
পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যা কখনোই মূল্য দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তেমনই একটি জিনিস হলো বই। বইয়ের পাতার প্রতিটি বাক্যের ভেতরে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানকে আর যা-ই হোক, টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এতকিছুর পরেও বেশ কিছু বই রয়েছে, যেগুলোর নামের পেছনে লেগে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ, বিরলতা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর এসব কারণেই সেই বইগুলোর মালিকানা পেতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি বইপ্রেমীরা। ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হওয়া সেই বইগুলোর উপাখ্যানই তুলে ধরা হলো আজকের লেখায়।
কোডেক্স লেস্টার
মূল্য: ৩০.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজার মূল্য: ৪৯.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
মানব ইতিহাসে শিল্প আর বিজ্ঞান উভয় জগতেরই এক অসামান্য প্রতিভা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হাতে লেখা ৩০টি নোটবুকের একটি হলো কোডেক্স লেস্টার। এই কোডেক্সটিকেই ভিঞ্চির সবচেয়ে মূল্যবান নোটবুক হিসেবে ধরা হয়। ১৫০৬-১৫১০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা ৭২ পৃষ্ঠার এই নোটবুকটিতে দ্য ভিঞ্চি আলোকপাত করেছেন সূর্য, চাঁদ এবং পৃথিবীর সম্পর্কের ওপর, সাথে রয়েছে জোয়ার-ভাটা সহ বিভিন্ন ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

কোডেক্স লেস্টারের একটি পাতা; source: Earth Chronicles
কোডেক্সটি লেখাও হয়েছে ভিঞ্চির বিখ্যাত মিরর-ইমেজ রীতিতে, অর্থাৎ নোটবুকটির লেখা পড়া যাবে কেবল আয়নায় ধরার পর।
ভিঞ্চির মৃত্যুর পর নোটবুকটি হাতে পান বিখ্যাত ভাস্কর মাইকেলেঞ্জেলোর ছাত্র জিওভান্নি দেল্লা পোর্তা। এরপর লেস্টারের প্রথম আর্ল থমাস কোক ১৭১৯ সালে কিনে নেন এই নোটবুকটি এবং তার নামানুসারেই বইটির নাম হয় কোডেক্স লেস্টার। ১৯৮০ সালে বিখ্যাত সংগ্রাহক আরমান্ড হ্যামার লেস্টার এস্টেট থেকে ৫.১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বইটি কিনে নেন এবং ড. পেদরেত্তির হাতে দায়িত্ব দেন এটিকে ইংরেজি ভাষায় রুপান্তরের জন্য।

কোডেক্স লেস্টার; source:Wikimedia Commons
১৯৯৪ সালে ক্রিস্টির নিলামে বইটি ওঠানো হয় এবং সেখান থেকেই ৩০.৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বইটিকে নিজের মালিকানাধীন করে নেন বিল গেটস। তবে তিনি কেবল নিজের বুক-শেলভেই বইটিকে আটকে রাখেননি; পৃথিবীর আনাচাকানাচে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে এটির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন। বইটির ডিজিটাল প্রিন্টও পাওয়া যাবে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে।
ম্যাগনাকার্টা
মূল্য: ২১.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজার মূল্য: ২৪.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
১২১৫ সালের ১৫ জুন উইন্ডসরের কাছের এক দ্বীপে ইংল্যান্ডের রাজা জনকে ম্যাগনাকার্টায় সই করতে বাধ্য করেন ব্যারনরা এবং এভাবেই সূচনা ঘটে নতুন এক দিগন্তের। এর ফলে স্বয়ং রাজাও আইনের অধীনস্ত হয়ে পড়েন, ৪৯ ধারার এই লিখিত চুক্তিতে মোহর মেরে ব্যারনদের অধিকার মেনে নেন রাজা। কিন্তু এরপরেও বেশ কয়েকবার ম্যাগনাকার্টাকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, ব্যারনদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাজারা এবং এরপর আবারও ম্যাগনাকার্টাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

রাজা জন; source: Discover Middle Ages
২০০৭ সালের নিলামে যে ‘ম্যাগনাকার্টা’ দলিলটিকে ২১.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, সেটি মূল ম্যাগনাকার্টার কপি হিসেবে ভাবাটা ভুল। এমনকি ১২৯৭ সালের এই কপিটিকে ‘কপি’ বললেও ভুল হবে, বরং নকলের নকলের নকল এবং একইসাথে ‘আসল’ও বটে! রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের ইস্যু করা অনেকগুলো কপি ম্যাগনাকার্টার মধ্যে এটি একটি। এরকম আরও অসংখ্য ম্যাগনাকার্টা ছড়িয়ে রয়েছে ব্রিটেনের লাইব্রেরিতে, যার বেশিরভাগেরই অন্তিম পরিণতি হয়েছে ইঁদুরের পেট, বাকিগুলো হয়ত আগুনে পুড়েছে, কোনোটি একেবারে নষ্টই হয়ে গেছে সময়ের ভারে জর্জরিত হয়ে।

‘সোথবি’র নিলামে ম্যাগনাকার্টার কপি; source: Reuters
১৯৮৪ সালে প্যারট ফাউন্ডেশনের মালিক রস প্যারট ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ইংল্যান্ডের ব্রুডনেল পরিবারের কাছ থেকে ১৫X১৭ ইঞ্চির ভেড়ার চামড়া দিয়ে বানানো এই পার্চমেন্টটিকে কিনে নেন। ২৩ বছর পর ৮০০ বছরের পুরনো এই মূল্যবান পার্চমেন্টটিকে বিক্রি করা হয় ১৪ গুণ লাভের বিনিময়ে!
সেইন্ট কাথবার্ট গসপেল
মূল্য: ১৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজার মূল্য: ১৪.৯ মার্কিন ডলার)
১,৩০০ বছর আগের বইয়ের জন্য সর্বোচ্চ কতই বা খরচ করা যায়? ইউরোপের প্রাচীনতম এবং একইসাথে অক্ষত ‘সেইন্ট কাথবার্ট গসপেল’ বইটি কেনার জন্য ব্রিটিশ লাইব্রেরিকে খরচ করতে হয়েছে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!

সেইন্ট কাথবার্ট গসপেল-এর মোড়ক; source: Erica L. Winberry
বইটি দেখার পর ব্রিটিশ লাইব্রেরির মধ্যযুগীয় ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলোর দায়িত্বে থাকা কিউরেটর ক্লেয়ার ব্রে মন্তব্য করেছিলেন,
“সুদৃশ্য অ্যাংলো-স্যাক্সন কারুকাজে সজ্জিত লাল চামড়া দিয়ে মোড়ানো এই বইটি দেখে মনেই হবে না, এটি আজ থেকে ১,৩০০ বছর আগের; বরং দেখে মনে হতে পারে, এটি সপ্তদশ শতাব্দীর। আর এর লেখাটাও দেখে মনে হচ্ছে, গতকালই লেখা হয়েছে!”
সেইন্ট কাথবার্ট ছিলেন সপ্তম শতাব্দীর ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান ধর্মযাজক। মধ্যযুগীয় ব্রিটিশদের প্যাগানিজম থেকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সেইন্ট। সেইন্ট কাথবার্ট সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে মারা যাওয়ার পর তার কফিনেই রেখে দেওয়া হয় এই মূল্যবান বইটি। পরবর্তীতে ভাইকিংরা ইংল্যান্ড আক্রমণ করার সময় তারা সেইন্ট কাথবার্টের কফিনটিও সাথে নিয়ে যায়। ১১০৪ সালের দিকে সেইন্ট কাথবার্টের নামে গীর্জা স্থাপনের সময় তার কফিন খোলা হলে গসপেলটি আবিষ্কৃত হয়।

সেইন্ট কাথবার্ট গসপেল; source: Tumblr
সপ্তদশ শতাব্দীতে বইটি স্থানান্তরিত করা হয় বেলজিয়ামের যাজক সম্প্রদায়ের কাছে। তারপর সেখানেই ২৫০ বছর থাকার পর অবশেষে বইটি কিনে নেয় ব্রিটিশ লাইব্রেরি; বিনিময়ে খরচ করতে হয় ১৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বে সম বুক
মূল্য: ১৪.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজার মূল্য: ১৪.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ‘নিউ ওয়ার্ল্ডে’র ম্যাসাচুসেটসে যখন ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ গড়ে তুললো, তখন ‘নতুন পৃথিবী’র বুকে তারা তাদের ধর্ম ছড়িয়ে দিবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাসাচুসেটসের বে কলোনিতে গড়ে তোলা হলো গির্জা। গির্জার প্রার্থনাসঙ্গীত সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কী করা যেতে পারে, তা ভাবতে ভাবতেই তাদের কাছে পৌঁছে গেল গুটেনবার্গের আবিস্কৃত প্রিন্টিং মেশিন। এভাবেই ১৬৪০ সালে আমেরিকার বুকে ছাপানো হলো প্রথম বই। গির্জার প্রার্থনাসঙ্গীতে ভরপুর বইটির নাম হলো Bay Psalm Book।

বে সম বুক-এর প্রচ্ছদ; source: Patheos
বে সম বুকের মাত্র ১১টি কপিই এখনও পৃথিবীতে টিকে রয়েছে, যার মধ্যে একটি ডেভিড রুবেনস্টাইন নামক এক মার্কিন ব্যবসায়ী বোস্টনের ওল্ড সাউথ চার্চ থেকে কিনে নিয়েছেন ১৪.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে।
রথসচাইল্ড প্রেয়ারবুক
মূল্য: ১৩.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজার মূল্য: ১৯.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
পৃথিবীর ইতিহাসের আরেকটি মহামূল্যবান বই, ‘দ্য রথসচাইল্ড প্রেয়ারবুক ‘তৈরি হয়েছিল বেলজিয়ামের ব্রুগেস শহরে, সম্ভবত ইউরোপের কোনো এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্য। ১৫০০-১৫২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া এই বই ‘বুক অভ আওয়ার্স’-এর সবচেয়ে মূল্যবান বইগুলোর একটি, যেগুলো মূলত মধ্যযুগের খ্রিস্টধর্মীয় প্রার্থনা বই।

রথসচাইল্ড প্রেয়ারবুক; source: University of Melbourne
বিখ্যাত সব চিত্রকরের ছবির পাশাপাশি এতে স্থান পেয়েছে প্রার্থনা, প্রার্থনাসঙ্গীত এবং ধর্মীয় উপদেশ। সোনা দিয়ে লাইনিং করা, পশুর চামড়া দিয়ে বানানো এবং মিনিয়েচার ছবি দিয়ে ভরপুর এই বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠাই একেকটি মাস্টারপিস।

‘দ্য রথসচাইল্ড প্রেয়ারবুক’ এবং বর্তমান মালিক স্টোকস; source: AAP
১৫০০ সালের দিকে তৈরি হলেও, এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন নাৎসি বাহিনী অস্ট্রিয়া দখলের সময় নাথানিয়েল রথসচাইল্ডের মালিকানাধীন এই বইটি লুট করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে একটি লবণ খনি থেকে বইটি উদ্ধার করে অস্ট্রিয়ার জাতীয় জাদুঘরে রেখে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে বইটিকে নিলামে তোলা হলে কেরি স্টোকস নামক এক অস্ট্রেলীয় ব্যবসায়ী ১৩.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বইটি কিনে নেন। বর্তমানে এটি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
ফিচার ইমেজ: Artsfon