বর্গীর হাঙ্গামা বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ। বর্গী বলতে মারাঠা হামলাকারীদেরকে বোঝানো হয়। বাংলার সুবেদার আলীবর্দী খানের শাসনামলে নাগপুরের মারাঠা সেনারা ৫ দফা আক্রমণ করে এমন তান্ডব চালায় যে, বর্গীর আক্রমণ বাংলা ভাষাতেই চিরস্থায়ী হয়ে যায়। আলীবর্দী খান সুদক্ষ সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও মারাঠাদের বারংবার হামলাকে পরাস্ত করতে না পেরে ১৭৫১ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে মোটা অংকের কর এবং উড়িষ্যা রাজ্য মারাঠাদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
ঘোড়ায় চড়া, হালকা অস্ত্রে সজ্জিত মারাঠাদের অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধ করা খুব কঠিন ছিল। মারাঠা যোদ্ধারা মোগল আমলের পর উপমহাদেশে আরেকটি সুবিস্তৃত সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। ১৬৭৪ সালে শিবাজীর নেতৃত্বে স্থাপিত সাম্রাজ্যটি ১৮১৮ সাল পর্যন্ত, মোট ১৪৪ বছর টিকেছিল। একটা সময় কাশ্মীর, পেশোয়ার থেকে তামিলনাড়ু ও বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিরাট সাম্রাজ্য ব্রিটিশদেরকে প্রথম অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান
ভারতবর্ষের মধ্যভাগে সুবিস্তৃত মালভূমিকে ডেক্কান অঞ্চল বলা হয়। মারাঠাদের আদি নিবাস এখানেই। মূলত হিন্দু এই জনগোষ্ঠী মারাঠী নামক ইন্দো-ভারতীয় ভাষায় কথা বলে। ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত চালুক্য আর রাষ্ট্রকূট রাজবংশ মারাঠাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। একের পর এক মুসলিম আক্রমণের ফলে মারাঠা অঞ্চলে মোগল আর বিজাপুরীদের সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। বিজাপুরের আদিল শাহ এবং মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারতেন না। আর মারাঠা জনগণ সহ্য করতে পারতো না এদের কাউকেই। তারা সবাই জড় হলো শিবাজী নামের এক ব্রাক্ষ্মণের কাছে।
১৬৬৪ সালে শিবাজী গুরুত্বপূর্ণ মোগল বন্দর সুরাটে আক্রমণ করে ৬ দিন ধরে লুটপাট চালান। মোগল সেনাদল আসতে আসতেই সুরাট জ্বালিয়ে দিয়ে মারাঠা গেরিলারা মিলিয়ে যায়। ১৬৬৫ সালে এক শান্তিচুক্তির পর শিবাজী মোগল আনুগত্য মেনে নেন। কিন্তু আগ্রায় আওরঙ্গজেবের সামনে তাকে কাবুলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলে তিনি পালিয়ে চলে আসেন এবং ১৬৭৪ সালে রায়গড়কে কেন্দ্র করে বিজাপুর অঞ্চলে একটি ছোটখাট সাম্রাজ্য গঠন করেন। মোগলদের হাতে বিজাপুরী সুলতানদের ১৬৮৬ সালে চূড়ান্ত পতন হলে মহারাষ্ট্রে রইলো কেবল দুই প্রতিপক্ষ; প্রবল প্রতাপশালী আওরঙ্গজেব এবং পাহাড়ী রাজ্যের ছোট্ট শাসক ছত্রপতি শিবাজী। মারাঠা ভাষায় ছত্রপতি মানে সম্রাট। কিন্তু ১৬৮০ সালে শিবাজীর মৃত্যু হয়।
মারাঠাদের বাড়াবাড়ি দেখে আওরঙ্গজেব স্বয়ং ১৬৮১ সালে মহারাষ্ট্রে এসে উপস্থিত হন। বেঁধে যায় ২৬ বছরব্যাপী এক সুদীর্ঘ যুদ্ধ। শম্ভুজী, রাজারাম আর তারাবাইয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা ১৭০৭ সাল পর্যন্ত আওরঙ্গজেবকে প্রতিহত করতে থাকে। বেচারা মোগল সম্রাট দক্ষিণের ভূমিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৫ লক্ষ মোগল সৈন্য এবং ২০ লক্ষ সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধে মারা যায়।
মারাঠারা নর্মদা নদ পার করে দিল্লি দখল করে নেয়। দিল্লির জেল থেকে মুক্ত হয়ে শিবাজীর নাতি সাহু ক্ষমতায় বসেন। ১৭৫৮ সালের মধ্যে মুলতান এবং পেশোয়ার মারাঠাদের হাতে চলে যায়। সে আমলের অনেক ডাকাবুকো সম্রাট, মহীশূরের হায়দার আলী কিংবা হায়দ্রাবাদের নিজাম বংশ মারাঠাদের ক্ষমতা মেনে নেয়।
মারাঠা সাম্রাজ্য
মারাঠারা সুদক্ষ শাসক ছিল। গোটা সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা প্রভাবশালী ভূস্বামীদের হাতে দেওয়া হতো। এদের নেতৃত্ব দিত একজন পেশোয়া, মানে প্রধানমন্ত্রী। পেশোয়ার অধীনে থাকতো ৮ জন মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনী। এরা ছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের মূল স্তম্ভ। পেশোয়ারা আবার ছত্রপতি মানে সম্রাটের অধীনে থাকতেন। ছত্রপতি পদটি শিবাজীর বংশ অর্থাৎ ভোঁসলে পরিবারের অধীনে ছিল। পরবর্তীতে ছত্রপতি কেবলমাত্র আলংকরিক পদ হয়ে পড়ে। মূল ক্ষমতা চলে যায় পেশোয়াদের হাতে। এই শাসন ব্যবস্থাকে বলা হয় মারাঠা কনফেডারেন্সি।
অনেকগুলো পরগণায় বিভক্ত এই বিস্তৃত অঞ্চলেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের সূত্রটি নিহিত ছিল। মারাঠারা জাতপাত খুব মেনে চলতো। তবে সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করা হতো। শাসন ব্যবস্থা ছিল পরিবারতান্ত্রিক। সিন্ধিয়া, গায়কোয়াড়, ভাটসহ নানা প্রভাবশালী পরিবার সাম্রাজ্যের একেকটা অংশ অনেকটা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। মারাঠা মুসলিমরা অনেক জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিল। খ্রিস্টানদেরকেও সহনীয় দৃষ্টিতে দেখার নীতি চালু ছিল মারাঠাদের মাঝে।
১৭৬১ সালে দুররানি বংশের আফগান শাসকেরা মারাঠাদের ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। রোহিলাখন্ডের শাসক আর অযোধ্যার নবাবের সাথে আহমেদ শাহ আবদালীর মিলিত শক্তি পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদেরকে একদম বিধ্বস্ত করে ফেলে। দিল্লি কিছুকালের জন্য আফগানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। দুর্বল এক মোগল শাসককে সেখানে অধিষ্ঠিত করা হয় আর ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে আফগানরা দেশে ফিরে যাবার ১০ বছরের মধ্যে মারাঠারা আবার দিল্লি দখল করে নেয়।
এসময় পেশোয়া মাধব রাও এর অধীনে মারাঠারা ভারতবর্ষের মুখ্য শক্তি হয়ে ওঠে। বাংলা, হায়দ্রাবাদ, মহীশুর থেকে তারা কর পেতো। পুনে নগর হয়ে ওঠে এক সমৃদ্ধশালী রাজধানী। দরবারী ভাষা হিসেবে মারাঠী ভাষা ফারসির স্থান দখল করে নেয়। সংস্কৃত ভাষাকেও খুব সম্মান করা হতো। মাত্র ২৭ বছর বয়সে মাধব রাও এর মৃত্যুকে মারাঠাদের ক্রমাগত উন্নতির পথে একটি বড় ধরনের ধাক্কা বলা যায়।
মারাঠাদের ভারী অস্ত্রের বহর দুর্বল ছিল। কাজেই ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত আক্রমণ করা তাদের খুব পছন্দের ছিল আর এটাই স্বাভাবিক। দারুণ নৃশংসতা এবং অত্যধিক লুটপাটের কারণে তারা ছিল কুখ্যাত। তবে যুদ্ধে তাদের পারদর্শীতা নাকি আসলেই দেখার মতো ছিল। ডিউক অব ওয়েলিংটন স্যার আর্থার ওয়েলেসলি সহ বহু ইউরোপিয়ান মারাঠা সৈন্যদের সাহস আর দক্ষতা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন, মারাঠারা নাকি ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের দেখা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী।
আফগানরাও একইভাবে মারাঠা সেনাবাহিনীর গুণগান গেয়েছেন। অসংখ্য দুর্গ এবং ভারতের সেরা দেশীয় নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য মারাঠারা বিখ্যাত। কোনকান অঞ্চলে গড়ে ওঠে তাদের জাহাজ নির্মাণ কারখানা। মারাঠা নৌ সেনারা গভীর সমুদ্রে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে না পারলেও হজযাত্রী এবং বিদেশী বাণিজ্য জাহাজে ব্যাপক লুটতারাজ চালিয়ে আরব আগরে আতংক সৃষ্টি করেছিল।
শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি শঠতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন মারাঠা নেতারা। নিজেদের মধ্যে হরদম রেষারেষি চলতো। এমনকি মারাঠা দুর্গে সেনাপতি থাকতো ৩ জন করে, যাতে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ না পায়। ক্ষমতা নিয়ে এই টানাটানি পরে তাদের সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ডেকে নিয়ে আসে।
ব্রিটিশ বধ
মোগল বাদশাহরা মারাঠা পেশোয়াদের হাতের পুতুল হয়ে পড়ায় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় মারাঠারা। ততদিনে বাংলা ব্রিটিশদের হাতে চলে গিয়েছে। ক্ষমতা নিয়ে নিজের দরবারে দ্বন্দের সূত্রপাত হলে পেশোয়া রঘুনাথ রাও ব্রিটিশদের সাথে এক গোপন চুক্তি করেন যাতে তিনি কিছু অঞ্চলের বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সেনা সহায়তা চান। এ কথা চাউর হয়ে পড়লে মারাঠা নেতারা রঘুনাথকে তাড়িয়ে দেন। মারাঠাদেরকে শায়েস্তা করবার জন্য কলকাতা থেকে পাঠানো হয় ওয়ারেন হেস্টিংসকে। ১৭৭৫-৮২ সাল পর্যন্ত মারাঠাদের সাথে ব্রিটিশদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া বংশ এই যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়।
১৭৮২ সালে সালবাই এর চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। ব্রিটিশরা রঘুনাথের কাছ থেকে প্রাপ্ত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। কিন্তু বিনিময়ে নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় মাধব রাওকে মারাঠাদের বৈধ নেতা হিসেবে মেনে নেয় ও মহারাষ্ট্র অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। প্রায় ৩৪ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়।
মারাঠাদের পতন
দ্বিতীয় মাধব রাও এর মৃত্যু হলে প্রভাবশালী মন্ত্রী নানা পাদনাভির সাহায্যে গোয়ালিয়রের দৌলত রাও সিন্ধিয়া খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পুনেতে এ সময় দৌলত রাও সিন্ধিয়ার সমর্থনে ক্ষমতায় বসানো হয় রঘুনাথ রাও এর ছেলে দ্বিতীয় বাজি রাওকে। রঘুনাথ বিশ্বাসঘাতক হওয়ায় রাজদরবারে বাজি রাওকে খুবই অসম্মান করা হতো। তাছাড়া ক্ষমতা তো প্রকৃতপক্ষে ছিল দৌলত রাও এর হাতে।
যা-ই হোক, ১৮০২ সালে ইন্দোরের শাসক যশবন্ত রাও পরাস্ত করেন হোলকার সিন্ধিয়া আর পেশোয়ার যৌথ সেনাবাহিনীকে। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও পালিয়ে যান এবং ঠিক তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তিবলে ব্রিটিশদের কাছে থেকে সেনা পাবেন, এই শর্তে তিনি ব্রিটিশদেরকে বেশ কিছু অঞ্চল ছেড়ে দেন।
মারাঠাদের ব্যাপারে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ দেখে সিন্ধিয়া, হোলকার আর বানশালী পরিবার একাট্টা হয়ে ব্রিটিশদের আক্রমণ করেন। তবে এবার আর জয়ের দেখা মিললো না। ব্রিটিশ কামানের মুখে প্রাচীন মারাঠা দুর্গ গুঁড়িয়ে গেল। সিন্ধিয়া হারালেন রাজস্থান, বুন্দেলাখন্ড, দিল্লি আর আগ্রা। বানশালী হারালেন মেদিনীপুর আর ঊড়িষ্যা। অনুরুপভাবে, হোলকারদের কাছ থেকে অনেক অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হলো। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে না থেকে যার যার নিজের মতো পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ করতে গিয়েই মারাঠা নেতারা এই গোল বাঁধালেন বলা চলে।
মারাঠা শাসকদের সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় তারা পিণ্ডারী নামক মুসলিম ভাড়াটে সৈন্যদের সহায়তা নিতে শুরু করেন। সীমিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই পিন্ডারীরা মূলত দস্যুবৃত্তি করতো। এই পিণ্ডারীদের উৎপাত থামানোর জন্য ব্রিটিশরাজ ১৮১৭ সালে মারাঠাদেরকে তৃতীয়বারের মতো আক্রমণ করে। দৌলত রাও সিন্ধিয়া এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকেন। বাকি মারাঠা শাসকেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। শেষ হয়ে যায় প্রায় ১৫০ বছর ধরে বিস্তৃত একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য।
পেশোয়াকে ৮০,০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে কানপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিন্ধিয়া পরিবার গোয়ালিয়রের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হন। তবে ব্রিটিশদের এই ব্যবস্থা বাকি রাজপরিবারগুলো যে সহজে মেনে নেবে না তা বলাই বাহুল্য। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় ভারতময় ছড়িয়ে থাকা এসব বিক্ষুব্ধ মারাঠা নেতারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
সিপাহী বিপ্লবের প্রথম সারির নেতারা যেমন নানা সাহেব, রাও সাহেব, তাতিয়া টোপী কিংবা রানী লক্ষ্মীবাই; সবাই জাতিতে মারাঠা ছিলেন এবং পেশোয়া ভিত্তিক মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে তারা যুদ্ধে নামেন। মুসলিমদের আর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মারাঠারা বিরাট স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
ফিচার ইমেজ – picsart.com