দৈনন্দিন জীবনের যে কোনো দিনেই আমরা প্রত্যেকেই ভয়, চাপ, কিংবা উদ্বেগ অনুভব করে থাকি। আমাদের সাধারণ অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আমরা সাধারণত এই জাতীয় বেশ কিছু শব্দ সমার্থকভাবে ব্যবহার করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই তিনটি মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। আজকের আয়োজনে আমারা এই তিনটি মানসিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করব। এই তিনটি অনুভূতির সুস্পষ্ট অর্থ প্রকাশের লক্ষ্যে এদের ইংরেজি পরিভাষাও জেনে নেওয়া প্রয়োজনীয়। ভয় বলতে Worry, চাপ বলতে Stress এবং উদ্বেগ বলতে Anxiety-কে নির্দেশ করা হয়ে থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে।
ভয় (Worry)
একজন মানুষ যখন নেতিবাচক চিন্তা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন, অনিশ্চিত পরিণামের কথা ভাবেন কিংবা ভবিষ্যতে কী কী অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে এসব চিন্তার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন তখন তাকে ভয় বলা হয়। মিল ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়াতে কর্মরত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেলানি গ্রিনবার্গের ভাষ্যমতে,
ভয় হচ্ছে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক অনুভূতি যার সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক স্বভাবতই ব্যক্তি এই আচরণের সাথে অদ্ভুত অভ্যস্ততায় জড়িয়ে পড়ে। উদ্বেগের কগনিটিভ (স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কিত) উপাদান হচ্ছে ভয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ভয় শুধু ব্যক্তির মনেই ঘটে থাকে, শারীরিক কোনো উপস্থিতি নেই এর।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অ্যাংজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অ্যাসোসিয়েশন অভ আমেরিকার প্রধান লুয়ানা মার্কেজের মতে,
ভয় হচ্ছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের খুব মৌলিক একটি অনুভূতি।
যখন আমরা কোনো অনিশ্চিত কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে ভাবতে শুরু করি তখন একে সাধারণভাবে ভয় বলা হয়ে থাকে। চিন্তার বিষয়টি হতে পারে বাড়ি ভাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়া, পরীক্ষায় ভালো না করতে পারা, চাকরির ইন্টারভিউয়ে যথাযথ উত্তর দিতে না পারা বা এরকম যে কোনো কিছু। এই ধরনের অনুভূতি দ্বারা মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হয়। ভয়ের এই অনুভূতির সঞ্চারণের মাধ্যমে মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে আসে। ভীত হওয়ার দরুন আমরা আবার কখনও কখনও কোনো সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়ে উঠি বা কোনো দরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। এই অর্থে ভয় দ্ব্যর্থহীনভাবে ইতিবাচক অনুভূতি। লুয়ানার মতে,
ভয় হচ্ছে এমন একটি আবেগ যা আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে আমাদেরকে আসন্ন বিপদ থেকে নিরাপদ রাখে। সমস্যাটি তখনই ঘটে যখন একটি বিষয়ে চিন্তা করতে করতে আমরা ভীত হয়ে শেষ অবধি প্রয়োজনীয় কাজটি করার সক্ষমতা হারাই।
নিজের ভয়ের সাথে সচেতনভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু নিয়মিত অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময় আপনি ভয়ের পেছনে ব্যায় করতে পারেন। কীভাবে? অবচেতনে চিন্তা না করে সচেতনভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে ভাবুন অর্থাৎ কী কী করা যেতে পারে, কী পদক্ষেপ নিলে আপনি ভাবী সমস্যাটিকে সমাধান করতে পারবেন? নিজের ভয়ের অনুভূতিটিকে ডায়রিতে লিখে ফেলুন। গবেষণা বলছে, জার্নালিং মানুষের নেতিবাচক চিন্তার প্রবণতাকে হ্রাস করে। আরেকটি উপায় হচ্ছে ভয়ের কারণটিকে বাইপাস করে দেওয়া। অর্থাৎ যে বিষয়টি নিয়ে আপনি অতিরিক্ত চিন্তা করছেন সেই চিন্তাটির বদলে অন্য কোনো চিন্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করে ফেলুন।
চাপ (Stress)
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রেস অনুভব করার জন্য একটি স্ট্রেসরের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। এটি হতে পারে কোনো পরিবেশগত কারণ বা নিজস্ব সীমাবদ্ধতা। ধরুন, আসন্ন দিনগুলোতে আপনাকে কোনো কাজের সময়সীমা এগিয়ে আসছে অথচ কাজটির তেমন কোনো অগ্রগতিই এখন পর্যন্ত নেই কিংবা আপনি হয়তো কিছুদিনের মাঝেই একটি জটিল মেডিকেল টেস্ট করাতে যাচ্ছেন। পরিবেশের পরিবর্তন অথবা নিজস্ব আওতার বাইরের কোনো ঘটনার কারণে মানুষ যে স্নায়ু উদ্দীপনার অভিজ্ঞতা লাভ করে তাকে বলা হয় স্ট্রেস বা মানসিক চাপ।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়ে আসছে। স্ট্রেসের দরুন মূলত মানুষের লিম্বিক সিস্টেম উদ্দীপ্ত হয় এবং অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল নামক দুটি হরমোন ক্ষরিত হয় দেহে। স্ট্রেসের প্রতি শরীরের সাড়া দেওয়ার ধরন কীরকম হয়? আপনি যখন স্ট্রেসড অবস্থায় থাকেন তখন স্বাভাবিক কিছু লক্ষণ হলো ঘর্মাক্ত হাতের তালু, দ্রুত হৃদস্পন্দন, অগভীর শ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদি। স্ট্রেস দু’ধরনের হয়ে থাকে। অ্যাকিউট স্ট্রেস বলতে সাময়িক অথচ তীব্র অনুভূতিকে বোঝানো হয়ে থাকে। ধরুন, শেষ মুহূর্তে গিয়ে আপনি একটি অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করতে পারলেন অথবা মারাত্মক যানজট পেরিয়ে অবশেষে আপনি আপনার পরম আকাঙ্ক্ষিত বাসটি ধরতে পারলেন। অ্যাড্রেনালিন বা কর্টিসল রাশের কারণে (রক্তে হরমোনের অত্যধিক উপস্থিতি) শেষ অবধি কাজটি যখন আপনি সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবেন তখন আপনি নিজের মাঝে এক ধরণের পুলক বা তৃপ্তি অনুভব করবেন। অন্যদিকে ক্রনিক স্ট্রেসের কারণে আপনি ক্রমান্বয়ে শারীরিক ও মানসিক অবনতির দিকে এগোতে থাকেন কেননা ক্রনিক স্ট্রেসের চটজলদি কোনো সমাধান হয় না। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা কোনো অস্বস্তিকর ও জটিল কোনো অভিজ্ঞতা, যেমন- আর্থিক দৈন্য আপনাকে সার্বক্ষণিক মানসিক চাপের মাঝে রাখবে।
স্ট্রেস থেকে মুক্ত হওয়ার দারুণ একটি পন্থা হতে পারে শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম। নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে রক্তে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা কমে আসে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কখনোই নিজের স্ট্রেসকে অন্যের স্ট্রেসের সাথে তুলনা করা যাবে না কারণ এতে করে ভোগান্তি আরও বৃদ্ধি পায়।
উদ্বেগ (Anxiety)
সবচেয়ে সহজ ভাষায় উদ্বেগ হচ্ছে ভয় ও চাপের সম্মিলন। অর্থাৎ ভয়কে বলা হয় উদ্বেগের কগনিটিভ উপাদান এবং এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলো স্ট্রেস। অর্থাৎ আপনি কোনো কিছু নিয়ে ভীত হলে আপনার শরীর কোনো না কোনোভাবে সাড়া প্রদান করে। পুরো বিষয়টিকে একত্রে বলা হয় উদ্বেগ। এই কারণেই বলা হয়- উদ্বেগ হলো একটি মনোদৈহিক প্রক্রিয়া। ভয়ের সঞ্চার হয় মনে, আর তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় শরীরে। মার্কেজের ভাষায়,
আপনি যখন যথেষ্ট পরিমাণ ভয় ও স্ট্রেসের সাথে লড়ছেন, মূলত তখন বলা যেতে পারে যে আপনি একটি বা একাধিক বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
স্ট্রেস সম্পর্কে আগেই যা আলোচনা করা হলো যে, এটি একটি প্রাকৃতিক বিপদের প্রতি আপনার স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া প্রদান, ঠিক এই জায়গাটিতেই উদ্বেগের সাথে স্ট্রেসের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। উদ্বেগ মিথ্যা বা ছদ্মবেশী কোনো ঘটনার প্রতিও আপনার সাড়া প্রদান হতে পারে। ধরুন, ক্লাসে ঢুকে আপনি দেখলেন বন্ধুরা অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুটা চুপচাপ। অমনি দেখা গেলো আপনি চিন্তা করা শুরু করে দিলেন হয়তো বা আপনি কিছু ভুল করেছেন বা ইতিমধ্যে বিরাট বড় আশঙ্কাজনক কিছু ঘটে গেছে বা ঘটতে যাচ্ছে এবং এভাবেই আপনার চিন্তা জট পাকাতে শুরু করল। এখানে লক্ষ্যণীয় যে আপনার ভেবে ফেলা কোনো কিছু সম্পর্কেই কিন্তু আপনি শতভাগ সুনিশ্চিত নন, তবুও আপনার মনের গভীরে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে সেসব সম্পর্কে। অর্থাৎ সত্যিকারের বাস্তবতার চেয়ে আপনি বাস করছেন এক কল্পিত বাস্তবতায়।
উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকবার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিনি, মদ, ক্যাফেইন ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার জন্য। শারীরিক অনুভূতিকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মনে রাখা দরকার উদ্বেগের বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে বা এ নিয়ে অন্যের সাথে কথা বললে মুক্তি মিলবে না কোনোমতেই। বরং দড়ি লাফ, গান শোনা, অমসৃণ কাপড়ে হাত ঘষার মাধ্যমে উদ্বেগকে ভিন্ন পথে চালনা করা যায়। এছাড়াও ইদানীং কগনিটিভ বিহেভিওরাল ট্রেনিং ও মাইন্ডফুলনেস চর্চার মাধ্যমে উদ্বেগের সমাধান বেশ ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে।