আশেপাশের সুস্থ মানুষের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ, কখন নভেল করোনাভাইরাস আক্রমণ করে বসে। বিশেষ করে ইউরোপের উন্নত দেশ; যাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বজুড়ে সুনাম, সেখানেই মহামারি আকার ধারণ করেছে এই ভাইরাস। যারা বেঁচে আছেন, যতক্ষণ বেঁচে আছেন সাক্ষী হচ্ছেন এক বৈশ্বিক মহামারির, যাকে ইংরেজিতে ‘প্যানডেমিক’ বলা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানী, গবেষক, এমনকি সাধারণ অনেকের মনেই প্রশ্ন- কীভাবে এত সফল এই ভাইরাস? প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়, শুরুতে বোঝাও যাচ্ছে না আক্রান্ত হয়েছেন কি না; কীভাবে এই ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ?
করোনাভাইরাস, মূলত ভাইরাসের একটি পরিবার। এর প্রতিটি সদস্যের ভাইরাস পার্টিকেলের ভেতরে আছে সামান্য একটু জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল (আরএনএ বা রাইবো নিউক্লিক এসিড) আর জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালকে মুড়িয়ে রেখেছে একটি লিপিডের (চর্বিজাতীয় বস্তু) খাম। বিশ্বজুড়ে COVID-19 মহামারি ঘটানো ভাইরাসটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন SARS-CoV-2, একই পরিবারের SARS-Cov এবং MERS-CoV মহামারি ঘটিয়েছে, তবে কোনোটিই বৈশ্বিক আক্রমণে এত সফল হতে পারেনি।
যদিও এই ভাইরাসের লিপিড আবরণ সাবানের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, সাবানের স্পর্শে আসলে এর লিপিড আবরণটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালটি বাইরে অরক্ষিত হয়ে যায়, ফলে এর সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। এই ভাইরাসটি বাইরে অর্থাৎ কাঠে, কাগজে, কাপড়ে, স্টিল কিংবা প্ল্যাস্টিকের বহিরাবরণে সক্রিয় থাকতে পারে তিন-চার ঘণ্টা। তবে কোনো কোনো গবেষণা বলছে এক থেকে তিনদিন পর্যন্তও সক্রিয় থাকতে পারে এই ভাইরাস, অর্থাৎ এই সময়ে আপনি-আমি ঐ জায়গায় স্পর্শ করলে ভাইরাস আমাদের হাতে লেগে যেতে পারে। তবে ভাইরাস জীবদেহের বাইরে সংখ্যাবৃদ্ধিতে সক্ষম নয়, অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে জীবদেহের মাঝে যেতে না পারলে তার খেল খতম!
এই ভাইরাস জীবদেহে প্রবেশ করে কী উপায়ে?
এই কোভিড-১৯ সাধারণ কোনো ফ্লু নয়, এর লক্ষণ এবং ধরন বাকি করোনাভাইরাসদের থেকে আলাদা। করোনাভাইরাস পরিবারের চার সদস্য (OC43, HKU1, NL63, 229E) পৃথিবীজুড়ে এক-তৃতীয়াংশ সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বরের জন্য দায়ী, বাকি দুটি সার্স আর মার্সের লক্ষণ অনুযায়ী, এবারের কোভিড-১৯ এর চেয়ে বেশি তীব্র আকারের ছিল।
তবে এর কেউই বৈশ্বিক মহামারির আকার নিতে পারেনি। এই পরিবারের সাত নাম্বার সদস্যটি (SARS-CoV-2) এখন সারাবিশ্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই ভাইরাসের গঠন এর সফলতার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়। অসংখ্য কাঁটাযুক্ত একটি বলের মতোই এর গঠন, এই কাঁটাগুলোকে স্পাইক বলা হয়। এই স্পাইকগুলো আমাদের কোষের একটি প্রোটিন ACE2’র সাথে যুক্ত হতে পারে। এই প্রোটিনটি আমাদের কোষে পাওয়া যায়। ভাইরাস তার স্পাইক দিয়ে আমাদের এই প্রোটিনের সাথে যুক্ত হওয়ার ঘটনাটি ভাইরাসের মানুষকে সংক্রমণের প্রথম ধাপ। গবেষণা বলছে, আগের সার্স ভাইরাস (যেটিকে এখন বিজ্ঞানীরা সার্স ক্লাসিক নামেও চিহ্নিত করছেন) এর চেয়ে এখনকারটি অনেক শক্তপোক্তভাবে যুক্ত হতে পারে ACE2 এর সাথে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এঞ্জেলা রাসমুসেন বলছেন, “এই শক্ত বন্ধনের ব্যাপারটি এক ব্যক্তি থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর শক্ত বন্ধনের কারণে খুব কম ভাইরাসই সংক্রমণ শুরু করতে যথেষ্ট।”
করোনাভাইরাসের পরিবারের ভাইরাসের বহিরাবরণের স্পাইকগুলো দুটি জোড়া লাগানো অংশ নিয়ে গঠিত। এটি তখনই সক্রিয় হয় যখন দুটি অংশ আলাদা হয়ে যায়, এবং ভাইরাসটি তখন আমাদের কোষে প্রবেশ করতে পারে। সার্স ক্লাসিক (যেটি সার্সের জন্য দায়ী ছিল) ভাইরাসে এই আলাদা হওয়ার কাজটি বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু এবার কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী ভাইরাসের দুটি অংশ আলাদা করতে কাজ করে ফুরিন (Furin) নামের একটি এনজাইম কাজ করে, এবং দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো মানুষের কোষ নিজেই এই ফুরিন এনজাইম তৈরি করতে পারে এবং আমাদের বিভিন্ন কোষে ফুরিন এনজাইম পাওয়া যায়। স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইন্সটিটিউট এর গবেষক ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসন বলছেন, এই ভাইরাসে যতগুলো অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটি।
মানুষের শ্বসনযন্ত্রে আক্রমণকারী ভাইরাসদের বলা হয় রেস্পিরেটরি ভাইরাস। কোভিড-১৯ এর SARS-CoV-2 ভাইরাসটিও রেস্পিরেটরি ভাইরাস। তবে এই ভাইরাসগুলো আক্রমণের সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে। যেমন- কিছু রেস্পিরেটরি ভাইরাস আমাদের শ্বসনযন্ত্রের উপরের অংশে আক্রমণ করে। এরা হাঁচি, কাশির মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়ায়, তবে এরা মানুষকে খুব একটা ভোগায় না। দ্রুত ছড়ায়, আবার দ্রুত সেরেও যায়। মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বুঝতেও পারে না তার ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে। আর শ্বসনযন্ত্রের নীচের দিকে যারা আক্রমণ করে, তারা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায় খুব আস্তে, তবে এরা মানুষকে বেশ ভোগায়।
SARS-CoV-2 মানুষের শ্বসনযন্ত্রের উপরে এবং নীচে দুই জায়গাতেই আক্রমণ করতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ফুরিন সুলভ হওয়ার কারণে এই কাজটি অধিকতর সহজ হয়েছে। আর এ কারণেই যতদিন ভাইরাস মানুষের দেহে আস্তানা গাড়ছে ততদিনে সে ছড়াতেও শুরু করেছে। নিজের অজান্তেই আমরা হয়তো সেই ভাইরাস একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে পৌঁছে দিচ্ছি।
বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে এই ভাইরাসের আদি উৎস বাদুড়, বাদুড় থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে প্যাঙ্গোলিনে ( যাকে আমরা বলি বনরুই), সেখান থেকে মানুষে। ভাইরাস এই ব্যাপারটিতে খুব দক্ষ। সে তার পোষক পরিবর্তন করে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়িয়ে যেতে পারে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে।
তবে এই ভাইরাসের অস্বাভাবিক সব বৈশিষ্ট্যের কারণে একে নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও কম নয়। কীভাবে এই ভাইরাসটি ঠিকঠাক আমাদের ACE2 প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে গেল? পৃথিবীতে শত সহস্র ভাইরাস থেকে এই ভাইরাসটি একই সাথে এত দুর্লভ বৈশিষ্ট্য পেয়ে গেল! তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, জেনোমিক গবেষণায় এখনও প্রমাণ করছে এই ভাইরাস ল্যাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং বাদুড়, প্যাঙ্গোলিন হয়েই মানুষে প্রবেশ করেছে।
ভাইরাসের মিউটেশনের ফলে নিজের জেনেটিক উপাদানের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন আনতে পারে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই ভাইরাসের তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। সাধারণ ভাইরাস যেমন মিউটেশন করে ঠিক তেমনই এতেও হচ্ছে। এখন পর্যন্ত শতাধিক মিউটেশন রেকর্ড করা হয়েছে। তবে কোনোটিই তেমন বড় মাপের নয়। ইউনিভার্সিটি অভ নর্থ ক্যারোলাইনার গবেষক লিসা গ্রালিনস্কি বলছেন, ভাইরাসে বড় মাপের পরিবর্তন আসে তার ওপর চাপ সৃষ্টি হলে, এই ভাইরাস ঠিকঠাক সংক্রমণ ঘটিয়ে যাচ্ছে, তাই এর পরিবর্তনের সম্ভাবনাও কম।
তবে এই ব্যাপারটিতেও নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা। সিঙ্গাপুরের এক রোগীর কাছ থেকে আলাদা করা ভাইরাসে দেখা গেছে ভাইরাস তার জিনের একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছে। যে পরিবর্তনের ফলে ভাইরাসটি কম আক্রমণাত্মক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে অনেক দেশ থেকে নেওয়া নমুনায় এটি দেখা যায়নি। তাই একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বলছেন বিজ্ঞানীরা।
করোনা দেহে আক্রমণ করে যেভাবে
এই ভাইরাস দেহে প্রবেশের পর আমাদের শ্বাসনালীর ACE2 বহনকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে। আমাদের শ্বাসনালীর কোষগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে, একদিকে আমাদের শ্বাসনালীতে মৃত-কোষের অবশিষ্ট জমা হয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে এই ভাইরাস কোষ ধ্বংস করতে করতে ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছায়। ফুসফুসে সিলিয়াকে আক্রমণ করে এই ভাইরাস। সিলিয়ার কাজ অনেকটা ঝাড়ু দেয়ার মতোই। সংক্রমণের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ফুসফুসে জমা হতে থাকে মৃত কোষ। ফলে আগে যেটি শ্বাস নেওয়ার সমস্যা ছিল সেটি প্রকট আকার ধারণ করে বাইরে থেকে অক্সিজেনের দরকার পড়তে পারে কারো কারো ক্ষেত্রে।
আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ভাইরাসকে আক্রমণ করে এবং ফলে জ্বর উঠে। আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে পারে তবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েও সেরে উঠতে পারেন মানুষজন। যেটি হয়ে থাকে তরুণ, অধূমপায়ী এবং ভালো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে যাদের সেই মানুষদের ক্ষেত্রে। তবে যদি কারো আগে থেকেই ফুসফুসে, শ্বাসনালীতে সংক্রমণ থাকে কিংবা দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অধিকারী হয়ে থাকেন (ইম্যুনো-কম্প্রোমাইজড), তবে ভাইরাসের ক্ষেত্রে আমাদের ফুসফুসের ক্ষতি করা আরো সহজ হয়ে যায়। তাই বৈশ্বিকভাবেই বয়স্করা একটু বেশি ঝুঁকিতে আছেন।
তবে তরুণ কিংবা মধ্যবয়স্ক যাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঠিক আছে, তাদের অনেকেও ঝুঁকিতে আছেন কারণ, আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায়শই ব্রেকফেল করে। বিশেষ করে দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ যখন অনেক বেড়ে যায় এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতি মাত্রায় কাজ শুরু করে তখন দেহের ক্ষতি আরো বেশি হয়। এই ধরনের অতি ক্রিয়াশীল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেহে ‘সাইটোকাইন ঝড়’ নামের এক পরিস্থিতি তৈরি করে।
এই পরিস্থিতিতে দেহের সাধারণ কোষগুলো ধ্বংস হতে থাকে। ভাইরাসের আক্রমণের ফলে দুর্বল ব্যবস্থায় আঘাতের ফলে দেহে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়। এককথায়, ব্রেকফেল করা ইম্যুন সিস্টেম নিজের দেহের কোষ ধ্বংস করে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে (Organ Failure)। আর ঐ ব্যক্তির দেহে যদি আগে থেকেই কোনো ইনফেকশন থেকে থাকে তাহলে অবস্থা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। এখানে বয়স, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয় যে, ব্যক্তি কি সাইটোকাইন ঝড় পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না।
করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যাও নগণ্য। ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার গবেষক সুসান ওয়েইস প্রায় চল্লিশ বছর ধরে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, ২০০২ সালে সার্স এপিডেমিকের পরে গবেষকদের অনেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। তা-ও বেশ সামান্য। তাই মানুষের করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যাপক কাজ শুরু করা দরকার। নাহলে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ যেখানে হাতের মুঠোয়, সেখানে বারবার এই ধরনের মহামারি ছড়িয়ে পড়াও অস্বাভাবিক কিছুই নয়।