“In case I don’t see you, good afternoon, good evening and good night!”
ছবির শেষ দৃশ্যে ট্রুম্যান যখন ক্রিস্টফের কোনো প্রলোভনের তোয়াক্কা না করে উপরোক্ত উক্তিটি করে কৃত্রিম সিহ্যাভেন থেকে বাস্তব সত্যের দিকে পা বাড়ায়, তখন ট্রুম্যানের অনুভূতি, ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ এর অ্যান্ডি কিংবা ‘প্যাপিলোন’ সিনেমার হেনরি প্যাপিলোনের অনুভূতি, সব যেন এক সূত্রে গেঁথে যায়। “মুক্তির চেয়ে বড় আর কিছু নাই, স্বাধীনতার চেয়ে বড় আর কিছু নাই”, এই উপলব্ধি বারবার হৃদয়ে নাড়া দিতে থাকে। সেলুলয়েডের মেকি জগতটাকে সে মুহূর্তে বড্ড সত্য মনে হয় এবং অনুভূত হয় অব্যক্ত শান্তি। ট্রুম্যান, অ্যান্ডি আর প্যাপিলোনের পথ তো একই। সে পথ বিপ্লবের, সে পথ স্বাধীনতার, সে পথ মুক্তির।
রাজনৈতিক খোশগল্প যেমন সাধারণের নিকট বেশ চিত্তাকর্ষক, সিনেমাপ্রেমীদের জন্য রাজনৈতিক সিনেমা তেমনি চিত্তাকর্ষক। একদিকে ‘অল দ্য প্রেসিডেন্ট’স ম্যান’, ‘জেএফকে’, ‘দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট’, ‘প্লাটুন’ ইত্যাদি যেমন সরাসরি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, অন্যদিকে ‘সিটিজেন কেন’, ‘কাসাব্লাঙ্কা’, ‘গডফাদার’ কিংবা ‘আর্গো’র মতো সিনেমা সরাসরি কিছু না বলে ভাবতে বাধ্য করে। কিছু ছবি দেখার পর দর্শক সহজে এর রাজনৈতিক মতাদর্শ ধরতে পারে। আবার কিছু ছবি দেখার পর দর্শক এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। তবে সাহিত্যের মতো সিনেমায় রূপকার্থে কোনোকিছুকে নির্দেশ করা, বিশেষ করে উপমার দ্বারা রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করাটা অত্যন্ত বিরল। এরকম বিরল সিনেমাগুলোর একটি হচ্ছে ‘ট্রুম্যান শো’। খালি চোখে দেখলে, পুরো ছবির কোথাও কোনোরকম রাজনীতির ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায় যে ট্রুম্যান শো এর প্রতিটি ডায়লগই রাজনৈতিক, প্রতিটি দৃশ্যই বৈপ্লবিক!
‘ট্রুম্যান শো’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৮ সালে। পিটার উইয়ার পরিচালিত ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ট্রুম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করেন জিম ক্যারি। ট্রুম্যানের স্ত্রী মেরিলের ভূমিকায় ছিলেন লরা লিনি। আর ‘ট্রুম্যান শো’ রিয়েলিটি প্রোগ্রামের পরিচালক ক্রিস্টফের ভূমিকায় অভিনয় করেন এড হ্যারিস। মুক্তির পরই সমালোচকদের প্রশংসার বন্যায় ভাসে ছবিটি। অস্কারে তিনটি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হলেও অস্কার জেতা হয়নি। তবে বাফটা, গোল্ডেন গ্লোবের মতো সম্মানজনক অনেক পুরস্কার জেতে ছবিটি। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট ছবিটিকে ‘হান্ড্রেড ইয়ারস, হান্ড্রেড চিয়ারস’ নামক বিগত (২০০৬ সালের সংস্করণ) ১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ ১০০ ছবির তালিকায় যুক্ত করে। বক্স অফিসেও দারুণ সফল হয় ‘ট্রুম্যান শো’। শুধু কি তা-ই? এটি দেখে অনেক ব্যক্তি নিজেদের ট্রুম্যান ভাবতে শুরু করে এবং মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়! এর মধ্যে এক ব্যক্তি তো তার নিজ শহর ছেড়ে নিউইয়র্ক ঘুরতে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র স্বচক্ষে দেখবার জন্য যে টুইন টাওয়ার আসলেই ধ্বংস হয়েছিল নাকি তাকে মিথ্যা নাটক দেখানো হয়েছে! তাহলে একবার ভাবুন তো, ট্রুম্যান শো সিনেমায় বাস্তবতাকে কেমন নিরাবেগভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে মানুষ নিজেদের মধ্যে ট্রুম্যানকে দেখতে শুরু করেছিল!
রাজনৈতিক আলোচনায় যাবার পূর্বে ‘ট্রুম্যান শো’ ছবির গল্প সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। সিহ্যাভেন নামক একটি ছোট্ট দ্বীপ শহরে বাস করে এক হাসিখুশি যুবক ট্রুম্যান বুরবাংক। বাড়ি, অফিস এবং সমুদ্রতীর- এই তার জীবন। নিজ শহরের বাইরে তার কখনো যাওয়া হয়নি। তবে ট্রুম্যানের ইচ্ছা শহরের বাইরে একঘেয়ে জীবন থেকে দূরে কোথায় যাওয়ার। কিন্তু ট্রুম্যান জানে না যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকাল যাবত চলা রিয়েলিটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম ‘ট্রুম্যান শো’ এর অংশ। সে জানে না যে তার আশেপাশ পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু, অফিসের সদস্যরা, রাস্তার লোকজন এমনকি নিজের স্ত্রীও সেই প্রোগ্রামের অভিনেতা মাত্র, তার আপন কেউ নয়! ট্রুম্যান জানে না যে তাকে ঘিরে থাকা সিহ্যাভেন একটি কৃত্রিম শহর যার আকাশ, বাতাস, ঝড়-বৃষ্টি, চাঁদ-সূর্য, সমুদ্র সবই কৃত্রিম। এগুলো মিলে তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টুডিও। ট্রুম্যান জানে না, সিহ্যাভেন জুড়ে ৫,০০০ ক্যামেরা তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের খবর পৌঁছে দিচ্ছে টিভি সেটের সামনে বসে থাকা বিশ্বজোড়া দর্শকের কাছে। সে জানে না, তার জীবন নাটকের এক পরিচালক ক্রিস্টফের ইচ্ছামতো পরিচালিত হচ্ছে। সে জানে না, তার পুরো জীবনটাই নিছক একটা প্রতারণা! তবে ট্রুম্যান সত্যের সন্ধানে ছোটে একসময় এবং ধীরে ধীরে আসল সত্য উদঘাটন করে, যা করতে গিয়ে সে মুখোমুখি হয় নানা সমস্যার। আর এই সমস্যাগুলো ট্রুম্যান কীভাবে মোকাবিলা করে, তা-ই নিয়ে এগোয় ট্রুম্যান শো ছবির কাহিনী।
‘ট্রুম্যান শো’ সিনেমার অন্তর্নিহিত ভাব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসতে হবে নজরদারির ব্যাপারটিতে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যেমন নজরদারি চালিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটদের প্রধান কার্যালয়ে। যদিও নিক্সন ধরা পড়েছিলেন শেষতক, কিন্তু তার আগে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টাইনের সত্য উদঘাটনের প্রচেষ্টা থামিয়ে দিতে। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল সত্যেরই। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা হবে কি? আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমাদের গতিবিধি প্রতিনিয়তই কারণে অকারণে নজরদারি করা হচ্ছে। আমরা টের পাই কি? ট্রুম্যান টের পেয়েছিল বলেই তাকে থামাতে নানা কসরত করতে হয়েছে পরিচালক ক্রিস্টফকে। ট্রুম্যান লিফটের দরজার ভেতরে স্টুডিও দেখে আঁতকে উঠেছিল এবং কী ঘটছে তা জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমরা তো সব দেখতে পেয়েও এড়িয়ে যাচ্ছি। বরং প্রতিনিয়ত আমাদের স্বাতন্ত্র্য ও গোপনীয়তাকে বিসর্জন দিচ্ছি পরমানন্দে। ফেসবুক, টুইটার কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আর শত শত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের কাছে আমরা সব ধরনের পারিবারিক গোপনীয়তা বিসর্জন দিয়েও দিব্যি দিন কাটাচ্ছি নিশ্চিন্তে!
কার্ল মার্ক্সের ‘ফলস কনশাসনেস’ বা ভ্রান্ত চেতনার ধারণাটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ট্রুম্যান শো সিনেমায়। ছবিতে একটি দৃশ্যে ক্রিস্টফকে এক দর্শক টেলিফোনে প্রশ্ন করেছিল যে ট্রুম্যান কেন দীর্ঘদিন যাবত সত্য উদঘাটন করতে পারেনি। জবাবে ক্রিস্টফ বলেছিলেন যে, “আমাদেরকে যা দেখানো হয়, আমরা তা-ই সত্য বলে মনে করি!” এর মানে কি আমরা মিথ্যার মধ্যে বাস করি? ট্রুম্যান শো ছবিটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমরা মিথ্যার মধ্যেই বাস করছি। ছবির শুরুতেই মেরিলকে বলতে শোনা যায়, “ব্যক্তিগত আর সর্বজনীন জীবনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।” ট্রুম্যানের বন্ধু মারলনের গলায়ও একই সুর, “ট্রুম্যানের কোনোকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। সবই সত্য।” অথচ সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই যে ট্রুম্যানের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই নেই, সবই নিয়ন্ত্রিত। কিছু উদাহরণ দিলেই পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে। ছবির শুরুতেই দেখা যায় সিহ্যাভেনের কৃত্রিম আকাশ থেকে কোনো ত্রুটির কারণে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা সিরিয়াস (যা কিনা একটি স্টুডিও লাইট) খসে পড়ে ট্রুম্যানের বাড়ির সামনে। ট্রুম্যান এর কারণ ভাবতে শুরু করলেই তার গাড়িতে চলতে থাকা রেডিওতে প্রচার করা হয় যে সিহ্যাভেনের আকাশে একটি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে ফেলে দেয়! অর্থাৎ ট্রুম্যানের মুক্তচিন্তাকে একটি ‘ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডা’র মাধ্যমে দমিয়ে দেয়া হলো। পাঠক চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো আপনার আশেপাশে এমন ঘটনা ঘটছে কিনা।
ট্রুম্যানের জীবন নিয়ন্ত্রিত, তবু তার বন্ধু ভাবছে সব সত্য। তার স্ত্রী তো আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনকেই বাইরের জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। এগুলোই হচ্ছে ‘ফলস কনশাসনেস’ বা ভ্রান্ত চেতনা, যার ধারণা মার্ক্স দিয়েছিলেন। এগুলো কীভাবে সম্ভব হয়, তা-ও সবিস্তারে দেখিয়েছে ট্রুম্যান শো। মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত চেতনা আর বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে ব্যবহার করা হয় নানা প্রভাবক। ভীতি এর মধ্যে অন্যতম। “It could happen to you!” শিরোনামে একটি প্লেন ক্র্যাশের পোস্টার যত্রতত্র সেঁটে রাখা হয় সিহ্যাভেনে শুধুমাত্র ট্রুম্যানের মনে বিমানযাত্রা সম্বন্ধে ভয় ঢোকাতে। লঞ্চে করে নদীর অপর পাড়ে যাবে ট্রুম্যান, কিন্তু তার সামনে রাখা হয় একটি ডুবে যাওয়া নৌকা, যা তার জলভীতিকে আরো উসকে দেয়। বাস্তব জীবনে এমন প্রভাবক কি নেই?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে মিডিয়া সেলিব্রিটিদের সাথে আমাদের সকলের পরিচয় রয়েছে, যাদের কেউ কেউ সস্তা বিনোদন দিয়ে আমাদেরকে দূরে রাখছে বাস্তবতা থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের সেলিব্রিটি হিসেবে তৈরি করে কারা? তাদের উপর সাধারণের ফোকাস রাখলে লাভটা হয় কাদের?
‘ট্রুম্যান শো’তেই ফিরি চলুন উত্তরের খোঁজে। একেবারে শেষ দৃশ্যের কথা মনে আছে তো? ট্রুম্যানকে কোনোভাবেই আটকে রাখতে না পেরে ক্রিস্টফ শেষপর্যন্ত ট্রুম্যানকে বলেছিল যে, ট্রুম্যান একজন ‘স্টার’, ট্রুম্যান লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা। পরিষ্কার হচ্ছে তো ধীরে ধীরে? এরকম সেলিব্রিটি তৈরি করে ক্রিস্টফরা আড়ালে বসে হাতিয়ে নিচ্ছে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ আর নষ্ট করছে মূল্যবান সময়। কিন্তু মানুষ তা একবারও ভেবে দেখে কি?
ট্রুম্যানের পৃথিবীটা ছিল আজকের বিশ্বের মতোই বিজ্ঞাপনময়। সারাক্ষণ ট্রুম্যানের স্ত্রী আর বন্ধু মিলে নানা কিছুর বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হতো ট্রুম্যানের সামনে। সিহ্যাভেন ছেড়ে ফিজি গিয়ে ঘুরে আসার কথা বলায় মেরিল ট্রুম্যানকে বিছানায় আমন্ত্রণ জানায়। এসবই তো বিজ্ঞাপনময় পৃথিবীর উদাহরণ। সাধারণের মাঝে জাঁকজমক আর চাকচিক্যের প্রলোভন তৈরি করে তাদের ভোগবাদী করতে পারলেই তো ধনী বুর্জোয়া শ্রেণীর মুনাফার্জন বেশি হবে। সদা সর্বত্র সূক্ষ্মভাবে যৌন সুড়সুড়ি দেয়া মেরিলের মতো টিভি মডেলদের নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। কিন্তু আলোচনা মুষ্টিমেয় লোকের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠরা ঠিকই আরোপিত যৌনতা আর ভোগের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছে।
যখনই এই বিকিয়ে যাওয়া রোধ করতে চেয়েছে ট্রুম্যান, তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তাকে মেকি চাঁদের সৌন্দর্যে অবগাহন করতে উপদেশ দিয়েছে তার বন্ধু। অথচ সে চাঁদ যে কৃত্রিম, তা কি ট্রুম্যান জানতো? বাস্তব পৃথিবীতে কি এরূপ ঘটনা ঘটছে না? প্রতিনিয়ত ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমরা যখন ক্লান্ত হই, তখনই আমাদের সামনে বিনোদনের নামে অর্থহীন সব অখাদ্য হাজির করা হয়। আমাদের সামনে বাহারি পণ্যের রঙিন বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে দেয়া হয়, যা দেখে আমরা সাময়িকভাবে দুঃখ ভুলে যাই, সত্য থেকে আরো দূরে সরে যাই। আমরা ডুব দিই ‘কনজুমারিজম’ বা ভোগবাদের অসীম সমুদ্রে।
জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে কিংবা সাময়িকভাবে ভুলিয়ে রাখতে অতীত স্মৃতি রোমন্থনই হতে পারে মোক্ষম অস্ত্র। উদাহরণ চাই? সেই দৃশ্যটির কথা মনে করুন, যখন ট্রুম্যান দেশের বাইরে যেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠায় তার স্ত্রী আর মা তাকে তাদের পুরনো ছবির অ্যালবাম দেখিয়ে সুখস্মৃতি মনে করতে শুরু করে। যখন ট্রুম্যানের বন্ধু মারলন ট্রুম্যানের মনের সন্দেহ দূর করতে নিজেদের স্কুল আর কলেজ জীবনের গৌরবময় এবং আনন্দদায়ক স্মৃতির কথা স্মরণ করতে শুরু করে। এমনকি শেষ দৃশ্যে ট্রুম্যানকে সিহ্যাভেনে ধরে রাখতে ক্রিস্টফও অতীত নিয়ে খেলার চেষ্টা করে। সে ট্রুম্যানকে মনে করিয়ে দেয় ট্রুম্যানের শৈশবের কথা, যা সে দেখে এসেছে এতদিন। এমন চমৎকার রূপকের পর আরো চমৎকার রূপক দ্বারা ট্রুম্যান শো সিনেমা এরকম ‘স্মৃতি নিয়ে খেলা’ থেকে পরিত্রাণের পথ দেখিয়েছে। হ্যাঁ, ট্রুম্যান একটি ম্যাগনিফাইং কাঁচ দিয়ে নিজের বিয়ের অ্যালবাম দেখতে গিয়ে খুঁজে পায় স্ত্রীর প্রতারণার প্রমাণ। এখানে দর্শকের জন্য এটাই শিক্ষা যে যা কিছু খালি চোখে দেখা যায়, তা বিশ্বাসযোগ্য না-ও হতে পারে। সত্য জানতে হলে তলিয়ে দেখতে হবে অবশ্যই।
অনেক কিছুই তো আলোচনা হলো। এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পুরো সিনেমাটাই কি তাহলে শুধু নেতিবাচক ইঙ্গিতে ভরপুর? নাহ, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। ‘ট্রুম্যান শো’ একদিকে যেমন সাধারণের জীবনের অন্ধত্বকে উন্মোচন করে, অন্যদিকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে সেই অন্ধত্ব থেকে রক্ষা হবে। ট্রুম্যানকে শত চেষ্টা করেও কিন্তু সত্য উন্মোচন থেকে বিরত রাখতে পারেনি ক্রিস্টফ। যৌন প্রভাবক, ভোগবাদী উদ্দীপক, ভীতিকর প্রভাবক, স্মৃতি রোমন্থন, এমনকি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দিয়েও ক্রিস্টফ ট্রুম্যানকে সিহ্যাভেনের মেকি জগতে ধরে রাখতে পারেনি। সমুদ্রের ঢেউ তো ঢেউ নয়, তা বাস্তব পৃথিবীর শত অত্যাচার আর নিপীড়নের উপমা, যার সম্মুখীন হতে হবে সত্য পর্যন্ত পৌঁছুতে। গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে আর অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বৈপ্লবিক সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। যা কিছু শোনা যায় আর দেখা যায়, তা সর্বদা সত্য না-ও হতে পারে। একটু ভেবে দেখতে তো হবে অবশ্যই, যদি সত্য উদঘাটন করার ইচ্ছা থাকে। ‘ট্রুম্যান শো’ এ শিক্ষাই দেয় আমাদের। আর যদি সত্যের দ্বার উন্মোচন না করে ভোগবাদে ডুবে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়, তাহলে ট্রুম্যান শো আমাদের জন্য নয়।
ফিচার ছবি: wallpaperscraft.com