২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রথম উধাও সিনেমার পোস্টার দেখি। তারেক মাসুদের প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’-এর পর আমার দেখা এটি বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রের অন্যতম ব্যতিক্রমী আকর্ষণীয় পোস্টার। সেদিন পোস্টারটি পছন্দ হয় বলেই ছবিটি দেখা। উধাও ড্রামা থ্রিলার জনরার শ্বাসরুদ্ধকর সিনেমা। ছবির কাহিনী সংক্ষেপটা যদি একটু আংশিক স্পয়লার আকারে বলি— এই শহরে এসে প্রায়ই গা ঢাকা দেয় কিছু মানুষ। আবার এমন মানুষও আছে শহরে, যারা এসব গা ঢাকা দেয়া মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের তাদের পরিবার ও আপনজনদের কাছে। তবে বিনামূল্যে নয়। কাজটি করে দেয়ার বিনিময়ে পায় নগদ অর্থ। স্কুল-ভ্যান চালক বাবু সেই ক্যাটাগরির একজন। যাকে এমন মহৎ কাজের জন্য লোকে ভালোবেসে রবিনহুড সম্বোধন করে। কাজের ধারাবাহিকতায় একদিন বাবু কিডন্যাপ করে শহরের ধনবান প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আকবরকে। এরপর থেকেই শুরু হয় ছবির মূল রুদ্ধশ্বাস গল্পের। এই গল্পের প্রধান আকর্ষণ তার সংলাপের পরিমিতিবোধ আর গল্প বলার ভঙ্গিমায়। নির্মাতা এক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি গল্পে দুর্বোধ্যতা রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো অস্পষ্টতা রাখেননি। ফলত, একটি সরলরৈখিক গল্পের এমন দুর্দান্ত উপস্থাপনা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য।
স্টার কাস্টিং বলতে যা বোঝায়, উধাওতে তা নেই বললেই চলে। প্রোটাগনিস্ট আকবর এবং বাবু চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনির আহমেদ ও শাহেদ আলী। এইদুজনই উধাওয়ের প্রধান আকর্ষণ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুজন বাজিমাত করেছেন সমানতালে, একদম নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে। তাদের নিখুঁত এবং সাবলীল অভিনয় যেকোনো দর্শককে নিশ্চিতভাবে মুগ্ধ করবে। আকবর এবং বাবুর পাশাপাশি ছবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রাজ। যে চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে রীতিমতো চমকে দিয়েছেন ‘জিরো ডিগ্রী’ ও ‘ভয়ংকর সুন্দর’-এর পরিচালক, একসময়ের থিয়েটারশিল্পী অনিমেষ আইচ। ভায়োলেন্স রোলে এমন খ্যাপাটে, দুর্দান্ত অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। একজন ডিরেক্টর হিসেবে তাকে অসফল বলা গেলেও অভিনেতা হিসেবে তার অনন্যতার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যাবে উধাওতে। এছাড়া নওশাবা, ঋতু সাত্তার-সহ বাকিরাও নিজেদের অবস্থান থেকে সেরাটা দিয়েছেন।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে যে বিষয়টি একজন দর্শক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হলো উধাওয়ের চিত্রগ্রহণ। সিনেমাটোগ্রাফির দুর্বোধ্য ভাষা আপনি যদি না-ও বুঝে থাকেন, তবুও এই ছবির ক্যামেরা-কৌশলের বৈচিত্র্য আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। প্রত্যেকটা শটের কম্পোজিশনই দারুণ, বেশ গোছালো। সিনেমার ফ্ল্যাট অন টপ কিছু শট বেশ অনন্য লেগেছে। থ্রিলার ফিল্মের জন্য যে সিকুয়েন্সে শট ঠিক যতটা শ্যাকি হওয়া প্রয়োজন, যতটা প্যানিং এবং মুভমেন্টের দরকার- তার সবটাই যথাযথ। এরকম দৃশ্যায়নের জন্য যে প্রি-প্রোডাকশনে স্টোরি বোর্ডিং থেকে শুরু করে শট ডিভিশন পর্যন্ত যথেষ্ট সুপরিকল্পনা ছিল তা বেশ অনুমেয়। এই সিনেমাকে ঘিরে ডিওপি যেভাবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তাতে সিনেমাটি চোখের সামনে বেশ প্রাণবন্ত রূপেই বড় পর্দায় ধরা দেয়। চিত্রগ্রহণের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন কাশেম শাহবাজি এবং ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক কায়েল হেসলপ। উধাও হেসলপের করা প্রথম এশিয়ান কাজও বটে। আর এ কাজের জন্য অবশ্যই তিনি বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন।
সিনেমাটির মেকাপ যে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এবং যথার্থ ছিল তা এক আকবর চরিত্রের ট্রান্সফরমেশনেই সুস্পষ্ট। শহরের সম্ভ্রান্ত রাজনীতিবিদ আকবরের থেকে গ্রামের সবজি বিক্রেতা আকবর যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তির প্রতিচ্ছায়া! এরা যেন পুরোপুরি বদলে যাওয়া একই দেহের আলাদা দুই চরিত্র! গুলিতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া নিজের মুখ আকবর যখন আয়নাতে দেখে, তখন থার্ড আইতে দর্শক হিসেবে আমরাও চোয়াল ভেদ করে যাওয়া ছিদ্রায়িত মুখের আকবরের দেখা পাই। এই দৃশ্য নিখুঁতভাবে উপস্থাপনের কৃতিত্ব সিনেমাটোগ্রাফারের পাশাপাশি মেকআপম্যানেরও প্রাপ্য। তাছাড়া রাজের ভায়োলেন্সে প্রথম শিকারের যে রক্তমাখা মুখ মুভিতে দেখানো হয়, তা দৃশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণেই হয়তো দুর্বলচিত্তের যে কাউকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। সিনেমার সুনিপুণ আর্ট ডিরেকশনের ছাপ শহরে আকবরের বাড়ির আসবাব এবং জিনিসপত্রের ডেকোরেশন, বার, বাবুর রিক্সাভ্যান, ষোলগুটি খেলাসহ শেষ অব্দি প্রায় সব দৃশ্যেই প্রতীয়মান। একইসাথে কস্টিউম ডিজাইনও বেশ যথাযথ, গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উধাওর আরেকটি বিশেষ দিক তার শব্দ ও সঙ্গীত। ছবিতে কোনো গান নেই। তবে ফকির লাল মিয়ার দুটি ট্র্যাক আংশিক ব্যবহৃত হয়েছে। ছবির সাউন্ড ডিজাইনার হলিউডের কেনিথ জনসন। আর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন হলিউডেরই আরেকজন- জেকব জোফি। বাংলাদেশি ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় বিদেশি কেউ থাকাতেই বোধহয় দর্শক হিসেবে ভিন্ন এক সুখকর শ্রুতিমধুর অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে মনে হলো। জ্যাজ ঘরনায় বিশেষায়িত জোফি উধাওয়ের অর্কেস্ট্রাল কম্পোজিশনে নিজের পারঙ্গমতার শতভাগ প্রমাণ দিতে পেরেছেন। ফলে বলাই বাহুল্য, আমাদের নিজস্ব মিউজিকের সাথে পাশ্চাত্যের এক মেলবন্ধনও মুভিতে উপস্থিত। ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরে একদম ভিন্নস্বাদের মাত্রা যোগ করা হয়েছে গিটার, বাঁশি, সেতার, তবলা আর ঢোলের সমন্বয়ে।
ডেভিড ডেস্পারস্টিনের করা এই ছবির ভিডিও এডিটিং তথা চিত্রসম্পাদনার কাজও চোখে লেগে থাকবে। কাট টু কাট শট আর শট জাম্প দর্শকমনে কিডন্যাপিংয়ের থ্রিল জাগাতে বাধ্য করবে। এছাড়া এর এক্সট্রা-অর্ডিনারি শট বাই শট সুইচিং দর্শককে গল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ। ছবিতে সাউন্ডের সাথে ফুটেজের চমৎকার প্যাটার্ন লক্ষণীয়। এছাড়া লাইট টু ডার্ক এবং ডার্ক টু লাইট সিনের যাতায়াতেও স্বতঃস্ফূর্ততার দেখা মেলে। অবশ্য, এরপরেও কিছু কিছু সিকুয়েন্স শম্বুকগতির মনে হয়েছে। ক্রনোলজিক্যালভাবে গল্প এগোয়নি বলেই হয়তো এডিটিংয়ে যে রিদমিক প্যাটার্নটি তৈরি করা হয়েছে তা বেশ মানানসই লেগেছে।
ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রটি যতটা না মুগ্ধ করেছে, তার থেকে বেশি বিস্মিত করেছে ড্রপসিনে তার দুর্দান্ত, অবিশ্বাস্য, ভীষণ চমকপ্রদ অফট্র্যাক ফিনিশিং দিয়ে। রীতিমতো অবিশ্বাস্য নান্দনিক এক উপসংহার। শেষ সিকুয়েন্সের দৃশ্যায়নের মজার জায়গা হলো কোনো গুলির শব্দের ইফেক্ট ব্যবহার না করে কাজ সম্পন্ন করা। এতে মাত্রই কী ঘটে গেল তা নিয়ে একরকম ধাঁধার মতো কাজ করবে। সমসাময়িক কোনো বাংলাদেশি থ্রিলার সিনেমা নিয়ে এত বেশি সন্তুষ্টি, এত বেশি স্তুতিকীর্তন-এর আগে কখনোই করার সুযোগ আসেনি। মাস্টারপিস বলছি না, তবে এতটুকু আশ্বস্ত করতে পারি যে ৯৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের উধাও দর্শককে নিরাশ করবে না। থ্রিলার জনরার বাংলা মুভি বলেই হয়তো উধাওয়ের প্রতি অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে। যে অনুভূতি কী-বোর্ডের জড় কী-গুলো দিয়ে প্রকাশ করতে চাওয়া সত্যিই খুব কঠিন!