১৮৭৮ সাল। ব্যাল্টিমোরের বিখ্যাত ফোর্ড’স গ্র্যান্ড অপেরা হাউজ। হল ভর্তি দর্শকের মাঝে তখন পিনপতন নীরবতা। ঝলমলে পোশাক পরিহিতা এক সুশ্রী উঠে এলেন মঞ্চের একেবারে মাঝে, চড়ে বসলেন বিরাট এক কামানের ব্যারেলের মুখে।
পেছন থেকে জাদুকর গর্জে উঠলেন, “আপনি প্রস্তুত?”
“অবশ্যই”, চাপা স্বরে জবাব এলো, “আর দেরি নয়, শুরু করুন!”
মুহূর্তেই কামানের গর্জন। অগ্নিচূর্ণ আর বারুদের স্ফুলিঙ্গে আচ্ছন্ন হলো সমস্ত হলঘর। আর সেই মানবী কামান-গোলার মত উড়ে গিয়ে পঞ্চাশ ফিট দূরে বিছিয়ে রাখা এক জালে আটকে পড়লেন।
করতালি আর আনন্দে ফেটে পড়া দর্শকেরা হয়তো তখনও লক্ষ্য করেননি এই নারীই কিছুক্ষণ আগে একটিমাত্র লাঠির ওপর ভর করে বাতাসে ভেসেছেন, তিনিই এক ছোট্ট বালিকাকে কাঁধে নিয়ে সাইকেলে চড়ে নানা রকম ভয়ংকর কসরত দেখিয়েছেন, আবার তিনি নিজেই বর্ণিল সাজে সেজে তখনকার দিনের বিখ্যাত ‘বার্লেস্ক’ নেচেছেন এমনভাবে যেন মনে হচ্ছিল আগুনের হল্কা সর্পিলাকারে মঞ্চ মাতিয়ে চলেছে।
পর্দা নেমে এলো। মাথা নামিয়ে দর্শকদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন জাদুকর আলেকজান্ডার হারম্যান, সাথে সেই আশ্চর্য মানবী- জাদুকরের স্ত্রী ও মূল সহযোগী অ্যাডেলেইড হারম্যান।
১৮৯৬ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ‘হারম্যান দ্য গ্রেট’ খ্যাত আলেকজান্ডার হারম্যান মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর অকালপ্রয়াণে আডেলেইড যতটা বিমর্ষ, ঠিক ততটাই দিশেহারা। কারণ মাথার ওপর তখন একদিকে বিরাট ঋণের বোঝা, অন্যদিকে হারম্যানের জাদুবিদ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষাই জন্ম দিল নতুন এক আডেলেইডের, যিনি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন কুইন অভ ম্যাজিক বা ‘জাদুবিদ্যার রানী’।
কেমন ছিল অ্যাডেলেইডের প্রথম জীবন?
অ্যাডেলেইড স্কারসিয়ার জন্ম ১৯৫৩ সালে, লন্ডনে। তার পিতা মূলত ছিলেন বেলজিয়ামের নাগরিক, যিনি পরবর্তীতে পরিবারসহ লন্ডনের অভিবাসী হন। পিকাডিলি স্ট্রিটের বিখ্যাত Egyptian Hall এর অন্যতম একজন নির্মাতা ছিলেন অ্যাডেলেইডের পিতা।
ভিক্টোরিয়ান যুগের মধ্যভাগে বড় হওয়া অ্যাডেলেইড ছোটবেলা থেকেই হতে চেয়েছিলেন পেশাদার নাচিয়ে। পড়াশোনা করেছেন নাচ আর ব্যায়ামবিদ্যা নিয়ে। অ্যাডেলেইড কখনই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পিতার ছত্রছায়ায় থাকতে চাননি। তাই ১৮৬৮ সালে ‘ব্যালে’ নাচিয়ে হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কে আসেন।
তখনকার সময়ে ব্যালে ছিল বেশ প্রতিযোগিতামূলক, সেখানে নাম করা কোনো চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। তাই শুরুতে অ্যাডেলেইড ‘কিরালফি পরিবারের নাচিয়ে দলে’র সাথে যুক্ত হন। ‘কিরালফি পরিবার’ তখন ‘বার্লেস্ক’ আর ‘স্পেক্ট্যাকল’ নাচিয়ে দল হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকায় বেশ নাম করেছে। অ্যাডেলেইড নাচের পাশাপাশি অল্প সময়ের মাঝে শিখে নিলেন সেই সময়কার বাইসাইকেল চালানোর বিদ্যা, আয়ত্তে আনলেন তাতে চড়ে নানারকম কসরত দেখানোর কৌশল। পরবর্তীতে তাকে প্রফেসর ব্রাউনের বাইসাইকেল-দলের প্রদর্শনীতেও অংশ নিতে দেখা গেছে।
প্রণয়ের শুরু
নিউ ইয়র্কে আসার আগেও ফরাসি জাদুকর আলেকজান্ডার হারম্যানের সাথে অ্যাডেলেইডের একবার দেখা হয়েছিল। সেই Egyptian Hall-এই এক সন্ধ্যায় মঞ্চ মাতাতে এসেছিলেন জাদুকর হারম্যান দ্য গ্রেট। জাদুকৌশলের অংশ হিসেবে দর্শকসারি থেকে যেকোনো এক নারীর আংটি চাইলেন। কী জানি কী মনে করে অ্যাডেলেইড নিজের হাতের আংটি খুলে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন জাদুকরের দিকে। মুহূর্তেই সাধের আংটিখানা জাদুকরের হাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু অবাক করে দিয়ে সেই আংটি আবার তারই কাছে ফিরে এলো এক ঘুঘু পাখির গলায় বাঁধা ফিতার আড়াল থেকে।
সাহেবী টুপি আর স্যুট পরিহিত রাশভারী গোঁফওয়ালা আলেকজান্ডারকে সেদিন বেশ মনে ধরেছিল অ্যাডেলেইডের।
বেশ ক’বছর পর ১৮৭৪ সালে সমুদ্রপথে লিভারপুল থেকে নিউ ইয়র্কে আসার সময় অ্যাডেলেইড একই জাহাজে আলেকজান্ডারকে আবিষ্কার করেন। প্রণয়ের শুরু সেখানেই।
সুতনু, মার্জিত, কমনীয় স্বভাবের অ্যাডেলেইডকে আলেকজান্ডার নিজের কাজের সাথে যুক্ত করে নিলেন। প্রথমদিকে অ্যাডেলেইড পুরুষের বেশভূষা নিয়েই মঞ্চে হাজির হতেন আর হারম্যানকে জাদুবিদ্যার সাজ-সরঞ্জাম এগিয়ে দিতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের আগ্রহ আর একাগ্রতায় অ্যাডেলেইড রপ্ত করতে থাকেন জাদুবিদ্যার বিচিত্র সব কৌশল।
প্রায় এক বছর পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন দুজন। নিউ ইয়র্কের তৎকালীন মেয়র তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানেও জাদুবিদ্যায় মেয়রকে ভড়কে দিতে ভোলেননি হারম্যান দ্য গ্রেট। জনসম্মুখে বলে বসলেন, “এই বিয়ের কোনো খরচ আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।” এরপর হঠাৎ মেয়রের পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনলেন অনুষ্ঠানের যাবতীয় বিলের কাগজ আর এক ফুঁতে সেসব অদৃশ্য করে দিলেন! পরে অবশ্য বিল পরিশোধে কোনো কার্পণ্য করেননি হারম্যান।
কেমন ছিল হারম্যান দম্পতির জাদুবিদ্যা?
একদিনের ঘটনা। আলেকজান্ডার দর্শকসারি থেকে ছয়টি গিঁটযুক্ত একটি রুমাল তুলে নিলেন। হঠাৎ অ্যাডেলেইডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই কৌশলটি আমার সহযোগী হারম্যান করে দেখাবেন।”
অ্যাডেলেইড এর আগে কখনো মঞ্চে সরাসরি জাদুবিদ্যা দেখাননি। একছুটে পালিয়ে গেলেন মঞ্চের পেছনে। কিন্তু পরক্ষণেই মঞ্চে প্রবেশ করে রুমালটি তুলে নিলেন। ফুঁ দিয়ে একে একে খুলতে লাগলেন গিঁটগুলো। এরপর আর তাকে থামতে হয়নি। সমান তালে আলেকজান্ডারের সাথে জাদুকৌশলে মোহাবিষ্ট করতে থাকলেন দর্শকদের। কখনো বা অ্যাডেলেইডকে দেখা যেত আলেকজান্ডারের কোনো দ্বৈত চরিত্রে।
কিছু পরে অ্যাডেলেইড পুরুষের বেশ ছেড়ে নারীরূপেই মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করলেন। আর সেই সাথে জাদুবিদ্যার সাথে যুক্ত করলেন তার অসাধারণ নৃত্যকলা। দর্শকের মুগ্ধ দৃষ্টি যখন অ্যাডেলেইডের নাচের ঝংকারে নিবদ্ধ থাকতো, আলেকজান্ডার হয়তো তারই এক ফাঁকে জাদুকৌশল প্রয়োগ করে তাদের চমকে দিতেন। এভাবেই চলছিল জাদুকর-দম্পতির সুখী জীবন।
অ্যাডেলেইড কখনো কখনো রপ্ত করে বসতেন কঠিনতম কোনো কৌশল, যা মঞ্চে প্রদর্শন করতে গেলে আলেকজান্ডারকেও বেশ বেগ পেতে হতো। একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক।
অ্যাডেলেইড এমন একটি কৌশল শেখালেন যেখানে কয়েকটি পানিভর্তি বাটিতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের বালি ঢালা হতো। জাদুকর তখন সেই মিশ্রণে হাত দিয়ে তুলে আনতেন কড়কড়ে শুকনো রঙিন বালি! কিন্তু একবার ভরা হলঘরে আলেকজান্ডার ব্যর্থ হলেন, বাটিতে হাত দিয়ে তুলে আনলেন পানি-বালির থকথকে মিশ্রণ, কী লজ্জা! সেই থেকে আলেকজান্ডার পারতপক্ষে অ্যাডেলেইডের রপ্ত করা কৌশলগুলো ব্যবহার করতেন না।
এই দম্পতির জাদুবিদ্যার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘স্লেইভ গার্ল’স ড্রিম’ নামক একটি কৌশল। অ্যাডেলেইড শুভ্র-সফেদ গাউন পরে একটি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ঘুমানোর ভান করতেন। আলেকজান্ডার টুলটি সরিয়ে নিয়ে চারটি লাঠির সাহায্যে বিভিন্ন ভঙ্গিতে অ্যাডেলেইডকে সরাতে থাকতেন যতক্ষণ না পর্যন্ত অ্যাডেলেইড পুরোপুরি বাতাসে ভেসে থাকা শুরু করেন।
‘হারম্যান দ্য গ্রেট’ শো’তে আরেকটি ভয়ংকর বিভ্রম বেশ জনপ্রিয় ছিল, যেখানে অ্যাডেলেইডকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য মঞ্চে ধরে আনা হতো। তিনি চিৎকার করে বাঁচতে চাইতেন, তবু তাকে ছুঁড়ে ফেলা হতো সামনে প্রস্তুত করে রাখা চিতায়। এরপর আলেকজান্ডার আগুন ধরিয়ে দিতেন। দেখা যেত অ্যাডেলেইড পুড়ে যাচ্ছেন, পড়ে রইতো শুধু তার কঙ্কাল। পরের দৃশ্যেই দেখা যেত অ্যাডেলেইড ফিরে এসেছেন, ভৌতিক আলোকসজ্জা আর অদ্ভুত মায়া-বিভ্রমে শাস্তি দিচ্ছেন আলেকজান্ডারকে।
আত্মিকবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ভিক্টোরিয়ান যুগে আত্মিকবাদ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সাধু বা সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে একদল প্রতারক দাবী করতেন যে তারা মৃত মানুষের আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। এদের মধ্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন অ্যান-ও-ডেলিয়া-ডিস-ডেবার। তিনি দাবী করতেন তার ওপর মৃত চিত্রশিল্পীদের আত্মা ভর করে, আর তিনি তাদেরই হয়ে ছবি আঁকেন। সেই সব ছবি বিক্রি করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অংকের টাকা।
হারম্যান দম্পতি এক সন্ধ্যায় মঞ্চে আয়োজন করে দেখালেন কীভাবে মায়া-ভ্রম সৃষ্টি করে মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে। এই দম্পতিসহ আরও বেশ কিছু জাদুকরের চেষ্টায় ডিস-ডেবারসহ আরো বেশ কয়েকজন প্রতারকদের কারাগারে পাঠানো সম্ভব হয়।
আলেকজান্ডারের মৃত্যু
হারম্যান দম্পতি তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে থাকলেন। একদিকে বাড়তে থাকলো জাদুবিদ্যার প্রসার, অন্যদিকে নতুন নতুন কৌশলের জন্য দরকার পড়তে লাগলো বাড়তি লোকবল। কুইন্সের হোয়াইটস্টোনে তারা একটি বাড়ি কিনলেন, প্রদর্শনীকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে কিনলেন একটি বাষ্পচালিত প্রমোদ-তরী, কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি, একপাল জীবজন্তু আর একটি রেল-কোচ। আর সাথে প্রায় ষোলজন কর্মচারীর বেতন-ভাতা মিলিয়ে ব্যক্তিগত ঋণের পাল্লা তখন বেশ ভারী।
এর মাঝে ধরা পড়ল অতিরিক্ত ধূমপান আর তামাক সেবনের ফলে আলেকজান্ডারের হৃদযন্ত্র প্রায় বিকল হতে বসেছে। অ্যাডেলেইড বুঝতে পারলেন সুখের দিন বোধহয় ফুরাতে চলেছে। তবুও তারা থামিয়ে রাখেননি জাদুচর্চা আর প্রদর্শনী।
এমনই এক প্রদর্শনী শেষে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার পর আলেকজান্ডার অ্যাডেলেইডকে বললেন, “আমাদের উচিত এই প্রাণবন্ত সময়গুলোকে পুরোপুরি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা। কে জানে, আমি মরে যাওয়া মাত্রই হয়তো মানুষ আমাদের ভুলে যাবে!”
এর পরদিন সকালেই আলেকজান্ডার ধরাধাম ত্যাগ করেন।
আলেকজান্ডারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে শত শত লোক জড় হয়েছিল, কিন্তু দিনশেষে একাকী অ্যাডেলেইড বুঝলেন তার দিকেই চেয়ে আছে সব পাওনাদার, কর্মচারী, এমনকি সেসব জন্তুর পাল।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরপরই অ্যাডেলেইডের কাছে ‘হারম্যান দ্য গ্রেট’ শো’টি চড়া দামে বিক্রি করে দেবার প্রস্তাব এলো। কিন্তু অ্যাডেলেইড বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন হারম্যানকে। আলেকজান্ডারের সাথে দৈহিক গড়নে মিল থাকায় ভাইপো লিওন হারম্যানকে রাজি করালেন প্রদর্শনীর হাল ধরতে, তাকে শেখাতে লাগলেন জাদুবিদ্যা। কিন্তু ব্যক্তিগত সংঘাত আর লিওনের উদ্ধত আচরণে তিনটি প্রদর্শনীর পরই অ্যাডেলেইড সে যাত্রায় ইস্তফা দিলেন।
তবে একলা চলো রে!
১৮৯৭ সালের এক সন্ধ্যা।
আলেকজান্ডারের পোশাকে মঞ্চে তখন অ্যাডেলেইড হারম্যান। তিনি জানতেন, সহকর্মীর ভূমিকা পালন করা হয়তো সহজ; কিন্তু নারী হিসেবে প্রধান জাদুকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলে নিজেকে আগে প্রমাণ করতে হবে। তাই জীবনের বেশিরভাগ সময় যে কৌশলটি প্রয়োগ করতে গেলে স্বামীকে বারবার বারণ করতেন, আজ তিনি নিজেই তা বেছে নিলেন।
অ্যাডেলেইডের দিকে ছুটে এলো ছয়-ছয়টি বন্দুকের গুলি। দর্শকেরা আগেই গুলিগুলোতে নির্দিষ্ট চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সবাই দেখল সদ্য ছুঁড়ে দেওয়া উত্তপ্ত গুলিগুলোকে নিমিষেই একে একে দাঁত দিয়ে আটকে ফেলছেন অ্যাডেলেইড।
জাদুর এই কৌশলটির নাম ‘বুলেট ক্যাচ’। কৌশলে এক চুল এদিক ওদিক হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই তখনকার দিনের বেশিরভাগ জাদুকরই এটি এড়িয়ে যেতে চাইতেন। ১৯১৮ সালে এই কৌশলে সামান্য একটু ভুলের কারণে বুলেটের আঘাতে মরতে হয়েছিল চীনা জাদুকর চাং-লিং-সুকে ।
আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি অ্যাডেলেইডকে। পরবর্তী পঁচিশ বছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাদুকরদের তালিকায় তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৮৯৯ সালে ব্রডওয়ে ম্যাগাজিন তাকে সমসাময়িক বিশ্বের একমাত্র নারী জাদুকর হিসেবে আখ্যা দিলে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন,
“নারী-পুরুষের প্রশ্নে নয়, আমি পরিচিত হতে চাই শুধুমাত্র একজন ‘জাদুকর’ হিসেবে।”
দ্য ফ্যান্টম ব্রাইড, দ্য উইচ, সারপেন্টাইন ড্যান্স, লিলি অভ দ্য ওরিয়েন্ট, লা ড্যান্স ডি ভিসুভিয়াস- এগুলো ছিল অ্যাডেলেইডের নিজস্ব উদ্ভাবন। ‘নোয়া’স আর্ক’ ছিল সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয়, দুই শতাধিক পোষা প্রাণী, বিচিত্র সাজ-সরঞ্জাম আর অসংখ্য নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত সেই ‘ভুডেভিল’ ছিল দেখার মতো।
আবারো বিপর্যয়
১৯২৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। আবারো নিঃস্ব হয়ে গেলেন অ্যাডেলেইড।
খবর পেলেন ম্যানহাটনের যে বাড়িতে তিনি প্রদর্শনীর যাবতীয় পশুপাখি এবং সরঞ্জাম রাখতেন, সেখানে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। চোখের সামনে দেখলেন পঞ্চাশ বছর ধরে আলেকজান্ডারের সাথে মিলে অল্প অল্প করে গড়ে তোলা জাদুর প্রাসাদ ধূসর ভস্মতে পরিণত হয়ে গেল; হারিয়ে যেতে দেখলেন বিয়ের রূপালি গাউন থেকে শুরু করে আলেকজান্ডারের সাথে কাটানো দিনগুলোর ছোট ছোট রঙিন সব স্মৃতি।
কিন্তু অ্যাডেলেইডে হারতে শেখেননি। যা কিছু বেঁচে গিয়েছিল সেসব নিয়েই নতুন রূপে হাজির হলেন ‘ম্যাজিক, গ্রেইস অ্যান্ড মিউজিক’ নিয়ে।
১৯২৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুকর হিসেবে পেশায় ইতি টানেন অ্যাডেলেইড। ১৯৩২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী জাদুকর। নিউ ইয়র্কে আলেকজান্ডারের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
জীবনের কঠিনতম দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অ্যাডেলেইড লিখেছেন,
হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে, বেদনার জল চোখে শুকিয়ে যেতে পারে, কিন্তু মঞ্চে ব্যক্তিগত শোক প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই, সেখানে একাগ্রচিত্তে আপনাকে লড়ে যেতে হবে। তবুও মঞ্চ থেকে নেমে এলেই মনে হয়, জীবনের লুকোনো কষ্টগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে অ্যাডেলেইড এযাবতকালীন অনেক জাদুকরের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি সময় ধরে জাদুবিদ্যার মঞ্চে নিজের পারদর্শিতা দেখিয়ে এসেছেন। শেষ জীবনে সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তার জীবনের সমস্ত অর্জন যদি হারিয়ে না যেত, তাহলে তিনি হয়তো কালের গর্ভে এভাবে বিলীন হয়ে যেতেন না। আজও হয়তো মানুষ তার সমসাময়িক বিখ্যাত জাদুকর হ্যারি হুডিনির মতো করেই তাকে স্মরণ করতো।
তবুও মার্গারেট বি. স্টীল রচিত Adelaide Herrmann, Queen of Magic (২০১১) কিংবা মারা রক্লিফ রচিত Anything but Ordinary Addie: The True Story of Adelaide Herrmann, Queen of Magic (২০১৬)– এই বইগুলোর মাঝেই বেঁচে থাকুক দুঃসাহসী এই অ্যাডেলেইড হারম্যান।