আমাদের চারপাশে সারাক্ষণ গিজগিজ করছে কোটি কোটি ক্ষতিকর পদার্থ। এর মধ্যে রয়েছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফাঙ্গাসসহ হাজার হাজার বস্তুকণা। এরা নানানরকম রোগ বাঁধিয়ে আমাদের দেহের ক্ষতি করতে ওস্তাদ। এক কথায় এদের বলা হয় প্যাথোজেন (Pathogen)। বাতাসে, মাটিতে, পানিতে কোথায় নেই তারা? আমরা যে খাবার খাচ্ছি, তার মধ্যে রয়েছে প্যাথোজেন। এমনকি নিঃশ্বাসের সাথে যে বাতাস আমরা গ্রহণ করছি, তার মধ্যেও রয়েছে প্যাথোজেন। আমরা আসলে সবদিক থেকে রোগজীবাণু পরিবেষ্টিত হয়েই বসবাস করছি। তাহলে প্রশ্ন আসে, আমরা কেন সবসময় অসুস্থ হই না?
কারণ আমাদের দেহের ইমিউনিটি। প্যাথোজেন যদি বুনো ওল হয়, আমাদের শরীরও তেমনই বাঘা তেঁতুল। আমাদের শরীরে রোগজীবাণু প্রবেশ করা মাত্রই, দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সতর্ক হয়ে ওঠে। এগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য দেহের রয়েছে নানাবিধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা বিনাযুদ্ধে সূচাগ্রমেদিনীও ছাড়তে নারাজ। বেশিরভাগ সময়ই রোগজীবাণু দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে পরাজয় বরণ করে। ফলে দেহের উপর তাদের বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে না। দেহের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ইমিউনিটি (Immunity) নামে পরিচিত।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে, ‘এটি হলো সেসকল শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের সমষ্টি, যা শরীরের ভেতর শরীর বহির্ভূত পদার্থকে আলাদা করে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় বা শরীর থেকে বিমুক্ত করতে পারে বা বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম।’ মোদ্দাকথা, ইমিউনিটির কাজই হচ্ছে শরীরে শত্রুর অনুপ্রবেশকে চিহ্নিত করে তাদের মোকাবেলা করা। ইমিউনিটিকে প্রথমিকভাবে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এরা হলো-
- জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Innate Immunity or Non-specific Immunity)
- আত্মীকৃত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Adaptive Immunity or Specific Immunity)
জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
মানুষ জন্মের সময়ই কিছুটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। একে জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলে। এটি কোনো রোগ বিশেষের সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই একে Non-Specific Immunity-ও বলা হয়। রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার কিছু ক্ষমতা জিনের সাথে সম্পর্কিত। যেমন ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জীবাণুর নাম প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপারাম। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল মানুষের দেহে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট ডিহাইড্রোজিনেজ নামক একটি এনজাইমের কমতি আছে, তাদের দেহে এই জীবাণু ভয়াবহতার কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না। একটি বিশেষ ধরনের রক্তশূন্যতায় ভোগা মানুষের শরীরেও ম্যালেরিয়ার এই জীবাণু অকেজো।
আবার শরীরে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরুতেই জীবাণুর অনুপ্রবেশকে বাধা প্রদান করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো আমাদের ত্বক। এটি দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। দেহের যেসব স্থানে ত্বক নেই সেসব স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে ত্বকের এই ভূমিকা পালন করে ‘মিউকাস মেমব্রেন’ নামক পর্দা। এছাড়া শ্বাসনালীতে একধরনের কোষ রয়েছে। এদেরকে বলা যায় দেহের ঝাড়ুদার। কারণ এরা সারাক্ষণ শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে থাকে। যদি কোনো বস্তুকণা ঢুকে পড়ে তাহলে তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করে এই কোষগুলো।
তবে এরা অপেক্ষাকৃত বড় আকারের বস্তুকণাকে দূর করতে পারে না। তাহলে তাদের কীভাবে দেহের বাইরে পাঠানো যাবে এদের? আমরা যে থুতু ফেলি কিংবা আচমকা বিশাল এক হাঁচি দেই, তাতেই এরা পগার পার হয়ে যায়।
ডায়রিয়া কিংবা বমি করাও কিন্তু শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ। কীভাবে? ধরুন, কারো ফুড পয়জনিং হয়েছে। যে খাবার খেয়ে বিরূপ অবস্থা হয়েছে, সেগুলো পাকস্থলীতে বসে থাকলে তো সে ব্যক্তি সুস্থ হতে পারবে না। আগে সেগুলোকে দেহের বাইরে বের করতে হবে। এজন্য দেহ তখন ডায়রিয়া বা বমির মাধ্যমে দেহ থেকে দ্রুত এগুলো বের করে দেওয়ার কাজ করে।
মানুষের কানে কেন ময়লা (ওয়াক্স) হয় একবার ভেবে দেখেছেন? কান অতি সংবেদনশীল একটি অঙ্গ। সেখানে যদি বাইরের বস্তুকণা প্রবেশ করে তাহলে বড় রকম গোলমাল বাঁধার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কর্ণকূহর থেকে একধরনের মোমের মতো পদার্থ ক্ষরিত হতে থাকে। ধুলিকণা এতে আটকে যায়। এগুলোর এদের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস নাশ করার ক্ষমতাও আছে।
পাকস্থলীতে রয়েছে প্রতিরক্ষার আরেকটি স্তর- শক্তিশালী এসিডের মিশ্রণ। খাদ্যের সাথে যে সমস্ত জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে তাদের অধিকাংশের সমাধি ঘটে এখানে। শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গেরই নিজস্ব একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে।
অশ্রু এবং লালায় লাইসোজাইম নামক একধরনের এনজাইম রয়েছে। এটি ব্যাকটেরিয়া কোষের আবরণ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। বীর্যের স্পারমিন ও জিঙ্ক এবং মাতৃদুগ্ধের ল্যাকটো পারঅক্সাইডও ঠিক এই কাজ করে। এ সকল বাধা পেরিয়ে কোনোভাবে ক্ষতিকর উপাদান আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারলে তাদের প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ম্যাক্রোফেজ, ইওসিনোফিল এবং ন্যাচারাল কিলার সেলের মতো মারকুটে কোষেরা।
আত্মীকৃত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
জন্মের পর থেকে নানারকম প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় শরীরকে। তাদের মোকাবেলা করতে করতে শিখে নেয় আরো বিভিন্ন ধরনের কৌশল। এটি হলো ইমিউনিটির দ্বিতীয় রকমফের। এদের বলা হয় আত্মীকৃত রোগ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে এরা প্রতিরোধের কৌশলটি শিখে নেয়, শুধুমাত্র সেই পরিস্থিতিতেই এটি কাজ করে। তাই একে Specific Immunity বলা হয়।
হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের শরীর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শরীরে যে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া হয়, তা-ও ঠিক এই উপায়ে কাজ করে।
সন্তান যখন মাতৃগর্ভে থাকে, তখন অমরার মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণে মায়ের শরীরের এন্টিবডি সঞ্চারিত হয়। এই এন্টিবডি ভ্রুণকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রক্ষা করে। মাতৃ্দুগ্ধের মাধ্যমেও মায়ের শরীরের এন্টিবডি সন্তানে সঞ্চারিত হয়। ফলে মাতৃদুগ্ধ পানকারী সন্তান অধিক সুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠে। যেসকল অঙ্গ শরীরের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক ইমিউনো অঙ্গসমূহ হলো-
- থাইমাস গ্রন্থি ও
- অস্থিমজ্জা
বাকি ইমিউনো অঙ্গের মধ্যে রয়েছে-
- লিম্ফনোড
- এপেনডিক্স
- টনসিল
- এডিনয়েড
- অন্যান্য লিম্ফটিস্যু
ইমিউনিটি আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। ইমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে নানা রকম ভ্যাকসিন বা টিকা। ফলে বিভিন্ন রকম রোগ থেকে আমরা সুরক্ষিত থাকতে পারছি। এছাড়া ক্লিনিকাল বা সাব-ক্লিনিকাল সংক্রমণের পর ইমিউনিটির জন্য আমাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে একই জীবাণুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে।পক্স মানুষের জীবনে একবারই হয়– এ ধরনের অনুসিদ্ধান্তের পেছনের রহস্য এই ইমিউনিটিই।
তবে এত কাজের পাশাপাশি সে বেশ কিছু অসুবিধাও তৈরি করে ফেলে। বিভিন্ন ধরনের হাইপারসেনসিটিভিটি (অতি সক্রিয়তা) যেমন অ্যাজমা, বাতজ্বর, কিডনির গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস প্রভৃতি রোগ আমাদের দেহের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অতি সক্রিয়তার জন্য হয়ে থাকে। এছাড়া কিছু সময় এটি শরীরের নিজস্ব কোষের বিরুদ্ধেই ভুলবশত এন্টিবডি উৎপাদন শুরু করে, যা মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথোম্যাটোসাস, অটো ইমিউনো হিমোলাইটিক এনিমিয়া প্রভৃতি।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সবচেয়ে বড় ঝামেলা বাঁধায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সময়। অঙ্গের যে অংশটিকে দেহে স্থাপন করা হয় তাকে গ্রাফট বলে। গ্রাফট কয়েক ধরনের হতে পারে।
- অটোগ্রাফট- একই ব্যক্তির শরীরের এক স্থান থেকে কোনো অঙ্গ অন্য জায়গায় স্থাপন করা। যেমন ত্বক।
- আইসোগ্রাফট- দেখতে হুবহু জমজের একজনের দেহ থেকে অন্য একজনের দেহে অঙ্গ স্থাপন।
- অ্যালোগ্রাফট- যেকোনো একজন মানুষের দেহ থেকে অন্য একজনের দেহে অঙ্গ স্থাপন।
- জেনোগ্রাফট- এক প্রজাতির প্রাণীর দেহ থেকে কোনো অঙ্গ অন্য প্রজাতির প্রাণীর দেহে স্থাপন।
এদের মধ্যে অটোগ্রাফটে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো ঝামেলা করে না। কিন্তু বাকি সকল ক্ষেত্রে গ্রাফট টিস্যুর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে ফেলে। এই প্রতিক্রিয়া যত বেশি হয়, ততই প্রতিস্থাপনকৃত অঙ্গের টিকে থাকার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। চুড়ান্ত পর্যায়কে গ্রাফট রিজেকশন বলা হয়। অর্থাৎ গ্রাফট টিস্যুকে গ্রহীতার শরীর প্রত্যাখ্যান করে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া কর্টিকোস্টেরয়েড, এজাথায়োপ্রাইন, সাইক্লোসেরিনের মতো কিছু ওষুধ আছে যেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমিয়ে রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে নানাভাবে সুরক্ষিত করে রেখেছে। এটি আমাদের জীবনের সাথে এতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে, আলাদাভাবে এর অস্তিত্ব উপলব্ধি করাই দুরূহ ব্যাপার।
Feature Image: drjockers.com