাবো সহজ পাঠের গপ্পো সিনেমায়।
আরও দেখতে পাব নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ছোটুর মন খারাপ করে দেয়া সারল্য। সেই সারল্য ধারণ করার ক্ষমতা বয়েসে বা ক্ষমতায় বড় লোকেদের নেই।
গোপাল ঠাকুরের জন্মদিনে নেমন্তন্ন না পেয়ে ছোটু হাউমাউ করে কাঁদে। আবার সেই কান্নার মধ্য দিয়েই জীবনের সহজ পাঠের গল্প শিখে যায় সে। এই পাতালঘরে স্বর্গের দেবতাদেরও ঘটা করে জন্মোৎসব পালিত হয়, আর মর্ত্যের গোপালেরা সব স্বর্গের খাবার কেমন সুস্বাদু হয়, সে কল্পনা করতে করতেই একদিন হঠাৎ বড় হয়ে যায়।
দর্শক হিসেবে নিজেকে শুধু বিনোদনের বাইরেও বেশি কিছু আবেগে আচ্ছন্ন করতে আগ্রহী সকলেই এই সিনেমাটি দেখতে পারেন। না, এই সিনেমায় কোনো চাকচিক্য, তথাকথিত সুন্দর মুখ বা বিদেশী লোকেশনের হাঁকডাক নেই। তবে আছে সমাজের মূলস্রোতের কিছু মানুষের হাসি, আনন্দ, বেদনা ও বিষাদের ঘনঘটা।