[১ম পর্ব পড়ুন]
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ গঠনে যে কজন মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে রেহমান সোবহান অন্যতম। ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণের পর থেকে বাল্যকাল, শিক্ষাজীবন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের উত্তাল ও উত্তেজনাকর বর্ণনা আমরা তার তিন খন্ডে প্রকাশিতব্য আত্মজীবনী ‘Untranquil Recollections’ এর প্রথম খন্ড ‘The Years of Fulfillment’ এ পড়েছি। দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে, ‘Untranquil Recollections: Nation Building in Post Liberation Bangladesh’ নামে।
প্রথমটির মতো এই বইয়েরও প্রকাশক ভারতীয় প্রকাশনী সেজ পাবলিকেশনস। এছাড়াও নতুন দুটি অধ্যায় সংযোজন করে বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করেছে ‘দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)’, ‘Untranquil Recollections: From Dawn to Darkness’ নামে। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বইটি হার্ডকভার হলেও সেজ পাবলিকেশনসের যে সংস্করণটি আমি পড়েছি সেটি পেপারব্যাক। বইটির পরিমিত প্রচ্ছদ, শক্তপোক্ত বাঁধাই, উৎকৃষ্ট মানের কাগজের ব্যবহার সবই মুগ্ধ করার মতো।
আত্মজীবনী ত্রয়ীর প্রথম খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেজ পাবলিকেশনের অঙ্গসংস্থা ভাষা প্রকাশনী থেকে, ‘উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো’ নামে। অনুবাদ করেছেন অমিতাভ সেনগুপ্ত। দ্বিতীয় খন্ডের অনুবাদ এখনও বের হয়নি। তবে তাতে সাধারণ পাঠকের কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। সুলেখক রেহমান সোবহানের কলামগুলোর মতো এই বইয়ের ভাষাও অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সুপাঠ্য। লেখার গাঁথুনির জন্য মনেই হয় না ইংরেজি পড়ছি। সম্ভবত, ছোটবেলা থেকেই বাংলার থেকে ইংরেজিতে বেশি স্বাছন্দ্য হওয়ায় রেহমান সোবহানের ইংরেজি সবরকমের কৃত্রিমতা ও আড়ষ্টতা বিবর্জিত।
১৪টি অধ্যায়ে সমন্বিত বইটি, শুরু হয়েছে প্রথম বইটি যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকে; জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ এই সময়সীমাকে উপজীব্য করে, যখন রেহমান সোবহান সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনে কর্মরত ছিলেন। এই বইয়ের বৃহৎ একটি অংশ লেখা হয়ে গিয়েছিল সত্তরের দশকেই। তবে তখনই বইটি তিনি প্রকাশ করেননি সেই সময়ের যে শুভাকাঙ্ক্ষীরা পান্ডুলিপি পড়েছিল তাদের অনুরোধে। তার মনে হয়েছিল, তৎকালীন সরকারের অধীনে প্ল্যানিং কমিশনে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলে বইটিকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করা হতে পারে।
বইয়ের প্রথম খণ্ডে লেখক বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন সম্পুর্ণ বই কী নিয়ে লেখা এবং বই থেকে পাঠক কী প্রত্যাশা রাখতে পারে সেই বিষয়ে। সদ্য স্বাধীন দেশের নীতি-নির্ধারণে উদ্ভুত সমস্যা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে কীভাবে পুনরায় গঠন করা যেতে পারে সেই আলোচনা, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রাণালয়ের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা, আমলাতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রের মধ্যে বিরোধসহ নানাবিধ বিষয়ে রেহমান সোবহান আলোকপাত করেছেন। এই অধ্যায়ে লেখক আক্ষেপ করেছেন যে আমাদের দেশের কিংবদন্তীরা, যেমন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখকে নিয়ে নিরপেক্ষ কোনো আলোচনা তার চোখে পড়ে না। এ নিয়ে তিনি বলেছেন,
Unfortunately, their lives and the history of that period have been entrapped in contemporary debates where contested parties have preferred to depict our nation builders in hues of black and white depending on the narrator.The world still awaits the emergence of the intrepid historian who is willing to face up to the hazard of writing a more objective account of the life and times of such leaders as Bangabandhu.
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকারের অধীনে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে স্থায়ী সরকার গঠনের আগপর্যন্ত অম্লমধুর এক সময় কেটেছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাস করার স্বস্তির সাথে মিশে ছিল অনিশ্চয়তা। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দেশের আপামর জনতা। এমতাবস্থায় রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি ছিল আরো করুণ।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ যেভাবে সরকার পরিচালনা করছিলেন যুদ্ধ চলাকালে, সেভাবে স্বাধীন দেশে তারা পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারছিলেন না। বিভিন্ন মহলে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ন্যায় কিছু গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল যারা গায়ের জোরে সদ্য স্বাধীন দেশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইত। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন ও ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠাই ছিল সেই সময়ের সর্বাধিক আরাধ্য সমাধান। অবশেষে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো পা রাখেন ১০ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে।
১২ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের কিছুদিনের মাঝেই বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্বলিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। তাঁর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নই প্ল্যানিং কমিশনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
প্রাথমিকভাবে এই কমিশন গড়ে ওঠে পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশন (পিপিসি) ও ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশন (আইপিসি) এর মডেল অনুসরণ করে। বঙ্গবন্ধু প্রথমে ঠিক করেছিলেন তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু তা করলে একটি প্ল্যানিং কমিশনের যে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন সেটা অনেকাংশেই খর্ব হয়ে যায়, কেননা এর ফলে কমিশন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করতে পারে না।
আবার, বঙ্গবন্ধু যদি প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান হন, এবং তাজউদ্দিন আহমেদ হন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, তাহলে তাজউদ্দিনের মন্ত্রীত্ব অনেকটাই ভিত্তিহীন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে সরিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদকে পরিকল্পনা মন্ত্রী ও প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান, এবং নুরুল ইসলামকে ডেপুটি-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেন। পাকিস্তান বা ভারতের প্ল্যানিং কমিশনের মতো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও হস্তক্ষেপ না থাকায় শুরুতেই বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন কিছুটা দুর্বলতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। প্ল্যানিং কমিশনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন মোশাররফ হোসেন, রেহমান সোবহান, এবং আনিসুর রহমান।
জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী যেকোনো সংস্থার জন্যই যথেষ্ট স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু রেহমান সোবহান আক্ষেপ করেছেন যে বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের কখনোই সেই সুবিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর অনন্য ব্যক্তিত্ব ও দেশ পরিচালনার স্বকীয় নিয়মের ভিত্তি ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কথাই তার কান পর্যন্ত পৌঁছত না। এছাড়া, মন্ত্রীপরিষদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, দলীয় স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টাসহ নানাবিধ কারণে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্যরা তাদের কাজ সুষমভাবে করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। এই সময়ে চারপাশের চাটুকারদের ভীড়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দিন আহমেদের মনেও এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল। রেহমান সোবহান লিখেছেন,
Tajuddin, later sadly complained, to the members of the planning commission that, Bangabandhu never ever sat down with him and ask him for a full account of what happened during the 9 months of the liberation war.
বাংলাদেশের প্রথম প্ল্যানিং কমিশনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিঃসন্দেহে মাত্র নয় মাসের মধ্যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলা। একইসাথে, প্রকল্পটি কমিশনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপও বটে। কারণ, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ কখনোই নেয়া হয়নি। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে এই পরিকল্পনার ব্যাপক প্রশংসা করা হলেও ১৯৭২ সালে বা পরবর্তীতে কখনোই এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি।
পরিকল্পনা কমিশনের সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা ও সদ্যোজাত দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের প্রয়াস নিয়ে রেহমান সোবহান আলোচনা করেছেন। রেল, সড়ক ও নৌ পরিবহন, আবাসন খাতের পরিকল্পনা, জাতীয়কৃত খাতের উন্নয়ন ও স্বায়ত্ত্বশাসনসহ নানাবিধ বহুমুখী প্রকল্পের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত অবস্থায় কূটনীতিবিদ হিসেবেও কাজ করেন লেখক। এই সময়েই তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ভিত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
রেহমান সোবহান ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ত্যাগ করেন। এরপর থেকে সরকার বা প্রশাসনের সাথে তার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এর কিছুদিন পরেই তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এ যোগদান করেন।
বইয়ের শেষ অংশে লেখক ১৯৭৪ ও পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করেছেন। বাকশাল গঠন, বঙ্গবন্ধু হত্যা, ঘাতকদের নিরাপদ পলায়ন, সামরিক শাসন নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে কাজ করার সুবাদে রেহমান সোবহান যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রা অনেক কাছ থেকে দেখেছেন, এবং কিছু ক্ষেত্রে সেই যাত্রায় উল্লেখযোগ্য অবদানও রেখেছেন। তার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ড থেকে সেই সময়ের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আচার সম্পর্কে যেমন সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, তেমনই তখনকার উন্নয়নের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলোও নজরে আসে। রেহমান সোবহান শুধু ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের মতাদর্শ দিয়ে প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করতে ও নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে। যেকোনো পাঠক, যাদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে, তাদের কাছে এই বইটি অবশ্যই সুপাঠ্য মনে হবে।