ধরুন করোনাভাইরাসের কারণে আপনি বন্দী সময় পার করছেন। কোথাও যাচ্ছেন না, কারো সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন না। জরুরী প্রয়োজনে দোকানে গেলেও সারাক্ষণই আতঙ্কের মধ্যে থাকছেন। যেকোনো কিছু স্পর্শ করতে গেলেই মনে হচ্ছে, এই বুঝি হাতে করোনাভাইরাস লেগে গেল! এরকম যদি অবস্থা হয়, তাহলে আপনি হয়তো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না, কিন্তু হয়তো অবিলম্বেই আপনি মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। আপনার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাবে, ঘুম কমে যাবে, এবং ধীরে ধীরে শারীরিকভাবেও আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন।
বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসকে এবং এ থেকে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯কে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। কিন্তু একইসাথে লক্ষ্য রাখতে হবে, আপনি যেন অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পড়েন। আর সেজন্য আপনাকে জানতে হবে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য – ঠিক কীভাবে এই ভাইরাস ছড়ায়, কোন ধরনের পরিবেশে বা কোন ধরনের পৃষ্ঠে এই ভাইরাস কতক্ষণ টিকে থাকে, কী করলে আপনার সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, আর কী করলে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম? চলুন সেটাই জানার চেষ্টা করি।
প্রথমেই জানা যাক, বাতাসের মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাস কীভাবে ছড়ায়, এবং কতক্ষণ তা বাতাসের মধ্যে টিকে থাকতে পারে। করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায় হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে। আমরা যখন হাঁচি বা কাশি দেই, তখন অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা বা ড্রপলেট নির্গত হয়। সাধারণ কাশির সাথে এরকম ৩,০০০ ড্রপলেট এবং হাঁচির সাথে ৪০,০০০ ড্রপলেট নির্গত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে এই ড্রপলেটগুলোর মধ্য দিয়েই ভাইরাস মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
এই ড্রপলেটগুলো যদি সরাসরি সামনে থাকা কারো নাক বা মুখে প্রবেশ করে, তাহলে সেই ব্যক্তিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু সরাসরি না প্রবেশ করলেও এই ড্রপলেটগুলো কারো হাতে বা জামাকাপড়ে গিয়ে পড়তে পারে, টেবিলে, কম্পিউটারের কীবোর্ডে বা অন্য কোনো পৃষ্ঠের উপর পড়তে পারে, এরপর সেখান থেকে কারো হাতের মাধ্যমে তার নাকে বা মুখে প্রবেশ করতে পারে। এবং অতি ক্ষুদ্র কিছু ড্রপলেট কোথাও না পড়ে বেশ কিছুক্ষণ বাতাসেও ভেসে থাকতে পারে।
গত ১৭ই মার্চ দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে গবেষকরা উল্লেখ করেন, কাশি দেওয়ার পর বাতাসে থাকা অবস্থায় ড্রপলেটগুলোর মধ্যে ভাইরাস তিন ঘন্টা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। একটু বড় ড্রপলেটগুলো আধ ঘন্টার মধ্যেই অভিকর্ষের কারণে মাটিতে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু অতি সূক্ষ্ম ড্রপলেট তথা অ্যারোসল, যেগুলোর ব্যাস ১ থেকে ৫ মাইক্রন পর্যন্ত, সেগুলো স্থির বাতাসে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
অর্থাৎ কেউ হাঁচি বা কাশি দেওয়ার পর কেউ ঐ স্থানে গেলে নিশ্বাসের সাথে ভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে এই ড্রপলেটগুলো ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে এবং এতে থাকা ভাইরাসের সংখ্যা এবং কার্যকারিতাও হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়াও বদ্ধ পরিবেশের পরিবর্তে মুক্ত বাতাসে হাঁচি বা কাশি দিলে সেখানে ভাইরাস দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে।
গবেষণাটা চালানো হয়েছিল ল্যাবরেটরির আবদ্ধ পরিবেশে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ধারণা, সাধারণ পরিবেশে সব সময়ই কিছুটা বায়ু চলাচল করে বলে সেখানে এই ভাইরাস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অকার্যকর হয়ে যাবে। কাজেই খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। কেউ হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় তার সামনে অবস্থান না করলে বা এরপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার আশেপাশে না গেলে সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি না।
বাতাসের তুলনায় অন্যান্য বস্তুর পৃষ্ঠে করোনাভাইরাস আরো বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। উপরে বর্ণিত গবেষণা থেকেই দেখা যায়, ভাইরাসটি প্লাস্টিক এবং স্টেইনলেস স্টিলের উপর দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে, কারো হাতে যদি ভাইরাসটি থাকে, তাহলে সে একবার দরজার নব, বাস বা ট্রেনের হাতল, বৈদ্যুতিক সুইচ, মোবাইল ফোনের কভার, ফুড কন্টেইনার অথবা অন্য যেকোনো প্লাস্টিকের বা স্টিলের পৃষ্ঠ স্পর্শ করার পর দুই-তিন দিন পর্যন্ত যত কেউ সেটা স্পর্শ করবে, তাদের সবার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে।
একই গবেষণায় দেখা গেছে, কার্ডবোর্ডের উপর ভাইরাসটি ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, অনেকেই করোনাভাইরাসের এই সংক্রমণের সময় নিজে বাইরে না গিয়ে অর্ডার করে খাবার বা অন্যান্য পণ্য ঘরে আনাচ্ছেন। এসব পণ্য সাধারণত কার্ডবোর্ডের প্যাকেটে করেই ডেলিভারি দেওয়া হয়। ফলে এ ধরনের প্যাকেট থেকেও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তবে প্যাকিং এবং ডেলিভারির সময়ের ব্যবধান যদি ২৪ ঘন্টার বেশি হয়, তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়। কেবলমাত্র যিনি ডেলিভারি দিবেন, তিনি নিজেই যদি সংক্রমিত থাকেন, সেক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়ে যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে যেহেতু প্যাকেটের বাইরের দিকটাই সংক্রমিত হবে, তাই প্যাকেটটা খুলে ভেতরের পণ্য সাবধানে বের করে এরপর প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললেই হবে।
তামার পৃষ্ঠের উপর করোনাভাইরাসকে খুবই কম সময় বেঁচে থাকতে দেখা গেছে। তামার উপর ভাইরাস মাত্র চার ঘন্টা বাঁচে। ফলে যেসব দরজার নবে, রেলিংয়ে বা বিভিন্ন স্থানের হাতলে স্টিলের পরিবর্তে তামা ব্যবহার করা হয়, সেখানে লোকজনের ভিড় কম থাকলে সংক্রমণের সম্ভাবনাও কিছুটা কম হয়।
করোনাভাইরাসকে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে দেখা গেছে কাঁচের পৃষ্ঠের উপর। জার্নাল অফ হসপিটাল ইনফেকশনে গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে দেখা যায়, কাঁচের উপর করোনাভাইরাস দীর্ঘ চার দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর সেকারণেই মোবাইল ফোনের স্ক্রিন, আয়না, চশমা প্রভৃতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে এই সবকিছুর সাথে আরেকটা ব্যাপারও জড়িত। সেটা হচ্ছে ভাইরাসের ‘হাফ লাইফ’। হাফ লাইফ হচ্ছে ভাইরাসের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাওয়ার সময়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো ভাইরাসের হাফ লাইফ যদি ২ ঘন্টা হয়, তাহলে প্রতি ২ ঘন্টা পর পর সেখান থেকে অর্ধেক সংখ্যক ভাইরাস মরে যাবে। কোনো পৃষ্ঠে প্রথমে যদি ৮০০ ভাইরাস থাকে, তাহলে ২ ঘন্টা পর সেই সংখ্যা হয়ে ৪০০, ৪ ঘন্টা পর হয়ে যাবে ২০০, ৬ ঘন্টা পর হয়ে যাবে ১০০। এই হাফ লাইফের কারণে যত সময় যেতে থাকবে, কোনো পৃষ্ঠ থেকে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা তত কমতে থাকবে।
এছাড়াও করোনাভাইরাস বেঁচে থাকার জন্য পানির কণা বা ড্রপলেটের প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে পানি শুকিয়ে বাষ্পীভূত হয়ে যেতে থাকলে ভাইরাসের সংখ্যা কমে যেতে শুরু করে এবং সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যেতে থাকে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাতাসে করোনাভাইরাসের হাফ-লাইফ ১.১ থেকে ১.২ ঘন্টা। স্টিলের পৃষ্ঠে এই হাফ লাইফ ৫.৬ ঘন্টা এবং প্লাস্টিকের পৃষ্ঠে ৬.৮ ঘন্টা। সময় যত যেতে থাকে, কোনো পৃষ্ঠে ভাইরাসের সংখ্যা ততই কমতে থাকে, ফলে তাদের দ্বারা সংক্রমণের সম্ভাবনাও সেই সাথে কমতে থাকে।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের এই বিশেষ প্রজাতিটি (SARS-CoV-2) একেবারেই নতুন। তাই এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার না। সেজন্যই প্রায়ই পরস্পর বিপরীতধর্মী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এরা আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দাবি করেছিল এই ভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না, কাজেই মাস্ক পরা জরুরী না। কিন্তু এখন নতুন গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাতাসের মধ্য দিয়ে এই ভাইরাসের ছড়ানোর বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে, ফলে মাস্ক পরা জরুরী। আগামী দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আরো নতুন নতুন গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার হবে। আর সেজন্য আমাদেরকে সব সময় এ সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সম্পর্কে হালনাগাদ থাকতে হবে।
যে বিষয়টা পরিষ্কার, ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে সরাসরি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সংস্পর্শে এলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে হাত মেলালে। এছাড়া পাবলিক প্লেসে যেসব বস্তু প্রতিদিন অনেক মানুষ স্পর্শ করে, যেমন এলিভেটরের বাটন, সিঁড়ির রেলিং, সেগুলো থেকেও সংক্রমণের বেশি ঝুঁকি থাকে। কিন্তু যেসব বস্তু কম সংখ্যক মানুষ স্পর্শ করে, সেগুলো থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কম। আরেকটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, মাত্র একটা ভাইরাস স্পর্শ করলেই যে কেউ আক্রান্ত হয়ে যাবে, ব্যাপারটা সেরকম না। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বেশ কিছু সংখ্যক শরীরে প্রবেশ করতে হয়, যদিও করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা এখনও পরিষ্কার না।
কাজেই প্রাথমিক ঝুঁকিটা কেটে যাওয়ার পর সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে ঘরবন্দী হয়ে থাকা খুব একটা জরুরী না। যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, কারো খুব বেশি কাছে না যাওয়া, নিয়মিত হাত ধোয়া এবং যেসব বস্তুর পৃষ্ঠে মানুষের স্পর্শ বেশি লাগে, সেগুলো ৭০% অ্যালকোহলের দ্রবণ অথবা ০.৫% হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এবং ০.১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট সমৃদ্ধ ব্লিচের দ্রবণ দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করা। তাহলেই মোটামুটি নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে।