মালায়লাম সিনেমা: চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি ও মৌলিক গল্পের সমন্বয়

কেমন হয় যদি কোনো সিনেমার গল্প আপনার সাথে মিলে যায়? অনুভূতিটা আসলেই বলে বোঝানোর মতো না যখন নিজের গল্পকেই কোনো সিনেমায় উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। কিন্তু যদি ধারাবাহিকভাবে একের পর এক আপনার ও আপনার আশেপাশে সাধারণ জীবনযাপনের ছোট ছোট গল্পগুলোর নিখুঁত উপস্থাপন সিনেমাগুলোতে দেখতে পান?

হ্যাঁ, আসলেই আমাদের চারপাশের সাধারণ গল্পকে অসাধারণভাবে সিনেমার পর্দায় উপস্থাপন করে মালায়লাম সিনেমাগুলো। দক্ষিণ ভারতে মোট চারটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি- তামিল (চেন্নাই), তেলেগু (হায়দারাবাদ), মালায়লাম (কেরালা) ও কন্নড় (বেঙ্গালুরু)। সাধারণত মাসালা মুভি দিয়ে দক্ষিণী চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিগুলো একটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মালায়লাম সিনেমা এসবের বাইরে। তাদের সিনেমার মূল রসদ হলো গল্প। খুব সাধারণ গল্পকে তারা কতটা নিখুঁতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলে তার প্রমাণ তাদের সিনেমাগুলো।

সিনেমার গল্পগুলো সাধারণ বলা হচ্ছে এজন্যই যে তাদের সিনেমার গল্পগুলো আপনার, আমার, আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া যাওয়া ছোট ছোট গল্প, যেগুলো লুকিয়ে থাকে নীল মলাটের ডায়েরির ভেতরে, কিংবা কোনো রিকশাচালকের ছেড়া টাকায়, কোনো তরুণের শৈশবের স্মৃতিতে ফেলে আসা ব্রিজটাতে, দিনমজুরের ঘামের ফোটায় কিংবা কোনো তরুণীর ঘোমটার আড়ালে, প্রেমিকার জন্য সারারাত জেগে লেখা চিঠির প্রতিটা লাইনে। প্রতিটি লাল-নীল খামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাধারণ জীবনের গল্পগুলো নিয়েই তাদের সিনেমাগুলো।

মৌলিক গল্পের সাথে চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি সিনেমাগুলোকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। সামাজিক, হৃদয়স্পর্শী বা থ্রিলার জাতীয় সিনেমা নিয়েই মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। এবার কয়েকটি মালায়লাম সিনেমা নিয়েই কথা বলা যাক।

উস্তাদ হোটেল

 image source: impawards.com

আনোয়ার রশিদের পরিচালনায় ২০১২ সালে মুক্তি পায় দুলকার সালমান অভিনীত সিনেমা ‘উস্তাদ হোটেল’। দাদা-নাতির গল্প নিয়ে বানানো সিনেমাটি আপনার মনে গেঁথে যাবে। সিনেমায় কোনো টুইস্ট নেই, কমেডি নেই, কোনো ফাইট সিন নেই, রোমান্সও নেই। তারপরও সিনেমাটি দেখে শেষ করার পর আপনার ভেতরে একটি মুগ্ধতার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়বে। সিনেমার একটি উক্তি এরকম, “সব মানুষই তো পেট ভরাতে পারে, কিন্তু একজন রাঁধুনি পেটের সাথে সাথে মনও ভরাতে পারে।

সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৩। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এই সিনেমা দিয়েই মালায়লাম সিনেমায় নিজের একটি শক্ত স্থান তৈরি করেন দুলকার সালমান।

চার্লি

image source: impawards.,com

আপনার পছন্দের তালিকায় যদি হুমায়ুন আহমেদের হিমু চরিত্রটি থাকে, তাহলে বলতে হবে এই সিনেমাটি আপনাকে দেখতেই হবে।

গল্পটি তেসা নামের এক ভ্রমণপ্রিয়, স্বাধীনচেতা মেয়ের, যাকে বাসা থেকে বিয়ে দিতে চাইলে সে পালিয়ে এসে কেরালার একটি শহরে বাসা ভাড়া নেয়। সেই বাসায় আগে চার্লি (দুলকার সালমান) নামে এক লোক থাকতো। একদিন তেসা বাসাটিতে একটি অসম্পূর্ণ স্কেচ বক্স খুজে পায়, গল্পের শুরু এখান থেকেই।

গল্পের বাকিটুকু জানতে সে বেরিয়ে পড়ে চার্লির খোঁজে। আর পথিমধ্যে খুঁজে পেতে থাকে চার্লির পরিচিত অনেক মানুষকে। সে সবার উপকার করে। কিন্তু চার্লির নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। চার্লিকে নিয়ে যতই জানতে থাকে, ততই চার্লির প্রতি ভাল লাগা তার মনের ভেতরে জায়গা করে নিতে থাকে। সে চার্লির সাথে একবারের জন্য হলেও দেখা করতে চায়।

এরকমই একটি গল্প নিয়ে সাজানো ‘চার্লি’ সিনেমাটি। চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি, অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সাথে দুর্দান্ত অভিনয়। সিনেমাটি শেষ করবেন এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। হয়তো বার বার দেখবেন সিনেমাটি আর প্রতিবার আবিষ্কার করবেন এর একেক দৃশ্যকে একেক আঙ্গিকে। সিনেমাটি কেরালা স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা পরিচালকসহ ৮টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।

প্রেমাম

image source: impawartds.com

নিভিন পাউলির আলোচিত এক সিনেমা প্রেমাম। মানুষের জীবনের কৈশোর, যৌবন ও বিয়ে এই তিনটি স্তরকে খুব সুন্দরভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গল্পটা যে খুব আহামরি কিছু তা-ও নয়, কিন্তু মুভিটি দেখা শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারবেন না এটুকু বলাই যায়। অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর স্ক্রিনপ্লে- সবই প্রশংসনীয়। মাঝখানে ‘মালারে’ গানের সাথে মালার চরিত্রে সাই পল্লবীর অভিনয়ও মনে রাখার মতো। মাত্র চার কোটি বাজেটের ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া মুভিটি সেই বছর বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল। আইএমডিবি রেটিং ৮.৩; সর্বমোট ২৬টি পুরস্কার আছে এর ঝুলিতে।

ব্যাঙ্গালোর ডেইজ

image source: desimartini.com

নিভিন পাউলি, দুলকার সালমান, নাজরিয়া নাজিম, ফাহাদ ফাঁসিল, নিথিয়া মেনন, পার্বতীসহ এরকম একঝাঁক মালায়লাম তারকার উপস্থিতি নিয়ে ‘ব্যাঙ্গোলোর ডেইজ‘ সিনেমাটি। এর প্লটটি সাজানো হয়েছে তিন কাজিনের জীবনের গল্প নিয়ে। ভালবাসা, আবেগ, অনুভূতির যেন অন্যরকম এক মেলবন্ধন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমার গল্পে। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা দিয়েই হয়তো অনেকে মালায়লাম সিনেমা দেখা শুরু করেছিলেন। কাজিনদের মধ্যে সত্যিকারের সম্পর্কের একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে এতে।

ইন্নু নিন্তে‌ মঈদীন

image source: impawards.com

কোথায় যেন মানবমন বড়ই নিরুপায় হয়ে যায়, কোনো জাত-ধর্মের বাধা মানে না, মনের গহীনে নিজের অজান্তেই একটি অনুভূতির পরিস্ফুটন ঘটে, আর তা হলো ভালোবাসা। আপনি দৃশ্যমান অনেক কিছুই হয়তো চাপিয়ে রাখতে পারবেন, খুব সহজেই তার বিনাশ ঘটাতে পারবেন, ধ্বংস করতে পারবেন, বেড়ে ওঠা স্থবির করে দিতে পারবেন, কিন্তু ভালবাসা? এটা যেন সবচেয়ে ব্যতিক্রম। কোনো বাধাই যেন এর সমতুল্য নয়। ক্ষণিকের মধ্যেই এক অজানা আবেশ মনের গহীনে একটি শক্ত স্থান করে নেয়, যেখানে জাত-ধর্মের বাধা সবই তুচ্ছ।

১৯৬০ এর দশকে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘ইন্নু নিন্তে মঈদিন‘ সিনেমাটি, যার বাংলা অর্থ ‘চিরদিনই তোমার মঈদীন’। সিনেমার স্ক্রিনপ্লে, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, সাথে সকলের অসাধারণ অভিনয় আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। কাঞ্চনমালা ও মঈদীনের গল্পটি এত নিখুঁতভাবে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে যে সিনেমাটি দেখতে বসলে দর্শকও ফিরে যাবেন ষাটের দশকে।

মুম্বাই পুলিশ

image source: impawards.com

থ্রিলার কিং খ্যাত পৃথ্বীরাজের একটি মাস্টারপিস মুম্বাই পুলিশ। কাহিনী ও চিত্রনাট্য হলো থ্রিলার সিনেমার প্রাণশক্তি, আর বরাবরের মতোই মালায়লাম থ্রিলার ছবির কাজগুলো বেশ প্রশংসনীয়। এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পের ধারাবাহিকতা ও চিত্রনাট্যের উপস্থাপন এতটাই নিখুঁত যে সিনেমাটি শেষ হবার আগপর্যন্ত আপনার ভেতর অন্যরকম এক উত্তেজনা কাজ করবে।

দৃশ্যাম

image source: theunrealtime.com

মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির মাস্টারপিস মোহনলাল অভিনীত সিনেমা এটি। মালায়লাম যে থ্রিলার সিনেমা তৈরিতে অনবদ্য তার একটি প্রমাণ এটি। লোমহর্ষক ও টান টান উত্তেজনায় পূর্ণ একটি থ্রিলার মুভি। ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মুভিটি পরবর্তীতে ৫টি ভাষায় রিমেক হয় এবং প্রথম ভারতীয় মুভি হিসেবে ২০১৯ সালে এটি চীনে রিমেক হয় ‘Sheep Without a Shepherd’ নামে। এর আইএমডিবি রেটিং ৮.২।

এছাড়াও আরও বেশ কিছু মালায়লাম সিনেমাই আছে যা আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। এগুলোর কোনো ডাবিং পাবেন না, আপনাকে সাবটাইটেল দিয়ে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- আপনি মুভিগুলো বাংলা সাবটাইটেল দিয়েই উপভোগ করতে পারবেন। বাংলাদেশে মালায়লাম মুভির দর্শকসংখ্যাও কম নয়। অনেক সাব-মেকার তাদের শ্রম দিয়ে নিজের মাতৃভাষায় মুভিগুলো উপভোগ করার জন্য সাবটাইটেল তৈরি করে থাকেন।

মালায়লাম সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- মৌলিক গল্পের নিখুঁত উপস্থাপন তাদের সিনেমাগুলোতে, সাথে কেরালা রাজ্যের রূপ-লাবণ্যে ভরা প্রকৃতির চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি। তাদের মুভিগুলোতে আপনি পাবেন না কোনো ওভারঅ্যাক্টিং, অতিরিক্ত মারামারি, রিমিক্স, আইটেম গানের জোয়ার কিংবা গ্লামারে ভরা নায়ক-নায়িকা। এসব ছাড়াই মালায়লাম মুভি তাদের স্থান চিনিয়েছে। একটা সময় বাংলাদেশের মতো মালায়লাম মুভিরও ক্রান্তিকাল চলছিল, কিন্তু তারা সেই সময়টা সুপরিকল্পিতভাবে কাটিয়ে উঠেছে এবং বর্তমানে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রিকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। আশা করা যায় বাংলাদেশও এই সময়টা কাটিয়ে উঠবে এবং আগামীতে উপহার দেবে সুন্দর সুন্দর সিনেমা।

This is a bengali article on the Malayalam movie industry.

Feature Images: impawards.com

Related Articles

Exit mobile version