বাঙালির জীবনে ভূতের গল্প বেশ ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। আমরা ভূতে বিশ্বাস করি বা না-ই করি কিন্তু জীবনে কখনো ভূতের গল্প শোনেনি– এমন মানুষ পাওয়া বেশ দুষ্কর। ভূতে যারা বিশ্বাস করে তারা তো বটেই, এমনকি ভূতে বিশ্বাস করে না এমন অনেকে ভূতের গল্প বেশ আগ্রহভরে পড়ে থাকেন। ভূত নিয়ে আমাদের এই আগ্রহের কারণেই অনেক ধরনের ভৌতিক সিনেমা তৈরি হয়েছে।
তবে এই ভৌতিক সিনেমাগুলো নিয়ে অনেক ধরনের অভিযোগ আছে। অধিকাংশ ভৌতিক সিনেমা দেখলে মনে হয় শুধুমাত্র বীভৎস সব চেহারা কিংবা রক্তভরা মুখ দেখিয়ে দর্শককে ভয় দেখানোটাই বুঝি পরিচালকের একমাত্র আগ্রহ ছিল। একটা সিনেমার ধরন যা-ই হোক, তার অন্যতম ভিত্তি যে একটা শক্ত গল্প- সেটা অনেক পরিচালকই বেমালুম ভুলে যান। গল্পের গরু আকাশে চড়িয়ে হিংসাত্মক কিছু দৃশ্য দেখালেই সেটা একটা মানসম্মত হরর সিনেমা হয়ে যায় না, এসব ক্ষেত্রে অনেক দর্শক উল্টো বিরক্ত হন।
ভূত ব্যাপারটাই তো মনস্তাত্ত্বিক, তাই গল্প মনের মাঝে গেঁথে যাওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ব্যাপারটিকে মাথায় রেখেই শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে ২০১৭ সালে পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত ‘সব ভূতুড়ে’ সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘সব ভূতুড়ে’ নামের একটি মাসিক ভৌতিক পত্রিকা, যার মালিক ছিলেন নবীন মাধব সেন। নবীন বাবুর মৃত্যুর পর পত্রিকাটির ভার গিয়ে পড়ে তার ছেলে অনিকেতের ওপর। কিন্তু অনিকেত (আবির চ্যাটার্জি) ভূতে একদমই বিশ্বাস করে না, ফলে বাবার পুরনো পত্রিকাটি চালানোর ব্যাপারে কোনোরকম আগ্রহ তার ছিল না। পত্রিকার পুরোনো ভবনটি বিক্রি করে সেই টাকায় একটি ওয়েব ডিজাইন কোম্পানি তৈরি করাই ছিল তার পরিকল্পনা।
এদিকে পত্রিকাটির সম্পাদক কৃপাধর বাবু (সুপ্রিয় দত্ত) পত্রিকাটি চালু রাখার কথা অনিকেতকে বোঝাতে থাকেন। কিন্তু অনিকেত তার নিজের পরিকল্পনা অটল থাকার কথাই বারবার বলে। তবে বাড়ির দলিল খুঁজে না পাওয়ায় অনিকেতের সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হচ্ছিল না। পরিস্থিতি যখন এমনই দোদুল্যমান, তখনই গল্পে আবির্ভাব ঘটে নন্দিনী নামের একটি রহস্যময় মেয়ের। নন্দিনী (সোহিনী সরকার) সব ভূতুড়ের অফিসে এসে জানায় যে সে ভূত দেখতে পায়!
কিন্তু নাছোড়বান্দা অনিকেত কিছুতেই নন্দিনীর কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তবে নন্দিনী যখন তার বাবার বাড়ির দলিলের সন্ধান অলৌকিভাবে দিয়ে দেয়, তখন অনিকেত নিজেও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এমনই এক সময়ে এক ভৌতিক সমস্যা নিয়ে অফিসে হাজির হন কুসুমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার পরিতোষ মুখার্জি (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী)। মাসখানিক আগে অদ্ভুতভাবে মিনি (ইদা দাশগুপ্ত) নামের একটি বাচ্চা মেয়ে ক্লাসরুমে মারা যায়, এরপর থেকেই তার স্কুল বন্ধ। গ্রামবাসী এতটাই ভীত যে তারা তাদের ছোট বাচ্চাকে সেই গ্রামেই আর রাখছে না। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে কিছু্টা ক্ষেপে যায় অনিকেত, হেডমাস্টারকে কথা দেয় যেভাবেই হোক তারা গ্রামে গিয়ে রহস্যের সমাধান করবে এবং স্কুলটি আবার চালু করে দিবে।
নন্দিনী ও কৃপাধর বাবুকে নিয়ে অনিকেত রওনা হয় কুসুমুপুর গ্রামের দিকে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো বড় চমক! শেষপর্যন্ত কুসুমপুরের ওই স্কুলটির ঠিক কি হয়? অনিকেত কি হেডমাস্টারকে দেওয়া তার কথা রাখতে পারে? নাকি তদন্ত করতে গিয়ে তারা নিজেরাই নতুন বিপদে জড়িয়ে যায়? এসব প্রশ্নের জানতেই দেখতে হবে ‘সব ভূতুড়ে’।
সিনেমাটির চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে আসবে নন্দিনীর কথা, পুরো সিনেমাজুড়ে এই চরিত্রটি নিয়ে ধোঁয়াশা বিদ্যমান ছিল। আধিভৌতিক ক্ষমতার অধিকারী এই মেয়ে হুটহাট আত্মাদের দেখতে পাওয়ায় সবসময় যেন একটা ভয়ের মধ্যে ছিল, আর সেই ভয়ের ভাবটা ধরে রাখার ক্ষেত্রে সোহিনী সরকার বেশ ভালোভাবে উতরে গেছেন। নন্দিনীকে কখনোই একজন স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হয়নি, একবারও চোখের পলক না ফেলা কিংবা হুট করে উধাও হয়ে যাওয়া– সবকিছুই ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক।
অনিকেত ও তার বাবা নবীন মাধব সেন- দুটি চরিত্রেই ছিলেন আবির চ্যাটার্জি। অনিকেত চরিত্রটি শুরু থেকে ভূতে বিশ্বাস না করার কথা বলে এসেছে। কিন্তু সিনেমার কাহিনী যত গড়িয়েছে, তার এই কথা ততটা ফিকে হয়ে গেছে। নিজের ওপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস থাকার ব্যাপারটা আবির বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। ভৌতিক সিনেমায় ভয় পাওয়াটা অন্যতম বড় কাজ, সেদিক থেকে অবশ্য অনিকেত কিছুটা পিছিয়ে থাকবে। কারণ পুরো সিনেমার খুব কম স্থানেই তাকে ভয় পেতে দেখা গেছে। তাছাড়া বাড়ির দলিল খুঁজে দেওয়ার পরেও নন্দিনীর আধিভৌতিক ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করাটা বড্ড অযৌক্তিক ছিল।
ভয় পাওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন সুপ্রিয় দত্ত অভিনীত কৃপাধর বাবুর চরিত্রটি। পুরো সিনেমাজুড়ে কারণে-অকারণে সব সময়ই তিনি ভয় পেয়ে গেছেন। ইমপ্যাক্টের কথা বললে পুরো গল্পে কৃপাধর চরিত্রটির হয়তো কোনো ভূমিকা নেই, তবে পুরোদস্তুর ভৌতিক গল্পে এমন একটি মজাদার চরিত্রের প্রয়োজন ছিল।
হেডমাস্টার পরিতোষ মুখার্জি চরিত্রটি রূপায়ন করেছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। স্কুল যে তার জীবনের সবকিছু- মায়াভরা অভিনয় দিয়ে এই অভিজ্ঞ অভিনেতা বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। হেডমাস্টারের পুরনো ছাত্র ও এলাকার নেতা চরিত্রে রবিন চ্যাটার্জি চরিত্রটি শুরু থেকেই বেশ ‘রাফ এন্ড টাফ’ ভূমিকায় ছিল। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌশিক কর। তার গেটআপ ঠিকঠাক ছিল। তবে অভিনয় আরেকটু পরিমিত হলে ভালো হতো।
ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে মিনি চরিত্রে অভিনয় করা শিশুশিল্পী ইদা দাশগুপ্ত একাই বাজিমাত করে দিয়েছে। সিনেমার একদম শুরুর দিকে দুটো সংলাপ বাদ দিলে পুরো সিনেমায় মিনির কোনো সংলাপ ছিল না। কিন্তু বড় বড় চোখ করে অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি যেভাবে মিনি দিয়ে গেছে, তারপর আর কোনো ভয়ের সংলাপ প্রয়োজন ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিচালকের কোনো আত্মীয়কে সিনেমায় অভিষেক করালে সে প্রত্যাশামাফিক পারফর্ম করতে পারে না। এদিক থেকে পরিচালক বিরসা দাশগুপ্তর মেয়ে ইদা দাশগুপ্ত বেশ ব্যতিক্রম ছিল।
ভৌতিক সিনেমায় পারিপার্শ্বিক আবহ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ন, সেদিক থেকে চিত্রগ্রাহক গৈরিক সরকার বেশ ভালো কাজ করেছেন। ভূতের গল্পের ক্ষেত্রে আলো-আঁধারি পরিবেশ সবসময় একটি বড় ভূমিকা রাখে, সেকারণে পুরো সিনেমায় কোনো দৃশ্যই রোদ ঝলমলে দেওয়া হয়নি। বৃষ্টিস্নাত স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের সাথে শুভ প্রামাণিকের সঙ্গীতায়োজনে ভূতুড়ে আবহ সঙ্গীত বেশ ভালোভাবে জমে গিয়েছিল। সিনেমায় গান ছিল দুটি– একদম শুরুতে ‘গল্প’ ও একদম শেষে ‘নেই আলো’ গান দুটি বেশ শ্রুতিমধুর ছিল এবং কাহিনীর সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
সিনেমাটির সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিল এর গল্প আর এক্ষেত্রে আসল জাদুটা দেখিয়েছেন কল্লোল লাহিড়ী। সব ভূতুড়ের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ– সবই তার লেখা। একদম শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গল্পে একটা থ্রিলার ভাব ছিল, ঠিক কী কারণে ঘটনাগুলো ঘটছে সেটা জানার আগ্রহ লেখক বেশ ভালোভাবে তৈরি করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, স্কুলে ভৌতিক সব ঘটনা ঘটার আসল কারণ প্রথমভাগে কেউই আন্দাজ করতে পারবে না, তার জন্য যেতে হবে শেষভাগ পর্যন্ত। আর ভৌতিক থ্রিলার হলেও সিনেমায় একটা আবেগের গল্পও ছিল যা দর্শককে গল্পের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করেছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাট খামতিও দেখা গেছে, অনিকেত চরিত্রটির চিন্তাভাবনা আরেকটু ধারাবাহিক করা যেত। নন্দিনী চরিত্রে শুরু থেকে অতি বেশি রহস্যময়তা দেখা গেছে, যার সমাধান শেষদিকেও হয়নি। উল্টো শেষদৃশ্যে নন্দিনী চরিত্রটি নিয়ে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়েছে। পরিচালক যদি সিনেমাটির সিক্যুয়েল করার কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় চরিত্রে এই রহস্য ধরে রেখে থাকে, তাহলে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সিক্যুয়েল নির্মাণের কোনো চিন্তা না থাকলে এটি বেশ বড় ধরনের লুপহোল হিসেবেই বিবেচিত হবে।
তবে সবমিলিয়ে ‘সব ভূতুড়ে’ সিনেমাটি বেশ ভালো নাম্বারই পাবে। গ্যাংস্টার, ওয়ানের মতো বাণিজ্যিক সিনেমা বানিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর সব ভূতুড়ের মাধ্যমেই আবারো ভিন্ন ধারার সিনেমায় ফিরেছিলেন বিরসা দাশগুপ্ত, সেদিক বিবেচনায় তার প্রত্যাবর্তনটাও বেশ ভালো হয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে ভূতের বর্ণনাও কিন্তু বিভিন্ন রকম। ইংরেজ ভূতের সাথে জাপানিজ ভূতের বর্ণনায় যেমন তফাৎ আছে, ঠিক সেভাবে কোনো মরুর দেশের ভূতের সাথে বাঙালিদের গল্পে বর্ণিত ভূতেও পার্থক্য আছে। পরিচালক বেশ ভালোভাবেই একটি পরিপূর্ণ বাঙালি ভৌতিক আমেজ তৈরি করেছেন। আপনি যদি বাঙালি ভূতের গল্প ভালোবাসেন, তাহলে ‘সব ভূতুড়ে’ সিনেমাটি আপনি আপনার দেখার তালিকায় সানন্দে রাখতে পারেন।