জীবনে চলার পথে অনেক কিছুর সাথেই আমাদের আপোস করতে হয়। অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। কিংবা পরিস্থিতি আমাদের দিয়ে অনেক অসাধ্যও সাধন করায়। কিন্তু পরিবারের পিছুটানে আমরা সেসব বেমালুম চেপে যাই। অনেক সময় এমন অনেক অন্যায় করা হয়ে যায়, যেগুলো আসলে কারো সাথে ভাগ করা হয়ে ওঠে না। এমনকি পরিবারের প্রিয়জনের সাথেও না।
মিথ্যার একটা বলয় দিয়ে তৈরী অনেক সম্পর্কই টিকে থাকে হাসিখুশিতে ভরপুর। কিন্তু কথায় আছে, সত্য কখনো চাপা থাকে না। আচমকাই সত্য প্রকাশ পেলে দেখা যায়, কেঁচোর বদলে আস্ত সাপ বেরিয়ে আসে মিথ্যার বলয় থেকে ছাড়া পেয়ে। তখন হাসিখুশিতে ভরা মিথ্যের বলয়ে তৈরী সম্পর্ক তাসের ঘরের মতোই তছনছ হয়ে যায়।
অ্যাডাম প্রাইস। একজন সুখী মানুষ। স্ত্রী ক্যারিন প্রাইস আর দুই সন্তান- রায়ান আর টমাসকে নিয়ে তার সুখী পরিবার। নিজের স্ত্রী আর সন্তানদের ব্যাপারে বরাবরই বেশ সচেতন আর যত্নশীল অ্যাডাম। আর রায়ান এবং টমাসও মা-বাবা, দু’জনেরই খুব ভক্ত। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথেও বেশ ভালোই খাতির অ্যাডাম পরিবারের। সবদিক মিলিয়ে একদম আহ্লাদমাখা সুখেই কাটছিল তাদের জীবন।
একদিন রায়ানের স্কুলের ফুটবল খেলার মধ্য বিরতিতে অ্যাডামের কাছে এক আগন্তুক আসে। বেজবল ক্যাপ পড়া একটা অপরিচিত মেয়ে। কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করেই মেয়েটা বলে- দু বছর আগের ক্যারিনের গর্ভবতী হওয়া আর গর্ভপাতের বিষয়টা ছিল নিতান্তই মিথ্যে আর সাজানো একটা ঘটনা। ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় অ্যাডাম।
সেই স্তব্ধতার সুযোগেই আগন্তুক তাকে প্রাথমিক কিছু তথ্য দেয়। যাতে অ্যাডাম নিজেই খুঁজে বের করতে পারে যে, কথাগুলো সত্য। সুখের সাজানো সংসারটা মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতোই ভেঙে যায়। সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে শুরু করে।
বাসায় ফিরে আগন্তুকের দেওয়া তথ্যমতো খোঁজাখুঁজি শুরু করে অ্যাডাম। তাৎক্ষণিক কিছু তথ্য প্রমাণিতও হয়ে যায়। অ্যাডাম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। মাথার মধ্যে তখন চিন্তার ঝড় ছুটছে তার। তাহলে কি রায়ান আর টমাস তার নিজের রক্ত নয়? সবকিছু কেমন যেন গুবলেট পাকিয়ে যায়। ক্যারিনের অপেক্ষায় অ্যাডাম। তার সবকিছুর উত্তর জানতে হবে।
ক্যারিনের সাথে সরাসরি কথা বলে অ্যাডাম। প্রথম অবস্থায় ক্যারিন সবকিছু অস্বীকার করলেও, পরে মেনে নেয়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্যারিন নিখোঁজ। অ্যাডামের মোবাইলে একটা টেক্সট দিয়ে বলেছে, সে সময় চায়।
ঠিক এরপর থেকেই রক্তমাংসের ক্যারিন হুট করেই একদম বাতাসে মিলিয়ে যায় যেন। অ্যাডাম সর্বাত্মক চেষ্টা করে স্ত্রীকে খুঁজে বের করার। বাচ্চারাও মাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে একদিন বাসায় পুলিশ আসে, ক্যারিনের বিরুদ্ধে ফুটবল ক্লাবের টাকা চুরির অভিযোগ নিয়ে। অ্যাডাম ধীরে ধীরে অজানার অতলে ডুবে যেতে থাকে। বাচ্চাদের প্রশ্নের মুখে কথা এড়িয়ে যেতে শুরু করে সে।
এক সকালে মফস্বল শহরটার মূল চত্ত্বরে গলাকাটা একটা আলপাকা মেলে। ডিটেক্টিভ রস আর গ্রিফিন তদন্তে নামে। তদন্ত করতে গিয়ে তারা নদীর পাড়ে নগ্ন আর আহত দান্তে গুটারসনকে খুঁজে পায়। আরও খোঁজাখুজি করে জানা যায়, আগের রাতে জঙ্গলের কাছে সমবয়সী কয়েকটা ছেলেমেয়ে মিলে পার্টি করেছিল। সেই পার্টিতে অ্যাডামের বড় ছেলে টমাসও ছিল। কিন্তু দান্তের কী হয়েছিল, তা জানতে হলে ডিটেক্টিভদের অপেক্ষা করতে হবে ওর জ্ঞান ফেরা অবধি।
অ্যাডামের বড় ছেলে টমাসের ঘরে আলপাকার একটা কাটামুণ্ডু লুকানো আছে। সে স্কুল পালিয়ে আসে, মুণ্ডুটা ফেলে দিতে। তারপর কথায় কথায় জানতে পারে যে, তাদেরই এক বান্ধবীর কারণে এত ঝুট-ঝামেলার সৃষ্টি। কথা বলতে গিয়ে সেই বান্ধবীর গোপন এক রহস্য আবিষ্কার করে ফেলে ওরা। গল্প ধীরে ধীরে আরো জট পাকাতে শুরু করে। এরই মাঝে একদিন সেই আগন্তুকের সামনে পড়ে যায় অ্যাডাম। নিজের স্ত্রী গায়েবের সাথে আগন্তুকের যোগসূত্রের কথা ভেবে মেয়েটাকে ধাওয়া করে অ্যাডাম।
কে এই আগন্তুক? কেনই বা সে আচমকা এসে অ্যাডামের এই সাজানো সংসারটাকে তছনছ করে দিল? ক্যারিনের কি হয়েছিল শেষমেশ? শুধু কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এর ভেতর? দান্তেকে ওরকম অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল কেন? আর ঐ আলপাকার মুণ্ডুটাই বা কাটলো কে? ক্যারিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কি তাহলে সত্যি? এজন্যই কি ক্যারিন গা ঢাকা দিয়েছে? এসবই জানতে হলে দেখতে হবে হারলান কোবেনের গল্পে নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজ দ্য স্ট্রেঞ্জার।
হারলান কোবেন বিশ্বসাহিত্যের জগতে, বিশেষ করে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এক নাম। বাংলায় বললে বলা যায়, মনস্তাত্ত্বিক রহস্যোপন্যাসের লেখক। যাই হোক না কেন, দুর্দান্ত সব থ্রিলার গল্প পাঠকদের উপহার দেয়ার জন্য হারলান কোবেন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারও হয়েছেন। নেটফ্লিক্সের এই সিরিজটির মূল গল্পটাও তার রচিত বই দ্য স্ট্রেঞ্জার থেকেই নেওয়া।
বিশ্ব জুড়ে ৪৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে হারলান কোবেনের রচনা। এর আগে নেটফ্লিক্স নির্মিত সেইফ এবং দ্য ফাইভ টিভি সিরিজের প্রযোজক এবং লেখক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া, ফরাসি ভাষায় নির্মিত দু’টি ছোট টিভি সিরিজ- ‘সেকেন্ড চান্স’ এবং ‘জাস্ট ওয়ান লুক’ এর সাথেও জড়িত ছিলেন হারলান কোবেন।
হারলান কোবেনের উপন্যাস ‘টেল নো ওয়ান’, যা নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার বই- অবলম্বনে ফরাসি ভাষায় নির্মিত একই শিরোনামের সিনেমাটিও ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়েছিল। এডগার, সামুস এবং অ্যান্থনি অ্যাওয়ার্ডের মতো দামি পুরস্কার আছে তার অর্জনের ঝুলিতে।
নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে এই সিরিজেরও জন্ম হয়েছে হারলান কোবেনের হাতেই। সিরিজটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ড্যানিয়েল ও’হারা এবং হান্নাহ কুইন। চিত্রনাট্য লিখেছেন ড্যানিয়েল ব্রোকেলহার্স্ট, মাইক ফোর্ড, শার্লেট কোবেন, কারলা ক্রোম এবং হারলান কোবেন নিজেই। সিরিজটি প্রযোজনায় হারলান কোবেন ছাড়াও ম্যাডোনা ব্যাপ্টিস্ট, রিচার্ড ফি এবং ড্যানিয়েল ব্রোকেলহার্স্ট ছিলেন।
অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ড আরমিতেজ, অ্যাডাম প্রাইস চরিত্রে। তার স্ত্রী ক্যারিন প্রাইসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডার্ভলা কিরওয়ান। দুই সন্তান রায়ান আর টমাসের চরিত্রে অভিনয় করেছে যথাক্রমে মিশা হ্যান্ডলে এবং জ্যাকোব ডাডম্যান। গোয়েন্দা জোহানা গ্রিফিন চরিত্রে শিওভান ফিননারান এবং ডিসি ওয়েসলি রস চরিত্রে কাদিফ কিরওয়ান ছিলেন। রিচার্ডের প্রতিবেশী ও বন্ধু ডগ ট্রিপ চরিত্রে ছিলেন শন ডুলে। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দ্য স্ট্রেঞ্জার বা আগন্তুক চরিত্রে ছিলেন হান্নাহ জন-কামেন।
নেটফ্লিক্সের নির্মাণ নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। ইতোমধ্যেই নার্কোস, ডার্ক, ব্ল্যাক মিরর কিংবা হালের দ্য উইচার দিয়ে নিজেদের জাত চিনিয়েছে এই অনলাইন স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট। দ্য স্ট্রেঞ্জারেও একই ধরনের অনুভূতি হয়েছে। দুর্দান্ত চিত্রগ্রহণ। বিশেষ করে লোকেশন বা স্থান নির্বাচন। একইসাথে চিত্রগ্রহণ থেকে শুরু করে আলোকচিত্র কিংবা সম্পাদনা একদম নিখুঁতই বলা চলে।
আর ইদানীংকালে যে ব্যাপারটা নেটফ্লিক্সের সবচাইতে ভালো লাগে, তা হচ্ছে প্রতিটি সিরিজের অনন্য সব আবহসঙ্গীত। ‘ওয়াকিং ওন কার’ নামক আইরিশ ব্যান্ডের ‘মনস্টার’ গানটাকেই বাছাই করা হয়েছে এই সিরিজের আবহসঙ্গীত হিসেবে। গানের কথাগুলোর সাথে সিরিজের যে প্রত্যক্ষ একটা মিল আছে, তা পাঠক দেখলেই বুঝতে পারবেন।
“ডেঞ্জার নকিং অ্যাট মাই ডোর
ডোন্ট কাম রাউন্ড রাউন্ড, হেয়ার নো মোর
আই চেক দ্য লকস, শাট দ্য উইন্ডোস ডাউন
দিস মনস্টারস ব্যাক ইন টাউন”
অভিনয়ের ক্ষেত্রে রিচার্ড সকল বাধা পেরিয়ে গেছেন। অন্তত তাই মনে হয়েছে প্রথম সিজন শেষ হবার পর। সুখী একটা মানুষ আচমকাই কী করে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে; আবার একইসাথে স্ত্রী লাপাত্তা হলে দিশেহারা স্বামীতে কীভাবে পরিণত হয়- তা খুব ভালো করেই আত্মস্থ করেছেন রিচার্ড।
স্ট্রেঞ্জার চরিত্রে হান্নাহ জন-কামেন নিজের সম্পূর্ণটাই দিয়েছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গল্প যত গভীরে গিয়ে জট পাকিয়েছে, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই চরিত্রটা। আর তাতে হান্নাহ একদম তালে তাল মিলিয়ে অভিনয় করেছেন।
আবার বিশ্বস্তপূর্ণ অথচ রহস্যময় প্রতিবেশী এবং বন্ধু ডগ ট্রিপের চরিত্রে শন ডুলে ছিলেন অনবদ্য। চরিত্রটা যেমন রহস্যময়, ঠিক তেমনি অভিনয়টাও ছিল বিশ্বস্তপূর্ণ। আরেকটা চরিত্রের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোয়েন্দা জোহানা গ্রিফিন চরিত্রে শিওভান ফিননারানের কথা।
নিজের পেশাগত জীবনের শেষের দিনগুলোতে এসে নিঃসঙ্গ একটা জীবনযাপন করছে জোহানা। এর মাঝে অ্যাডাম আসে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর সন্ধানে; অন্যদিকে দান্তের অদ্ভুত আচরণের কারণ অনুসন্ধান; আবার মুণ্ডুবিহীন আলপাকার কথা তো আছেই। এর মধ্যে জীবন রঙিন হতে শুরু করে একদিকে, আর অন্যদিকে বেদনার চরম মুহূর্তও এই চরিত্রটার জন্য অপেক্ষায় আছে। এমন একটা চরিত্রে একেবারেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন শিওভান।
তবে হ্যাঁ, অনেক ভালোর মধ্যেও কিছুটা খামতি ছিল। বেশিরভাগ দর্শকের কাছেই এটা মনে হবে যে, শুরুটা যেমন দুর্দান্ত ছিল শেষটা কেমন যেন মিইয়ে গেছে। আবার, প্রথম পর্বের পরের তিনটা পর্ব বিরক্তির উদ্রেকও ঘটাতে পারে। আর পুরো সিজন শেষে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে চুপচাপ দ্বিতীয় সিজনের অপেক্ষা করতে হতে পারে। প্রশ্নগুলো করা যাচ্ছে না স্পয়লারের ভয়ে। তাই দ্বিতীয় সিজনের অপেক্ষা। আর হ্যাঁ, দুটো মানুষের ভালো লাগা বৈচিত্র্যময় বলেই একজনের ভালো লাগলেও অন্যজনের কাছে খারাপ লাগতেই পারে।
উপরে দেওয়া গল্পের সারসংক্ষেপ পড়ে যদি ভেবে থাকেন, এ আর এমন কি কঠিন গল্প? তাহলে ভুল ভাবছেন। কারণ, প্রথম চারটা পর্বে আপনি শুধু ক্যারিনকেই খুঁজবেন; কিন্তু এরপর থেকে আপনি বাধ্য হবেন প্রতিটা চরিত্রের পেছনে থাকা ভিন্ন সত্ত্বার মানুষটিকে খুঁজতে। প্রতিটা চরিত্রই দ্বি-সত্ত্বা বিশিষ্ট। প্রতি মানুষেরই একটা করে পেছনের গল্প থাকে।
হারলান কোবেন চেষ্টা করেছেন, মানব মনের সেই অন্ধকার চরিত্রটিকেই ফুটিয়ে তুলতে। উপন্যাসে কতটা সফল হয়েছেন, তা বলা যাচ্ছে না তবে সিরিজে অনেকটাই ফুটে উঠেছে চরিত্রগুলো। তাহলে এখন অপেক্ষা দ্বিতীয় সিজনের।
The Stranger বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।