অনেক অনেক দিন আগের কথা। গ্রিনডেল নামে ছোট এক মফস্বল শহরে অপ্সরীর মতো দেখতে এক কিশোরী বাস করতো। এ বয়সের বাকি সব ছেলেমেয়ের মতো তারও দিনকাল বন্ধুদের সাথে হেসেখেলে ও পড়াশোনা করেই কাটছিল। পরনে লাল ওভারকোট, কানের নিচ অবধি সোনালী চুল, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক আর কাঁধে ব্যাগ। মেয়েটির মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে যেমন তার আশেপাশের লোকজন মুগ্ধ হতো, ঠিক তেমনি তার কথাবার্তায় বুদ্ধির ঝিলিক দেখে বিমোহিত না হয়ে উপায় ছিল না।
রূপে-গুণে পরিপূর্ণ এ মেয়েটিকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সাধারণ কোনো মেয়ে বলে মনে হলেও, সে আসলে তা ছিল না। জন্মসূত্রেই সে ছিল রক্ত-মাংসে গড়া মরণশীল মানুষ ও অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী অমর জাদুকরীর (উইচ) বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে গড়া এক প্রাণ। তার বাবা ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ও মহাজ্ঞানী জাদুকর এডওয়ার্ড স্পেলম্যান (ওয়ারলক), যিনি একজন সাধারণ মানবীর প্রেমে পড়ে তার সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আর তাই তাদের সন্তান সাবরিনা ছিল একজন অর্ধ মানবী ও অর্ধ জাদুকরী। ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি, সেই লাবণ্যময়ী মেয়েটির নাম ছিল সাবরিনা স্পেলম্যান। আর আজ আমরা সাবরিনার গল্পই শুনতে যাচ্ছি।
গত মাসের মাঝামাঝিতে প্রথমে হরর, সুপারন্যাচারাল, ড্রামা জনরার সিরিজ ‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ এর পর, মাসের শেষের দিকে হরর- ফ্যান্টাসি জনরার ‘দ্য চিলিং অ্যাডভেঞ্জারস অব সাবরিনা’ নামক আরও এক ধামাকা নিয়ে দর্শকদের সামনে পুনরায় হাজির হয় নেটফ্লিক্স। ‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ এর মতো তুমুল সাড়া না ফেলতে পারলেও সিরিজটি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো নেতিবাচক রিভিউ পাওয়া যায়নি। এ সিরিজের নেটফ্লিক্স থেকে রিলিজ হওয়ার পেছনেও ছোট একটা গল্প আছে।
বিশ্বের অন্যতম বিশাল ও স্বনামধন্য প্রযোজনা সংস্থার ওয়ার্নার ব্রোস টেলিভিশন দ্বারা প্রযোজিত এ সিরিজের ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমে ‘দ্য সিডব্লিউ’ নেটওয়ার্ক থেকে রিলিজ হবার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে এসে ঘোষণা দেওয়া হয়, সিরিজটি মোট দুই সিজনে বিভক্ত হয়ে নেটফ্লিক্সের অরিজিনাল সিরিজ হিসেবে পর্দায় উন্মোচিত হবে। আর্চি কমিক্সের প্রকাশিত ‘দ্য চিলিং অ্যাডভেঞ্জারস অব সাবরিনা’ নামের কমিক বই থেকে সংকলিত গল্পের উপর নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। আর বইয়ের গল্পটিকে সিরিজের চিত্রনাট্যে রূপ দিয়েছেন স্বয়ং কমিক বইটির লেখক রবার্তো আগুয়েরে সাকাসি।
এবার সিরিজের কাহিনী নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১৯৪০ সালের পটভূমিতে সিরিজটির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গ্রিনডেল নামক শহরে সে সময়ে সাবরিনা নামের ষোল বছর ছুঁইছুঁই এক অনাথ বালিকা তার দুই ফুফুর কাছে কাজিন অ্যামব্রোসের সাথে বেড়ে উঠছিল। শহরের স্কুলে পড়াশোনা করে ও সবথেকে কাছের তিন বন্ধু সুজি, রোজ ও হার্ভিকে নিয়ে তার জীবন ভালোই সুখে-শান্তিতে কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে হার্ভি ও সাবরিনা আবার একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। এইটুকুন বয়সেই তারা পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল।
চঞ্চল ও মায়াবতী সাবরিনা সবার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে তার মনে অজস্র চিন্তা ও মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বয়ে চলছিলো। কারণ সে ছোটকাল থেকেই জানতো, রোজ, সুজি অথবা হার্ভির মতো সে কোনো সাধারণ কিশোরী নয়। সে ও তার পরিবার গ্রিনডেলে আট-দশটা পরিবারের মতো সাধারণ জীবনযাপন করলেও তারা ছিল অন্য ভূবন থেকে আগত এক অতিপ্রাকৃত ও মোহনীয় জাদুবিদ্যার অধিকারী পরিবার। সেই জাদুকরদের জগতে তাদের পরিবারের প্রচুর মানমর্যাদা ও প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, অর্ধ মানবী সাবরিনাকে অনুকূল পরিবেশে বড় করার জন্য তার ফুফুরা তাকে নিয়ে মানব সমাজে বসবাস করছিল। তবে সাবরিনা ছোটকাল থেকে জানতো, ষোড়শী হওয়া মাত্রই ‘ডার্ক ব্যাপ্টিজম’ এর মাধ্যমে তাকে জাদু দুনিয়ার ঈশ্বর ‘ডার্ক লর্ড’ এর সেবায় নিজেকে পুরোপুরি সমপর্ণ করতে হবে। আর এভাবেই সে জাদু দুনিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করবে ও পৈতৃকসূত্রে পাওয়া অধিকার ও দায়িত্বগুলো নিজ কাঁধে তুলে নেবে। মানবসত্ত্বা ত্যাগ করে তাকে সামগ্রিক রূপে একজন জাদুকরী হয়ে উঠতে হবে।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা সাবরিনার জন্য আনন্দের ছিল। কারণ একবার ডার্ক ব্যাপ্টিজম হয়ে গেলে ফুফুদের মতো সে-ও জাদুকরীদের খাতায় নিজের নাম লেখাতে পারবে। এরপর ‘দ্য অ্যাকাডেমি অব আনসিন আর্টস’ নামক জাদুকরদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের মধ্য দিয়ে নিজেকে নানা রকম শক্তিশালী জাদুবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে পারবে। এছাড়া অমরত্ব লাভের সুবর্ণ সুযোগ তো আছেই। কিন্তু যতই দিন ঘনিয়ে আসছিল, সাবরিনার উচ্ছাস ততই কমে যাচ্ছিল। প্রিয় বন্ধুদের পেছনে ফেলে যাওয়ার বেদনা ও তাদের চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশংকা তার মনে জেঁকে বসেছিল। আর এভাবেই, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার দৃঢ় মনোভাবধারী সাবরিনা জাদু দুনিয়ায় এমন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল যা তাকে অন্যান্য জাদুকর-জাদুকরীদের থেকে অনন্য করে তুলেছিল। তবে তার এ পদক্ষেপ তার জীবনে যতটা না সুফল বয়ে এনেছিল, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি বিপদ এসে হানা দিয়েছিল। আর এ প্রতিকূল পরিস্থিতি নিজ মেধা, বুদ্ধি ও সাহসিকতার জোরে সাবরিনা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিল, সেটাই সিরিজে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
‘দ্য চিলিং অ্যাডভেঞ্জারস অব সাবরিনা’ সিরিজটি হয়তো তেমন কোনো নতুনত্বের গড়া কাহিনী নিয়ে দর্শকদের মনে আলোড়ন তুলতে পারেনি, তবে মানতেই হবে, এর নির্মাণশৈলী সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়া অভিনয়শিল্পীরা, বিশেষ করে সাবরিনা চরিত্রে অভিনয় করা কিয়ের্নান শিপকা এককথায় অসাধারণ ছিল। সিরিজটি দেখলে দর্শক এর সাথে বেশ কিছু মুভি ও সিরিজের সামান্য হলেও সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। ফ্যান্টাসি ও টিন এজ ড্রামা জনরার হ্যারি পটারের মুভি সিরিজের মতো এতে জাদু দুনিয়ার অলৌকিক রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া স্ট্রেঞ্জার থিংস সিরিজের মতো এখানেও সুপারন্যাচারালের পাশাপাশি টিন এজ রোমান্স ও ফ্রেন্ডশিপকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
স্ট্রেঞ্জার থিংসের মাইক- ইলেভেন জুটির ছায়া যেন সাবরিনা ও হার্ভির মধ্যে দেখতে পাবেন দর্শক। টিন এজ ড্রামায় এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুব কমই চোখে পড়ে। তাছাড়া সিরিজটি যে শুধু অপার্থিব উপাদানকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। পার্থিব জগতের অনেক ছোট ছোট বিষয়ও পারদর্শিতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাস্তবের স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে বিরোধী ভাব, পারিবারিক সম্পর্কের মূল্যবোধ ও গুরুত্ব, প্রতিশ্রুতির মূল্যায়ন, যেকোনো ধরনের সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা ও আস্থার অবস্থান ইত্যাদি ব্যাপারগুলো কাহিনীর অন্তরালে বিদ্যমান রয়েছে।
সিরিজের ভালো লাগার মতো যে দিকগুলো রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো কস্টিউম ও সাজসজ্জা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পাশ্চাত্য দেশসমূহে প্রচলিত বেশভূষা ও ফ্যাশনকে সিরিজে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাবে। থিম সং হিসেবে ব্যবহৃত মিউজিক থেকে শুরু করে প্রতিটি সময় ও পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে বেজে চলা সুর দর্শকদের গল্পের ভেতর আরও গভীরভাবে মগ্ন হতে বাধ্য করবে। এ বছরের মার্চ মাস থেকে শুটিং শুরু হওয়া সিরিজটির। সামনে ক্রিসমাসে ‘আ মিড উইন্টার’স টেল’ নামে সিরিজটির একটি স্পেশাল এপিসোডে আসতে যাচ্ছে।
সিরিজটি সম্পর্কে আরেকটু বিশদভাবে জানতে চলুন প্রতি পর্বের এক ঝলক দেখে আসা যাক।
পর্ব-১: ‘অক্টোবর কান্ট্রি’
প্রথম পর্বে মূলত সাবরিনা, তার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সাথে প্রাথমিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকদের। এছাড়া ডার্ক লর্ড, ডার্ক ব্যাপ্টিজম ও ম্যাডাম স্যাটানের সাথে পরিচিত হবে।
পর্ব-২: ‘দ্য ডার্ক ব্যাপ্টিজম’
সাবরিনার ‘ডার্ক ব্যাপ্টিজম’ এর দিনকে ঘিরে এ পর্ব সাজানো হয়েছে। বেশ রোমাঞ্চকর পর্ব এটি।
পর্ব-৩: ‘দ্য ট্রায়াল অব সাবরিনা স্পেলম্যান’
‘ডার্ক ব্যাপ্টিজম’ এর দিনে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য সাবরিনাকে এবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ভালোই থ্রিল খুঁজে পাবেন দর্শক।
পর্ব-৪: ‘উইচ অ্যাকাডেমি’
‘দ্য অ্যাকাডেমি অব আনসিন আর্টস’- এ সাবরিনার পর্দাপণ ও গোপন কিছু রহস্যের সন্ধান পাওয়া নিয়ে এ পর্ব নির্মিত হয়েছে।
পর্ব-৫: ‘ড্রিমস ইন আ উইচ হাউজ’
একটি ভয়ানক রাক্ষসীর আগমন ঘটে সাবরিনার বাড়িতে। নানা ঝড়ঝাপ্টা পাড়ি দিয়ে কীভাবে সাবরিনা নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখবে?
পর্ব-৬: ‘আ এক্সোরিজম ইন গ্রিনডেল’
সাবরিনার বান্ধবী সুজির চাচা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। হার্ভির বাবার খনিতে কাজ করতে গিয়ে তার এই দুর্দশা। খনি থেকে তার উপর কিছু একটা ভর করেছে। আর তাই এবার সাবরিনা ওঝার দায়ভার কাঁধে তুলে নিলো।
পর্ব-৭: ‘ফিস্ট অব ফিস্টস’
জাদু দুনিয়ায় আয়োজিত ঐতিহাসিক এক ভোজন সমাবেশের চিত্র এ পর্বে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এতে পাশবিকতা এতটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে যে সাবরিনার নরম মনে তা নাড়া দিয়ে ওঠে।
পর্ব-৮: ‘দ্য ব্যারিয়াল’
সাবরিনা যখন খুনি! এ পর্বে নিষ্ঠুর এক সাবরিনার রূপ দেখতে পাবেন দর্শক। খনিতে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ফলে হার্ভির ভাই টমি প্রাণ হারায়। প্রেমিকের ব্যথাতুর হৃদয়কে শান্ত করতে অন্য এক প্রাণের বলি দিতে প্রস্তুত হয় সাবরিনা।
পর্ব-৯: ‘দ্য রিটার্নিন্ড ম্যান’
এ পর্বে টমিকে পুর্নজন্ম লাভ করে ফিরে আসতে দেখা যাবে। কিন্তু আদৌ কি সে টমি? সাবরিনা ও হার্ভির সম্পর্কে নেমে আসবে টানাপোড়েন অধ্যায়।
পর্ব-১০: ‘দ্য উইচিং আওয়ার’
এ পর্বটি বেশ শিহরণ জাগাবে দর্শক-মনে। টান টান উত্তেজনা ও ঈষৎ ভয়ের দেখা পাবে তারা। আর এ পর্বে পুরো প্রতিশোধের নেশায় মাতাল হয়ে থাকা ১৩ জন জাদুকরী থেকে পুরো গ্রিনডেল শহরকে বাঁচাতে সাবরিনা কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।
‘দ্য চিলিং অ্যাডভেঞ্জারস অব সাবরিনা’ সিরিজটির প্রথম সিজন বেশ কিছু ব্যাপারা অজানা ও রহস্যের ঘনঘটায় রেখে ইতি টেনেছে। সাবরিনার জন্ম ইতিহাস থেকে শুরু করে তার মা-বাবা মায়ের পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয় আর মৃত্যু সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছু দেখানো হয়নি। সামনের সিজনে হয়তো এসব বিষয়ের উপর থেকে পর্দা তোলা হবে। সিরিজটির গল্পকে আরেকটু জোরালো ও আকর্ষণীয় করার এখনও সুযোগ আছে। হয়তো সামনে কোনো চমক অপেক্ষা করছে। আর তাই তো অধীর আগ্রহ নিয়ে ক্রিসমাস স্পেশাল পর্বের জন্য প্রতীক্ষা করাই যায়। দেখা যাক, সাবরিনা নামের মায়াবিনী আবার কী নতুন জাদুবিদ্যা নিয়ে হাজির হয়।