“Let’s go. Let’s publish.”
কাঁপা কাঁপা গলায় টেলিফোনে কথাগুলো বললেন মেরিল স্ট্রিপ, বাকিটা ইতিহাস। কিংবদন্তি পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য পোস্ট’ সিনেমার একটি সংলাপ এটা। স্টিভেন স্পিলবার্গ ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে পছন্দের পরিচালক। তিনি যেমন শিন্ডলার্স লিস্টের মতো ক্লাসিক সিনেমা বানান, ইন্ডিয়ানা জোনস বা মাইনরিটি রিপোর্টের মতো বাণিজ্যিক সিনেমাও বানান। সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মান করা হয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ‘পেন্টাগন পেপারস’ নামক গোপন নথি ফাঁস করে দেয়া নিয়ে। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের আগে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এই নিউজ ছাপায়। জার্নালিজম নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ‘স্পটলাইট’ এর পর আরেকটি দারুণ মুভি বলা যায় একে। কিন্তু এই সিনেমার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে বিতর্কও আছে।
সাবেক মেরিন সেনা ডেনিয়েল এলজবার্গ ১৯৬৪ সালে পেন্টাগনভিত্তিক বিশ্লেষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের ১ অক্টোবর রাতে তিনি তার কর্মক্ষেত্র অলাভজনক গবেষণা সংস্থা র্যান্ডের একটি সেফে সরকারের গোপন কিছু নথি খুঁজে পান। প্রায় ৭,০০০ পৃষ্ঠার সেই নথিগুলো তিনি রাতের পর রাত ফটোকপি করেন। এতে তিনি সরকারের ভয়াবহ অপরাধের প্রমাণ পান। নথিতে জানা যায়, সরকার ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হবে, তা অনেক আগেই জানতো। কিন্তু জনগণের কাছে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল। ছয় বছর ধরে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আমেরিকান সেনাদের ভিয়েতনামে পাঠাচ্ছিল শুধু নিজেদের ইগোর জন্য। একদিকে বিশ্বের কাছে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্য যুদ্ধ চলমান রাখছিল, অন্যদিকে এতে অনেক আমেরিকান সৈন্য মারা যাচ্ছিল।
এলজবার্গ এটা জানতে পেরে অপরাধ বোধে ভুগতে থাকেন। তিনি অনেকদিন ধরে কোনো মাধ্যম খুঁজছিলেন যেখানে নথিগুলো প্রকাশ করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এলজবার্গ নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক নিল শিহ্যানের সাথে দেখা করেন। তিন মাস পর রবিবার ১৩ জুন ১৯৭১ সালে পেন্টাগন পেপারস নিয়ে প্রথম নিউজ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এটি প্রথম পাতায় শিরোনাম পায়। পরের দিন তারা আরেকটি নিউজ করে এটা নিয়ে। এটা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসনকে ক্ষেপিয়ে তোলে। সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জন এন মিচেলের টেলিগ্রাম আসে টাইমসের কাছে। এতে সরকারের গোপন তথ্য ভবিষ্যতে প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়। যদি করা হয় তা হবে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওপর নিষেধাজ্ঞাতে ওয়াশিংটন পোস্টের সুযোগ দেখেন তখনকার সম্পাদক বেন ব্র্যাডলি। এলজবার্গের কাছ থেকে গোপন নথিগুলো তখন ওয়াশিংটন পোস্ট সংগ্রহ করে। এই নথিগুলো ওয়াশিংটন পোস্ট শুক্রবারে দৈনিকে প্রকাশ করে। আর এই নথি প্রকাশের পেছনের ঘটনা নিয়েই স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য পোস্ট’ সিনেমা।
ওয়াশিংটন পোস্ট তখন আঞ্চলিক একটি ক্ষুদ্র পত্রিকা। সিনেমার তথ্যমতে তখন এর রিপোর্টার ছিল মাত্র ২৫ জন। আর্থিকভাবেও ধুঁকছিল পত্রিকাটি। নিউজ প্রকাশের মাত্র কিছুদিন আগে পত্রিকাটি পাবলিক কোম্পানি হিসেবে শেয়ার বাজারে নাম লেখায়। অন্যদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস খুবই প্রভাবশালী প্রথম সারির পত্রিকা। সেই টাইমসই যখন এই নিউজ প্রকাশ করায় সরকারের রোষানলে পড়ে, সেখানে ওয়াশিংটন পোস্টের শেয়ারের অংশীদাররা এত বড় নিউজ প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু ব্র্যাডলি ছিলেন একগুঁয়ে। তিনি প্রকাশক ক্যাথেরিন গ্রাহামকে রাজি করিয়ে ছাড়েন পেন্টাগন পেপারস প্রকাশ করার জন্য। এতে ওয়াশিংটন পোস্টের নেতৃস্থানীয় সবারই জেলে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল।
অবশেষে প্রকাশক ক্যাথরিন গ্রাহাম সবুজ সংকেত দিলে নিউজটি প্রকাশ পায়। সেদিনই পত্রিকার অফিসে সহকারী এটর্নী জেনারেলের ফোন আসে এটি নিয়ে আর নিউজ প্রকাশ না করার জন্য। কিন্তু ব্র্যাডলি তা নাকচ করে দেন। এতে নিউ ইয়র্ক টাইমস আর ওয়াশিংটন পোস্ট দুই পত্রিকাকেই সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখীন হতে হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় পত্রিকা দুটির পক্ষে যায়। এই ঘটনা ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদস্যদের ফেরত নিয়ে আসতে বাধ্য করে। একইসাথে সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতার জন্যও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটি।
সিনেমার চিত্রনাট্য প্রথমে লেখা হয় ওয়াশিংটন পোস্টের সাবেক প্রকাশক ক্যাথেরিন গ্রাহামের আত্মজীবনী ‘পার্সোনাল হিস্টোরি’ বই অবলম্বনে। পরে ব্র্যাডলির আত্মজীবনী ‘এ গুড লাইফ’ থেকেও চিত্রনাট্য যোগ করা হয়। চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বে ছিলেন লিজ হ্যানাহ ও জশ সিংগার। হ্যানাহ নতুন হলেও সিংগার ‘স্পটলাইট’ এর চিত্রনাট্যের দায়িত্বেও ছিলেন। এ সিনেমাতেও তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। সত্তরের দশকের সেট নির্মাণেও সিনেমাটি প্রশংসার দাবি রাখে।
সিনেমার কাস্টিংয়ে ছিলেন দুই অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী টম হ্যাংকস ও মেরিল স্ট্রিপ। দুজনই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। তবে মেরিল স্ট্রিপ ছিলেন দুর্দান্ত। তিনি ক্যাথেরিন গ্রাহামের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সিনেমায় দেখা যায়, গ্রাহাম নারী হওয়ায় প্রকাশক হিসেবে পত্রিকার শেয়ার হোল্ডারদের কাছে সম্মান পেতেন না। তারা মনে করতো, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন। তিনি কখনো প্রকাশক হওয়ার যোগ্য নন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাটি তার বাবা ইউজিন মেয়ার কেনেন ১৯৩৩ সালে। পরে ১৯৪৬ সালে তিনি এর দায়িত্ব ক্যাথেরিনের স্বামী ফিল গ্রাহামের কাছে দেন।
১৯৬৩ সালে ক্যাথেরিনের স্বামী আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ত্রিশ বছর ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাথেরিন। সিনেমার শুরুর দিকে তাকে অনেক দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়। শেষের দিকে এসে তাকে সাহসী নারী হিসেবে দেখানো হয়। বাস্তবে ক্যাথেরিন তখন এতটা কনফিউজড চরিত্রেরও ছিলেন না। এটা সত্য যে, পত্রিকার দায়িত্ব নেয়ার শুরুতে তিনি আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলেন। কিন্তু পেন্টাগন পেপারস প্রকাশের সময় তার আট বছর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ছিল।
সম্পাদক বেন ব্র্যাডলির চরিত্রটি করেন টম হ্যাংকস। অসাধারণ হিউমার ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি চরিত্র। ব্র্যাডলির নেতৃত্বগুণ কতটা তুখোড় ছিল তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় এই চরিত্র থেকে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওপর প্রেসিডেন্ট প্রশাসনের হুমকিতে সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চাইছিল। কিন্তু ব্র্যাডলি চিন্তা করলেন আরো বড় পরিসরে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সিনেমায় টম হ্যাংকসের সংলাপে। তিনি বলেন, “এই আঘাত শুধু টাইমসের ওপরই নয় ওয়াশিংটন পোস্টের ওপরও। সব সংবাদপত্রের ওপরই। আজ চুপ থাকলে কাল সব সংবাদপত্রেরই এমন অবস্থা হবে।” আর তাই তো ক্যাথেরিন গ্রাহাম চরিত্রে অভিনয় করা মেরিল স্ট্রিপ বলেন, “Let’s publish!” সেদিন যদি ব্র্যাডলি আর গ্রাহাম এই সংবাদ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত না নিতেন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতা আজকের মতো থাকতো না।
সিনেমার পার্শ্বচরিত্রগুলোও প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ করে বব উডেনকার্ক তো মাঝে মাঝে হ্যাংকস স্ট্রিপ দুজনকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ব্রেকিং ব্যাড আর বেটার কল সউলের দর্শকদের কাছে ‘সউল গুডম্যান’ নামেই পরিচিত। তবে পেন্টাগন পেপারসের উৎস ডেনিয়েল এলসবার্গের চরিত্রটি আরো বেশি সময় পাওয়ার দাবিদার।
ওয়াশিংটন পোস্ট পরের বছর ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আবার বড় ধাক্কা দেয় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস করে। তখন বড় ভূমিকা রাখেন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড। এটা নিয়ে ১৯৭৬ সালে নির্মিত হয় “অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স ম্যান” সিনেমাটি। এতে বেন ব্র্যাডলির ভূমিকায় অভিনয় করে অস্কারে সেরা পার্শ্বচরিত্রের পুরষ্কার জেতেন জেসন রবার্ডস। সেই সিনেমার প্রিকুয়েলই যেন ‘দ্য পোস্ট’ সিনেমাটি। ওয়াটার গেটের সময়ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ছিলেন ক্যাথেরিন গ্রাহাম। কিন্তু তাকে “অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স ম্যান” সিনেমায় গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেই দায়টাই যেন মেটালেন স্টিভেন স্পিলবার্গ দ্য পোস্ট সিনেমার মাধ্যমে।
তবে সিনেমায় শুধু ওয়াশিংটন পোস্ট বা গ্রাহামকে মহিমান্বিত করার অভিযোগ আছে। পেন্টাগন পেপারস জনগণের কাছে উন্মুক্ত করায় অবশ্যই গ্রাহামের অবদান আছে। তবে এটি প্রথমবারের মতো আলোর মুখ দেখে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সেই সময়ের প্রকাশক আর্থার শুলজবার্গারের কারণে। তিনি ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশ করার অনুমতি না দিলে ওয়াশিংটন পোস্টও হয়তো এটার খবর জানতে পারতো না। পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশ করার জন্য পুলিতজার পুরষ্কারও পায় নিউ ইয়র্ক টাইমস। সেগুলোর কিছুই দ্য পোস্ট সিনেমায় বলা হয়নি। এসব বিতর্ক একদিকে সরিয়ে রেখে যদি সিনেমাটি দেখেন, খুব ভালো একটি থ্রিলার মুভি দেখতে পারবেন। সিনেমায় সবচেয়ে ভালো লাগবে যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা হলেও নিজেদের দুর্দিনে তারা এক হয়ে লড়েছিল।