মানুষের জন্ম হয়তো একটি উপায়েই হয়ে থাকে, কিন্তু মৃত্যু ঘটতে পারে হাজারটা কারণে। হতে পারে তা স্বাভাবিক বার্ধক্যজনিত মৃত্যু। হতে পারে কোনো দুর্ঘটনা। আবার এই মৃত্যু আসতে পারে কোনো রোগজনিত কারণ থেকে। পৃথিবীতে হাজার রকমের রোগে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু রোগ খুবই পরিচিত। আবার কিছু রোগের নাম বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা। নাম না জানা বিশেষ কিছু রোগ রয়েছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। এমনই একটি রোগ হলো হিমোফিলিয়া।
সাধারণত কোনো রোগের পরিচিতি বাড়ে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে। রোগীর সংখ্যা যত বেশি, রোগটি সাধারণ মানুষের মাঝেও তত বেশি পরিচিত। আবার রোগের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোও এর পরিচিতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে। কিন্তু হিমোফিলিয়া রোগটির জনপ্রিয়তা এই দুটি কারণের একটি থেকেও আসেনি। এই রোগটির জনপ্রিয়তা এসেছে যারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে তাদের থেকে।
গ্রেট ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধর থেকে হিমোফিলিয়া রোগের উৎপত্তি হয়েছে। ব্রিটেনের রাজবংশ থেকে এই রোগ ধীরে ধীরে রাশিয়া, স্পেন ও জার্মান রাজবংশে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই একে ‘রাজকীয় রোগ’ বলা হয়।
হিমোফিলিয়া আসলে কী ?
হিমোফিলিয়া শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ হাইমা এবং ফিলিয়া হতে। হাইমা অর্থ রক্ত এবং ফিলিয়া অর্থ আকর্ষণ। দেহের কোনো অংশে রক্তপাত শুরু হলে সাধারণত সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। মেডিকেলের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে ক্লটিং বলে। ক্লটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত জমাট বেঁধে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। সত্য বলতে, আমাদের দেহে কোথাও কোনো ক্ষত তৈরি হলে সেই ক্ষতস্থান সময়ের সাথে সাথে শুকিয়ে যাওয়াকেই ক্লটিং বলে। যে পদার্থ রক্তক্ষরণে বাঁধা দেয় তাকে ক্লট বলে। কিন্তু কোনো কারণে ক্ষতস্থানে এই ক্লট তৈরি না হলে সেখান থেকে একাধারে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
একজন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে এই ক্লট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়। ব্যাপারটি আসলে এমন নয় যে, রোগীর দেহ থেকে অঝোরে এবং খুব দ্রুত রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। মূলত একজন হিমোফিলিয়াক (যারা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত) ব্যক্তির দেহ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে হয়তো এখন মনে করছেন যে, এই রোগ হলে হাত, পা, হাঁটু ইত্যাদির কোথাও কেটে গেলেই তা থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকবে। ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। দেহের বাইরের কোনো ছোটখাটো আঘাত এখানে খুব একটা চিন্তার বিষয় নয়। আসল চিন্তার বিষয় হলো ইন্টারনাল ব্লিডিং বা দেহের অভ্যন্তরীণ কোনো অংশে রক্তক্ষরণ। এই ধরণের রক্তক্ষরণকে হ্যামোরেজ বলে। এটি মূলত দেখা যায় দেহের ভিতরে কোনো সন্ধি যেমন হাঁটু ও গোড়ালিতে। এছাড়া দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন টিস্যু ও পেশীর মিলনস্থলেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। দেহের ভিতরে এমন রক্তক্ষরণ অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং আক্রান্ত অংশ বেশ ফুলতে শুরু করে।
হিমোফিলিয়া কেন হয় ?
হিমোফিলিয়া একটি বংশগত রোগ। জিনগত বিভাজন বা মিউটেশনের মাধ্যমে এই রোগের উৎপত্তি হয়েছে। সাধারণত হিমোফিলিয়া রোগটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো হিমোফিলিয়া–এ, হিমোফিলিয়া–বি এবং হিমোফিলিয়া-সি। হিমোফিলিয়া–বি রোগকে ক্রিসমাস ডিজিসও বলা হয়। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে হিমোফিলিয়া–এ ধরা পড়ে। পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার ছেলে নবজাতকের মধ্যে একজন হিমোফিলিয়া–এ রোগে আক্রান্ত হয়।
রক্তে ক্লটিং ফ্যাক্টর-৮ (Clotting Factor VIII) এর অনুপস্থিতির কারণে এই রোগ দেখা দেয়। হিমোফিলিয়া–বি হিমোফিলিয়া–এ এর তুলনায় কম দেখা যায়। প্রতি বিশ হাজার থেকে চৌত্রিশ হাজার নবজাতক ছেলে শিশুর মাঝে একজন হিমোফিলিয়া–বি রোগে আক্রান্ত হয়। রক্তে ক্লটিং ফ্যাক্টর-৯ (Clotting Factor IX) এর অনুপস্থিতির কারণে হিমোফিলিয়া–বি দেখা দেয়। হিমোফিলিয়া–সি আগের দুটি থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশি বিরল। প্রতি এক লক্ষে একজন লোকের এই রোগ ধরা পড়ে। পুরুষ ও নারী উভয়ই হিমোফিলিয়া–সি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রক্তে কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর -৯ (Coagulation Factor XI) এর অনুপস্থিতিতে এই রোগ হয়।
হিমোফিলিয়া একটি সেক্স লিঙ্কড রিসেসিভ ডিজঅর্ডার (X-Linked Recessive Disorder)। পুরুষ ও নারীর প্রত্যেকের এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম রয়েছে। নারীর এই একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম হলো XX এবং পুরুষের ক্ষেত্রে তা হলো XY। এগুলোর মাঝে X ক্রোমোজোমের মিউটেশনের কারণেই মূলত হিমোফিলিয়া রোগের আবির্ভাব ঘটে। যেহেতু নারীদের X ক্রোমোজোমের সংখ্যা বেশি, তাই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের প্রধান বাহক হয়।
একজন হিমোফিলিয়ার বাহক নারীর মাধ্যমে পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলে সন্তান রোগ ধারণ করে এবং পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়ে সন্তান রোগের বাহক হয়। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত বাবা থেকে তার মেয়ে সন্তান এই রোগের জিন অবশ্যই বহন করবে। আবার বাবা এই জিন বহন করলেও মা যদি বাহক না হয়, তবে এই রোগ ছেলে সন্তানের মাঝে দেখা দেবে না। এ ব্যাপারগুলো একটু প্যাঁচানো মনে হলে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
যেভাবে এটি ‘রাজকীয় রোগ’ হলো
গ্রেট ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধরদের মাঝে হিমোফিলিয়া রোগটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। রানী ভিক্টোরিয়ার কয়েকজন কন্যা সন্তান এই রোগের বাহক ছিলেন। তাদের যখন অন্য দেশের রাজ পরিবারে বিয়ে হয়, তখন এই রোগ তাদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। একারণেই এ রোগকে রাজকীয় রোগ বলা হয়।
ব্রিটিশ রাজ পরিবারে প্রথম হিমোফিলিয়া রোগের আবির্ভাব ঘটে রানী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স লিওপোল্ডের মাধ্যমে। এর আগে এই রাজ পরিবারে কারো মাঝে এমন রোগ দেখা যায়নি। ১৮৫৩ সালের ৭ এপ্রিল প্রিন্স লিওপোল্ড জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স অ্যালবার্টের অষ্টম সন্তান। এই রোগটি রানীর পূর্বসূরিদের কারো মাঝে দেখা যায়নি। তাছাড়া রানীর অন্যান্য ভাই বোন এবং তাদের সন্তানদের মাঝেও এ রোগ দেখা যায়নি। প্রিন্স অ্যালবার্টের মাঝেও এ রোগের কোনো লক্ষণ ছিল না। তাই ধারণা করা হয়, রানী ভিক্টোরিয়া কিংবা তার মায়ের থেকে মিউটেশনের মাধ্যমে এই রোগের সৃষ্টি হয়।
রানী ভিক্টোরিয়া তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান প্রিন্স লিওপোল্ডকে নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতেন। ইতিহাস বলে, লিওপোল্ডের মাঝে মৃগীরোগের লক্ষণও দেখা গিয়েছিল। তার বিয়ে হয় জার্মান রাজকন্যা হেলেনা অব ওয়ালডেক-পিয়েরমন্টের সাথে। একত্রিশ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় প্রিন্স লিওপোল্ডের মৃত্যু হয়। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে হাঁটু ও মাথায় চরমভাবে আহত হন। পরদিন সকালে সেরিব্রাল হ্যামোরেজের কারণে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
রানী ভিক্টোরিয়ার সন্তানদের মধ্যে দুই কন্যা সন্তান এলিস ও বিয়াট্রিস হিমোফিলিয়া রোগের বাহক ছিলেন। বিয়াট্রিসের এক কন্যার বিয়ে হয় স্প্যানিশ রাজ পরিবারে। একইভাবে এলিসের বাহক কন্যা এলিসের বিয়ে হয় রাশিয়ান রাজ পরিবারে। ১৯০৪ সালে এলিসের পুত্র সন্তান অ্যালেক্সিস উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোগ লাভ করে। এভাবে ইউরোপের অন্যান্য রাজবংশগুলোতে হিমোফিলিয়ার বীজ বপন হতে থাকে।
শেষ কথা
রক্তক্ষরণ জনিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব সেই প্রাচীনকাল থেকে লেগে আছে। রক্ত সম্পর্কে তৎকালীন মানুষের ধারণা অনেক কম ছিল। ব্রিটিশ রাজ পরিবারে যখন প্রথম এই রোগের আলামত পাওয়া যায়, তখন চিকিৎসা পদ্ধতি ততটা উন্নত ছিল না। ১৯০৪ সালে প্রথম রক্তের প্লাজমা আবিষ্কৃত হয়। এরপর আবিষ্কৃত হতে থাকে নানা প্লাজমা প্রোটিন, যেগুলোর অনুপস্থিতির কারণে মূলত হিমোফিলিয়া রোগ দেখা দিতে পারে।
বংশগত রোগ হওয়ার কারণে এ রোগ সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করার তেমন কোনো উপায় নেই। তবে চিকিৎসা পদ্ধতির উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে এখন এই রোগের আধুনিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এখন দ্রুত হিমোফিলিয়া রোগটি শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আরো বেশ কয়েক বছর আগে এমন চিকিৎসা সুবিধা থাকলে হয়তো রোগটি এভাবে রাজকীয় রোগের খেতাব অর্জন করতো না।