মাতৃমৃত্যু কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী, একজন নারীর গর্ভাবস্থায়, প্রসবাবস্থায় কিংবা প্রসবোত্তর ৪২ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শারীরিক জটিলতার কারণে (ভিন্ন কোনো রোগ, যেমন- ক্যান্সার, যক্ষ্মা প্রভৃতি কিংবা দুর্ঘটনাব্যতীত) মৃত্যু ঘটলে, তাকে মাতৃমৃত্যু হিসেবে অভিহিত করা যায়।
জাতিসংঘের সর্বশেষ জরিপের ফল বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৩,০৩,০০০ নারী গর্ভধারণকালীন সময়ে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে, কিংবা পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত শারীরিক জটিলতার কারণে মারা যান। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিবছর ৮৩০ জন নারীর মাতৃমৃত্যু ঘটছে; অর্থাৎ প্রতি ২ মিনিটে একজন নারীকে এই করুণ পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে।
অধিকাংশ মাতৃমৃত্যুই ঘটছে এমন সব কারণে, যা একটু সচেতনতার মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা যেত। যদি নারীরা গর্ভাবস্থা ও প্রসবাবস্থায় যথাযথ যত্ন ও সুচিকিৎসা লাভ করেন, তাহলেই তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেকেরও নীচে নেমে আসে। মূলত খিঁচুনি ও প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই বেশিরভাগ নারীর মৃত্যু ঘটে। তবে এর পাশাপাশি জন্ডিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্টের মতো পরোক্ষ কারণেও অনেক নারীকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
কোথায় মাতৃমৃত্যু বেশি ঘটছে?
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী সংঘটিত মাতৃমৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটছে সাব-সাহারান আফ্রিকায়। আর কেবল নাইজেরিয়া ও ভারতেই পুরো বিশ্বের বাকি এক-তৃতীয়াংশ মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর বাইরে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও কম-বেশি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও, সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চল, নাইজেরিয়া ও ভারতে এর পরিমাণ এত বেশি যে তার তুলনায় বাকি বিশ্বের সংখ্যাগুলোকে নিতান্তই নগণ্য বলে মনে হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোতে গড়ে প্রতি এক লক্ষের ভেতর ৪৩৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। সেখানে উন্নত দেশগুলোতে প্রতি এক লক্ষে মাতৃমৃত্যুর পরিমাণ মাত্র ১২।
বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ২০১৫ সালে পুরো বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে দেখা যাচ্ছে, সিয়েরা লিওনে মাতৃমৃত্যুর হার সর্বাধিক। সেখানে প্রতি এক লক্ষের মধ্যে ১,৩৬০ জন নারীর মাতৃমৃত্যু ঘটে। তারপরও এই পরিসংখ্যানকে আপনি আশাব্যঞ্জক হিসেবেই বিবেচনা করবেন, যখন শুনবেন ১৯৯০ সালে এই হার ছিল প্রায় দ্বিগুণ!
বাংলাদেশের অবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৬। অর্থাৎ এক লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। সবমিলিয়ে এ দেশে প্রতিদিন প্রায় ১৬ জন নারী, অর্থাৎ বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার নারীর মাতৃমৃত্যু ঘটছে। তবে আশার বিষয় হলো, এ দেশের নারীদের মাঝে সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালে যেখানে মাত্র ৯% নারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসব করতেন, ২০১০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩% এ। আর তার মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই এ হার বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশিতে পরিণত হয়। ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসবের হার ছিল ৪৭%।
মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গৃহীত পদক্ষেপ
যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে প্রতি বছরে ৩,০৩,০০০ জন নারী মাতৃমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,৩২,০০০। সুতরাং মাত্র এক প্রজন্মের ব্যবধানেই বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার ৪৪% হ্রাস পেয়েছে।
সংখ্যাতাত্ত্বিক উন্নয়ন উদযাপনের দাবিদার বটে, কিন্তু যদি বড় পরিসরে চিন্তা করা হয়, তাহলে কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ এত সহজেই দূর হবে না।
মাতৃমৃত্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ হাল আমলের কোনো ঘটনা নয়। সেই ১৯৭৫ সালেই, যখন মেক্সিকোতে প্রথম নারী সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল, সেখানে মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল মাতৃমৃত্যু। এর হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছিল সর্বমহল থেকে। ১৯৯৪ সালে আবার মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের সরকার একযোগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, তারা যেভাবেই হোক মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনবে। কতটা কমিয়ে আনবে? এর জবাবও ছিল তাদের কাছে। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার যত রেকর্ড করা হয়েছিল, ২০১৫ সালের ভেতর তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, বাস্তবে সেই প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি।
২০০১ সালে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো মিলে যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (Millenium Development Goals) নির্ধারণ করে, সেখানেও সর্বসম্মতিক্রমে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার তিন-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা হবে। এই লক্ষ্য নির্ধারণের পর বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার চেষ্টা আরও জোরেশোরে শুরু হয় বটে, কিন্তু বলাই বাহুল্য, শেষপর্যন্ত সফলতার দেখা মেলেনি। বরং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জনেই সবচেয়ে কম অগ্রগতি ঘটেছে!
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৫.৫% হ্রাসের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তবে এই নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে মাত্র ২.৩%। এবং এই মুহূর্তে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের গ্রাফ নিম্নগামী থেকে সমান্তরালে পরিণত হয়েছে।
কেন এই অবস্থা?
যখন মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল, তখন সামান্য কিছু পদক্ষেপ, যেমন- নারীদের মাঝে গর্ভকালীন সময়ে সঠিক ওষুধ-পথ্য গ্রহণ, নিজের যত্ন নেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, প্রসবের জন্য উন্নত ব্যবস্থা নেয়া প্রভৃতি সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমেই প্রভূত উন্নতিলাভ সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু এখন যেহেতু মোটা দাগে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, তাই এখন আরও উচ্চতর ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। এজন্য একাধারে যেমন রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা একান্ত কাম্য, ঠিক তেমনই অর্থের অনবরত যোগানেরও কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অ্যানেকা নুটসন। তার মতে, সচেতনতা বৃদ্ধির মতো প্রাথমিক ধাপগুলো পার করে আসা হয়েছে। এখন প্রয়োজন আরও বড় ধরনের প্রভাব। যেমন- স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে হবে, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী প্রেরণ করতে হবে, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়াতে হবে। এখনও এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহীত হয়নি বলেই মাতৃমৃত্যু হ্রাসের চাকা নিশ্চল হয়ে পড়েছে।
যে কারণে মৃত্যু ঘটছে নারীদের
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে, আর সেগুলোর শিকড় প্রোথিত রয়েছে দারিদ্র্য, অসাম্য আর যৌনবিদ্বেষের ভেতর। বেশিরভাগ নারীই মারা যান সেসব প্রত্যন্ত, পিছিয়ে পড়া, আলোর মুখ না দেখা অঞ্চলগুলোতে, যেখানে এখনও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গিয়ে পৌঁছায়নি। উন্নত বিশ্বে যেখানে একজন নারীর প্রসবের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালা হয়, সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা ঘরের এককোণে শুয়ে অশিক্ষিত দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম দিতে গেলে তাদের মধ্যে অনেকেরই যে মৃত্যু ঘটবে, সেটিই তো স্বাভাবিক।
২০১৪ সালে, বিশ্বের প্রসূতিশাস্ত্রের চালচিত্র বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে যত দাই, সেবিকা ও চিকিৎসক রয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৪২% বাস করেন ঐ ৭৩টি দেশে, যেখানে মা ও নবজাতক শিশুর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আজও তৃতীয় বিশ্বের এক বিশাল নারীগোষ্ঠী পেশাদার কারও সাহায্য ছাড়াই, একা একা কিংবা প্রতিবেশী কোনো তথাকথিত দাইয়ের সহায়তায় সন্তান জন্ম দিচ্ছে। আর এ থেকেই সব জটিলতা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে ঝুঁকি ও মৃত্যু প্রবণতাও।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় কাজ করে। সেই বিষয়টি হলো অর্থনৈতিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেহেতু অনেক দূরে দূরে একেকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থান, তাই অনেক নারীকেই এমন জায়গায় বাস করতে হয় যার আশেপাশে ১০-১৫ মাইলের মধ্যেও কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। হঠাৎ তাদের প্রসব বেদনা উঠলে বা তারা অসুস্থ অনুভব করতে থাকলে দ্রুত তাদেরকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে প্রয়োজন উচ্চমূল্যের পরিবহন ব্যবস্থা, যার খরচ মেটানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি অধিকাংশেরই থাকে না।
দ্য গাটম্যাচার ইনস্টিটিউট হিসাব কষে দেখিয়েছে, লাতিন আমেরিকায় যেখানে ৯০% নারীই তাদের সন্তানের জন্ম দেবে উন্নত কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, সেখানে আফ্রিকার নারীদের মাঝে সেই হার হবে কেবলই ৫০%।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভাবস্থায় তথা সন্তান জন্ম দেয়ার পূর্বে একজন নারীকে অন্তত আটবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিজের শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে আসতে হবে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে গর্ভবতী নারীর শরীরের হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনই নিশ্চিত হয়ে নেয়া যায় যে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তাকে কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে কি না, আর যদি সে সম্ভাবনা থাকে তবে তা কীভাবে আগে থেকেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। কোনো নারীর পারিপার্শ্বিক সমস্যা থাকলে, যেমন তার যদি ম্যালেরিয়া রোগ হয়ে থাকে বা তিনি এইচআইভি পজিটিভ হন, তবে এই পরীক্ষাগুলোর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। কিন্তু অনুন্নত দেশের নারীদের গর্ভাবস্থায় আটবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রবণতা একদমই কম।
গাটম্যাচারের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৬৩% নারী যেখানে গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, আফ্রিকা অঞ্চলে সে পরিমাণ ৫১%।
সংস্থাটি বৈজ্ঞানিক হিসাবের মাধ্যমে আরও জানাচ্ছে যে, সকল গর্ভবতী নারীই যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যার সুপারিশ মেনে চলতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার ৬০% হ্রাস পেত। অর্থাৎ, বছরে তখন মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটতো মাত্র ১,১২,০০০টি।
পুরুষতান্ত্রিকতার ভূমিকা
বিশ্বের কোটি কোটি নারী এখনও নিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত যে, তারা বিয়ে করতে বা সন্তান জন্ম দিতে রাজি কি না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১৫-৪৯ বছর বয়সী সন্তান জন্মদানে অনিচ্ছুক ২১ কোটি ৪০ লক্ষ নারীই কোনো উন্নত জন্মনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। কারণ, হয় এসব জন্মনিরোধক তাদের নাগালের বাইরে, কিংবা তাদের সঙ্গী ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এগুলোর অনুমোদন দিচ্ছে না। সাব-সাহারান অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি নারী আধুনিক জন্মনিরোধক ব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
অনেক দেশেই কেবল তখনই গর্ভপাতের অনুমতি দেয়া হয়, যখন গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে, অর্থাৎ তাকে বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আর কিছু দেশে তো গর্ভপাত পুরোপুরিই নিষিদ্ধ – প্রয়োজনে গর্ভবতী নারী প্রাণ হারাক, তবু তার গর্ভপাতের অনুমতি দেয়া হবে না।
কিন্তু তাই বলে থেমে নেই গর্ভপাত। যেসব দেশে বৈধভাবে গর্ভপাত করতে দেয়া হয় না, কিংবা দেয়া হলেও সমাজের চোখে তা বিশাল বড় অপরাধ বলে গণ্য হয়, সেখানে নিরুপায় নারীরা উদ্যত হন অবৈধ ও অনিরাপদ উপায়ে গর্ভপাত করাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এভাবে অনিরাপদ উপায়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রতি বছর ১৩% মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঝুঁকিতে কারা?
বয়ঃসন্ধিতে থাকা নারীদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ভয়ংকর তথ্য। গত বছর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী যত কিশোরীর মৃত্যু ঘটেছে, তাদের সিংহভাগেরই মূলত মাতৃমৃত্যু ঘটেছে। হয় তারা গর্ভাবস্থায় শারীরিক জটিলতা থেকে মারা গিয়েছে, নয়তো প্রসবকালীন সময়ে অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে, কিংবা নিছকই অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে।
কিশোরী মায়েদের মৃত্যুর পেছনে বড় ভূমিকা থাকে অত্যুচ্চ রক্তচাপ ও অসহনীয় প্রসব বেদনার, যেহেতু তাদের শরীর তখনও সন্তান জন্মদানের মতো উপযুক্ত কাঠিন্যতা ও সহনশীলতা লাভ করেনি। আরও বিস্ময়কর ব্যাপয়ার হলো, গর্ভবতী কিশোরীদের অর্ধেকেরও বেশিরই গর্ভধারণ ঘটে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে।
কাগজে-কলমে কেবল ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মাতৃত্বের হিসাবই পাওয়া যায়। কিন্তু এর চেয়ে কম বয়সী কোনো কিশোরী কি মা হয় না? শুনে অবাক হবেন না, ২০১৬ সালে গাটম্যাচার ইনস্টিটিউট এক হিসাবের মাধ্যমের দেখিয়েছিল, সেই বছর ১০-১৪ বছর বয়সী কিশোরীরাই জন্ম দিয়েছে ৭,৭৭,০০০ শিশুর!
এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, আমাদের পৃথিবীটা দিনে দিনে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরীদের জন্য কতটা বসবাস-অযোগ্য হয়ে উঠছে।
দায়ী যখন বাল্যবিবাহও
এত কমবয়সী কিশোরীরা যে মা হয়ে যাচ্ছে, এর পেছনে দায়ী কোন জিনিসটি? অবশ্যই বাল্যবিবাহ। জাতিসংঘের সব দেশ একযোগে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া সত্ত্বেও, প্রতিবছর ৭৩ লক্ষ অনূর্ধ্ব-১৮ কিশোরী মা হয়ে যাচ্ছে, আর তাদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে ৯ জনই কিন্তু বিবাহিত।
আফ্রিকা মহাদেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক এমন প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে ১৮টি দেশই আফ্রিকার। তবে বাংলাদেশি পাঠক হিসেবে যে তথ্যটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করবে তা হলো, সবচেয়ে কম বয়সে কিশোরীরা মা হয় এমন দেশগুলোর মধ্যে তিন নম্বরেই কিন্তু বাংলাদেশ!
কমে যাচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষার্থে অনুদান
বিগত কয়েক বছরে মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষার্থে অনুদানের পরিমাণ ১১% কমে গেছে। ২০১৩ সালে যেখানে অনুদানের পরিমাণ ছিল ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, গত বছর (২০১৭) তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহায্য প্রদান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে জাতিসংঘের জনসংখ্যা অনুদান তহবিলেও এই মুহূর্তে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি রয়েছে।
এই সমস্যার ভবিষ্যৎ কী?
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যর্থ হওয়ার পর, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (Sustainable Development Goals) অংশ হিসেবে মাতৃমৃত্যু হ্রাসের পক্ষে স্বাক্ষর প্রদান করেছে। বর্তমান লক্ষ্য অনুযায়ী, প্রতিটি দেশেই মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লক্ষে ৭০ এর নীচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। লক্ষ্যটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেখা যাক, লক্ষ্য বড় হওয়ায় সাফল্যের পারদও যদি খানিকটা উর্ধ্বমুখী হয়!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/