সৃষ্টিকর্তার খেয়ালে আমরা বেড়ে উঠছি আমাদের মতো করে। পথ চলতে গিয়ে সাক্ষী হই নানা ঘটনার। মুহূর্তে যত গল্পের বাঁক বদলায়। একাকিত্ব যখন ঘিরে ধরে, বিষণ্ন সময়ে চারদেয়ালে যখন আবদ্ধ থাকি কত কিছু ভাবি আমরা। হাজার ভাবনার মাঝে কখনও ভেবেছি কি- যে প্রক্রিয়ায় জীবন চলছে তার উল্টোরথে চলতো যদি? ঘড়ি কেন এভাবে ঘোরে? ওভাবে ঘুরলে হতোই বা কী? অজান্তেই কি একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনার যোগসূত্র তৈরি হয়, যা বদলে দেয় জীবনের নকশা? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন ‘দ্য কিউরিয়াস কেইস অব বেঞ্জামিন বাটন’ চলচ্চিত্রে।
ঠিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার রাতে জন্ম হয় বেঞ্জামিন বাটনের। আঁধারের পর আলোর আগমন বুঝি একেই বলে! বেঞ্জামিনকে পৃথিবীতে এনে পরপারে পাড়ি জমান মা। তাকে এক চ্যারিটি হোমের সিড়িতে রেখে এলেন বাবা। পাশে রেখে এলেন ১৮ ডলার। নবজাতক শিশু, যার শরীর থেকে রক্তটুকুও মোছা হয়নি, মুহূর্তের ব্যবধানে সে একা হয়ে গেল। চ্যারিটি হোমের সেবিকা ‘কুইনি’ (তারাজি হ্যানসন) কান্না শুনতে পেয়ে বাইরে আসেন। বাচ্চাকে নিয়ে আসেন নিজ কামরায়। রুমে এনেই কপালে তোলেন চোখজোড়া। এ যে দেখতে মোটেই শিশুসুলভ নয়! শরীরে বয়সের স্পষ্ট ছাপ, যেন কোনো আশি বছরের বৃদ্ধ মৃত্যর ক্ষণ গুনছে।
কিন্তু বিধাতার খেয়াল অন্যরকম। বেঞ্জামিনের জীবনের গল্পে তাই বাঁকবদল ঘটে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন। প্রতি সেকেন্ডে ঘটতে থাকা প্রতিটি ঘটনায় বাঁধা থাকে চেনা-অচেনা প্রত্যেকের ভাগ্য! ‘ডেইসি’র (কেট ব্লেনচেট) সঙ্গে বেঞ্জামিনের দেখাও অদ্ভুতভাবে। ভালোবাসা কোনো কিছুর কাছেই হার মানে না। সঙ্গীর খুঁতও অপার স্নেহে হয়ে ওঠে নিখুঁত। অচল সময়ে মায়ের ভালোবাসা এবং বুঝতে শেখার কালে ডেইসি শুদ্ধ এক মানুষে পরিণত করে বেঞ্জামিন বাটনকে। সেই শুদ্ধতার হাওয়া গায়ে মেখে জীবনকে উপভোগ করেছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। নিজের শারীরিক অপূর্ণতার ফলে আসন্ন নিয়তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেঞ্জামিন শিখিয়েছে জীবনযুদ্ধে টিকতে হলে চাই মানসিক সাহস।
জীবনের গল্প অল্প অল্প করেই চিরদিন সাজানো থাকে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত স্কট ফিৎজেরাল্ডের ছোটগল্প ‘দ্য কিউরিয়াস কেইস অব বেঞ্জামিন বাটন’ অবলম্বনে পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চার অল্প অল্প করেই পর্দায় বেঞ্জামিনের পুরো গল্পটা সাজিয়েছেন। ফিঞ্চারের আগে যাদের কৃতিত্ব দিতে হয় তাদের একজন এরিক রথ; যিনি ফরেস্ট গাম্প, দ্য ইনসাইডারের মতো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য বুনেছেন। অপরজন রবিন সুইকর্ড। ২৪০ পৃষ্ঠার চিত্রনাট্য পড়ে মুগ্ধ পরিচালক ফিঞ্চার এর আগে পড়েননি মূল গল্প! এতে সমস্যা হয়নি বিন্দুমাত্র। নিজের আবেগ ও বুদ্ধির খেলায় তিনি জিতেছেন ভক্ত, সমালোচক সবার মন।
পরিচালকের পর এতে অবশ্যই অবদান ব্র্যাড পিটের, যিনি অভিনয় মুন্সিয়ানায় হঠাৎ হঠাৎ ভাবাতে বাধ্য করেছেন আদৌ সিনেমা দেখছি কিনা এই ভেবে! তাতে পূর্ণতা দিয়েছে অস্কারজয়ী মিউজিক কম্পোজার আলেক্সান্ডার ডেসপ্ল্যাটের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এটি এমন এক সিনেমা, যেটি না দেখে শুধুমাত্র আবহসঙ্গীত শুনে অনেকটা সময় পার করে দেওয়া যাবে। ভিন্ন এক অনুভূতির ঢেউ এসে ভিজিয়ে দেবে দর্শকের হৃদয়। এতখানি ভালোবাসা দিয়ে গড়া সঙ্গীত, যা ছাড়া প্রতিটি দৃশ্য অচল মনে হবে। আর যেটি ছাড়া অচল ছিল গোটা সিনেমা, তা হলো মেকআপ এবং ভিএফএক্স। এই দুটোর সম্মিলন একই ছবিতে ব্র্যাড পিটের বিভিন্ন বয়সের লুকগুলোকে করে তুলেছে জীবন্ত।
২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ‘দ্য কিউরিয়াস কেইস অব বেঞ্জামিন বাটন।’ বিশ্বজুড়ে ৩৩৫.৮ মিলিয়ন ডলার আয় করা ছবিটি সমাদৃত হয় দর্শক সমালোচক সকল মহলে। অস্কারে ১৩টি মনোনয়ন পেয়ে বেস্ট ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, বেস্ট মেকআপ, বেস্ট আর্ট ডিরেকশন- এই তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠত্ব বাগানো বেঞ্জামিন বাটনের ঝুলিতে থাকা মোট অ্যাওয়ার্ডের সংখ্যা ৮৩টি!
প্রায় পৌনে তিন ঘন্টার সিনেমায় রুদ্ধশ্বাস থ্রিল নয়, হিমশীতল ভয় নয়, তবু কোথাও যেন উৎকন্ঠা ঠিকই ডালপালা মেলে। কী হচ্ছে? কী হবে? শুরুর দিকে একটু ধীরগতিতে এগোনো সিনেমাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় চোখজোড়া আটকে রাখবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শেখাবে হাজারও প্রতিকূলতার মাঝেও জীবনকে উপভোগ করতে, আত্মবিশ্বাসী হতে, সন্তুষ্ট থাকতে।