জয় গোস্বামীকে দুই বাংলার মানুষ কবি হিসেবে চিনলেও গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি যে অসামান্য প্রতিভাধর, তার প্রমাণ তিনি অনেকবারই দিয়েছেন। আনন্দ পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত উপন্যাসিকা বা নভেলেট ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’ তার সেই প্রতিভার উজ্জ্বল নক্ষত্রবিশেষ। একজন সাধারণ মেয়ের কৈশোর জীবন থেকে ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার অনবদ্য আখ্যান জয় গোস্বামী তার পোক্ত কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন ছত্রে ছত্রে।
উপন্যাসের মূল চরিত্র এক কল্পনাবিলাসী, দৃঢ়চেতা অল্পবয়সী মেয়ে সাঁঝবাতি। পুরো গল্প আবর্তিত হয়েছে সাঁঝবাতির কল্পনা, দুঃখ, প্রেম, চাওয়া-পাওয়া, মানসিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নারীত্বে উত্তরণের মধ্যে দিয়ে। সন্ধেবেলায় জন্ম, তাই মা তার নাম রেখেছিলেন ‘সাঁঝবাতি’। তার শিল্পী বাবা সৈকত প্রতি বছর তাকে জন্মদিনে উপহার দেন নিজের হতে আঁকা পোর্ট্রেট। বাবা-মা আর মেয়ের ছোট্ট সুখী সংসারে অবাধ যাতায়াত বাবার বন্ধু নন্দ জেঠু আর বাবার একসময়ের ছাত্রী দীপু পিসির। সাঁঝবাতি তার কল্পনায় তৈরি করে এক মেয়ের চরিত্র, যার সাথে সে কথা বলে মনে মনে। লিখতে থাকে তার জীবনের রূপকথা। বাবা আর মেয়ের এই বিচ্ছিন্ন জগৎকে পরম মমতায় আগলে রাখেন মা।
প্রথম যৌবনেই সাঁঝবাতির স্বপ্ন মাখানো দুনিয়া চুরমার করে এক হিংস্র কামাতুর স্পর্শ। তবে সেই ক্লেদ তাকে মলিন করতে পারে না। সব মলিনতা ধুয়ে যায় তার ভেতরের পবিত্রতায়। তার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পায় তারই প্রিয় বান্ধবীর প্রেমিকের মধ্যে। আবেগ সংযত করে সামলে নেয় পদস্খলন। কিন্তু চোখের সামনে বাবাকে অন্য নারীর বাহুডোরে দেখার পরে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় তার সাজানো দুনিয়া। মায়ের মৃত্যু, প্রাণাধিক প্রিয় বাবার দ্বিচারিতা আর ভালোবাসার অপূর্ণতা সাঁঝবাতিকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নেয় তার চেনা জগত থেকে।
বালিকা বয়স থেকে তার এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে একটি মোমদানির সাথে, যার নাম পূজারিনী। সাঁঝবাতির জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা সে ভাগ করে নেয় তার সাথে। তার মনের কল্পনায় জীবিত হয়ে ওঠে পূজারিনী। তার সব সুখ, দুঃখ,আনন্দ, প্রেম, কামনা-বাসনার সাথী হয়ে ওঠে। প্রকৃত বন্ধুর মতো পরামর্শ দেয় ঠিক-ভুলের। তার মনের মধ্যে বুনতে থাকা অসংখ্য রূপকথার গল্পকে বাস্তব রূপ দেয়।
গল্পের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন বাবা ও মেয়ের চিরন্তন সম্পর্কের বন্ধন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে যেভাবে ছোট্ট মিনি আর ভিনদেশী কাবুলিওয়ালার মধ্যে এক মিষ্টি আবেগের জাল বুনেছিলেন, তার স্বাদ এই উপন্যাসেও মেলে। সাঁঝবাতির জীবনে তার বাবা যেন এক বিরাট গাছ, যাকে ভেদ করে যেতে পারে না আলো। একধারে তিনি তার কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছেন, আবার তার শিল্পীসত্ত্বা তাকে করে রেখেছে রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ। কিন্তু বাবা-মেয়ের এই বন্ধন একসময় আলগা হয়েছে তীব্র অভিমান আর অপরাধবোধের ধাক্কায়।
তবে শেষ পাতের ক্ষীরের মতো সম্পর্কের টানাপোড়েন কাটিয়ে অবশেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ। এখানেই সাঁঝবাতির নারী হিসেবে উত্তরণ ঘটেছে। তার ব্যক্তিত্বের আলোয় সে শুধু নিজেকেই নয়, তার আশেপাশের মানুষগুলোকেও আলোকিত করতে পেরেছে। তার মানসপুত্রী পূজারিনী তার মধ্যে সেই অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছে। আসলে পূজারিনী তো রূপকমাত্র, সে তো আসলে সাঁঝবাতির সংবেদনশীল মনের আয়নার প্রতিফলন, যাকে সে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করে নিয়েছে। তৈরি করেছে তারই প্রতিভূ হিসেবে।
এ উপন্যাসে জয় গোস্বামী যে মানবসম্পর্কের টানাপোড়েনকে একটি মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন, তা সত্যিই অনবদ্য। সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো একটি লেখা। আবেগের ওপরে চরিত্রগুলো আবর্তিত হলেও কোথাও বাড়াবাড়ি নেই। তাই পড়ার সময় চরিত্রগুলো রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ হয়ে ভেসে ওঠে। দীপু পিসির সাথে বাবাকে আপত্তিকর অবস্থায় আবিষ্কার করার পরেও সাঁঝবাতি যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কোনোরকম অতি নাটকীয় আচরণ না করে পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামাল দিয়েছে, তা লেখার গুণমান আরও বাড়িয়েছে। আদতে কবি জয় গোস্বামীর কলমের ছোঁয়ায় নীরস গদ্যও যে সুমধুর কবিতার মতো উপাদেয় ও সুস্বাদু হতে পারে, তার এক উজ্জ্বলতম নিদর্শন ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’।
২০০২ সালে এ উপন্যাস অবলম্বনে একটি সিনেমা তৈরি হয়, যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী ইন্দ্রানী হালদার। সেটিও একটি কালজয়ী সিনেমার তকমা পেয়েছে কলাকুশলীদের অনবদ্য অভিনয় এবং অবশ্যই সুন্দর গল্পের কারণে।
এ উপন্যাসে আলোর এক বিশেষ ভূমিকা আছে। কখনো তা পূজারিনী, কখনো বা সাঁঝবাতির বাবার কথায় প্রকাশ পেয়েছে। সাঁঝবাতির মধ্যে এক অদ্ভুত আলো দেখতে পেতেন তিনি, যা নাকি তাকে ঘিরে থাকত সবসময়। তাই উপন্যাসের শেষে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের আদর্শে অটল এক আলোকময়ী নারীতে পরিণত হয় সে। বাবার ক্ষণিক পদস্খলন ক্ষমা করে দিয়ে কাছে টেনে নেয় সৃষ্টিময় ভালোবাসায়। সাঁঝবাতি তার সবুজ রঙের দিনলিপি লেখার খাতায় তার নিজের আলোর ছোঁয়া পাওয়া উজ্জ্বল মানুষগুলোকে নিয়ে লিখতে থাকে রূপকথা। গল্প শেষ হলেও মনে থেকে যায় ভালোলাগার রেশটুকু। আর এখানেই লেখকের কলমের মুন্সিয়ানা।