ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া অভিযাত্রীদের অভিযানসমূহ

ইতিহাসের কল্যাণে হাজার হাজার বছর ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনা, কীর্তি, মানুষের বড় অবদানগুলোকে খুব সহজেই আমরা জানতে পারি। কিন্তু মাঝে মাঝে ইতিহাসও ভুলে যায় কিছু মানুষের অবদান। এডমন্ড হিলারির মাউন্ট এভারেস্ট জয়, ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার কিংবা ভাস্কো দা গামার ইউরোপ থেকে সমুদ্র পথে ভারতে আসার পিছনে বিশাল এবং রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প রয়েছে যেগুলো ইতিহাসে তাদের নামের সাথে খুব মর্যাদার সাথে স্মরণ করা হয়। কিন্তু এমন আরো অনেক বিখ্যাত অভিযাত্রীদের অভিযানের গল্প আছে যা ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে।

এই লেখায় এমনই কিছু প্রায় হারিয়ে যাওয়া অভিযাত্রীদের অভিযানের গল্প থাকবে।

পেদ্রু কাবরালের ভারত যাত্রা

Bernardelli_-_Monumento_a_Cabral

কাবরাল এর ভাষ্কর্য; Image Source: portugalvisitor.com

প্রাথমিকভাবে জানা যায়, পর্তুগীজ নাবিক পেদ্রু আলভারেস কাবরাল ভাস্কো দা গামার দেখানো পথ ধরে ভারতে এসেছিলেন মসলা নেওয়ার জন্য। পথিমধ্যে প্রথম ইউরোপীয় তিনি হিসেবে ব্রাজিল আবিষ্কার করেন। কিন্তু তার ভারতের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়কার যাত্রা পথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তেমন একটা উল্লেখ নেই।

Desembarque_de_Pedro_Álvares_Cabral_em_Porto_Seguro_em_1500

চিত্রকরের তুলিতে কাবরালের নৌবহর যখন ব্রাজিলের ভূখণ্ডে; Image Source: dailymotion.com

দিনটা ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ৯ তারিখ। কাবরাল পর্তুগালের প্রথম কিং ম্যানুয়েলের আদেশে ১৩টি নৌবহর নিয়ে ভাস্কো দা গামার দেখানো পথ ধরে লিসবন থেকে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ২২ এপ্রিল তার নৌবহর ‘আইল্যান্ড অফ হলিক্রস’ নামের একটি ভূখণ্ডে এসে পৌঁছায়, যাকে আমরা বর্তমানে ব্রাজিল হিসেবে চিনি। সেখানে পৌঁছেই পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের নামে ভূখণ্ডটিকে  পর্তুগালের অধিকার দাবি করেন। যদিও এর প্রায় বত্রিশ বছর পর সেখানে পর্তুগীজ উপনিবেশের গোড়াপত্তন হয়। প্রায় দশ দিন পর ব্রাজিল থেকে তার নৌবহর আবার ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পরে চারটি জাহাজসহ জাহাজগুলোতে অবস্থিত সঙ্গীদের হারান তিনি। সেই বছর সেপ্টেম্বরে কাবরালের নৌবহর ভারতের কালিকটে এসে পৌঁছায়। সেখানে স্থানীয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে  কাবরালের আরো সঙ্গী প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত মাত্র চারটি মসলা ভর্তি জাহাজ নিয়ে সফলভাবে ১৫০১ সালের জানুয়ারিতে পর্তুগালে তিনি পৌঁছান।

অমুসলিম তীর্থযাত্রী হিসেবে  রিচার্ড বার্টনের মক্কা ভ্রমণ

বিশ্বব্যাপী স্যার রিচার্ড বার্টন বিখ্যাত জন স্পেকের সাথে নীল নদের উৎসের খোঁজে আফ্রিকা ভ্রমণের জন্য। ভাষাবিদ্যায় দক্ষতা, মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যায় পারদর্শিতা, ভূগোলবিদ্যায় অসামান্য দখলের কারণে তাকে ‘সকল কাজের কাজী’ সম্বোধন করা হয়। তিনি লেখালেখিও করতেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় পঁচিশটির উপরে ভাষা জানা ছিল তার। আঞ্চলিক ভাষাসহ যার সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশের মতো।

Richard_Francis_Burton_by_Rischgitz,_1864

স্যার রিচার্ড বার্টন; Image Courtesy: Rischgitz/Getty Images

তবে তিনি একটি সম্প্রদায়ের কাছে আরো ভালোভাবে পরিচিত তার মক্কা ভ্রমণের কাহিনীর কারণে। তিনি আফ্রিকা ভ্রমণের আগে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে মক্কায় হজ্ব পালন করেন! আর লক্ষ্যণীয়ভাবে তিনিই প্রথম অমুসলিম যিনি কিনা সফলভাবে মক্কায় তীর্থযাত্রী হিসেবে প্রবেশের সুযোগ পান। যদিও নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকে মুসলিম তীর্থযাত্রী ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। তবে ব্যাপারটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা সে সময় মক্কা ছিল অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ শহর। আর তার ছদ্মবেশ সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গেলে তার বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা ছিলো।

Richardburtonarabicdress

মুসলিম তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে রিচার্ড বার্টন; Image Source: ilab.org

এ যাত্রার আগেও তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে সফলভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যক্রমে তিনি আরবিতে অকপটে কথা বলতে পারতেন। আর ভারতে সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময় ইসলাম সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই শিক্ষা নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিংবদন্তী অনুযায়ী, মুসলিম ছদ্মবেশটাকে আরো বেশি নির্ভরযোগ্য করার জন্য তিনি নিজের খৎনা পর্যন্ত করান! তবুও তার ভ্রমণ অতটা সহজ ছিল না। ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ আর্মি থেকে ছুটির অনুমতি নিয়ে মিশর হয়ে মক্কার দিকে তার ভ্রমণ শুরু হয়। পথিমধ্যে তার দলটি অনেকবার দস্যু দল দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়। এতসব বিপদ সত্ত্বেও বার্টন সফলভাবে হজ্ব সম্পন্ন করেন এবং দেশে ফিরে তার ভ্রমণ নিয়ে বইও লিখেন, যা ঐ সময়ে তাকে ইউরোপের বেশ জনপ্রিয় বানিয়ে দেয়।

জন এইনসওর্থ হর্কসের জনবিরল ভূমির অন্বেষণ

জন হর্কস ছিলেন ১৯ শতকের একজন ইংরেজ কৃষক এবং অভিযাত্রী। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম অভিযাত্রী যিনি অস্ট্রলিয়ার জনশূন্য জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করেন। তার প্রথম অভিযান শুরু হয় ১৮৪০ সালের দিকে। যদিও তিনি তখন ফার্মের জন্য ভালো জায়গার খোঁজে বের হয়েছিলেন। তার ভ্রমণ শুরু হয় অ্যাডিলেইড থেকে, যার শেষ ছিল হাট নদী পর্যন্ত। এর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি পেনওর্থাম নামের একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪২ সালে ব্রিটেনে ফেরার আগে ক্লার ভেলির কাছাকাছি নিজের একটি বিশাল ফার্মও তৈরি করেন।

John_Ainsworth_Horrocks

জন এইনসওর্থ হর্কস; Image Source: collections.slsa.sa.gov.au

কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকতে থাকতে বিরক্ত হর্কস আবার তার অন্বেষণে বের হন এবং অসংখ্য  জনবিরল ভূমি উন্মুক্ত করেন। বর্তমানে অনেক জায়গায় তার নামে বিভিন্ন মাউন্টেন এবং পাসের নামকরণ করা আছে।

১৮৪৬ সালে হর্কস আরেকবার ভ্রমণে বের হন। ঐ ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল টরেন্স লেকের কাছাকাছি কৃষিকাজের জন্য আবাদি জমি খোঁজা। তার এই ভ্রমণে সঙ্গী ছিল আরো পাঁচ জন মানুষ এবং প্রায় অনেকগুলো পশুপাখি, যার মধ্যে একটি উটও ছিল। অস্ট্রেলিয়াতে সে সময়ে উটের কোনো প্রচলন ছিল না। হর্কসই  প্রথম অগ্রগামী যিনি কিনা বিভিন্ন কাজে উটের ব্যবহার তুলে ধরেন। যদিও উটের কারণেই তার মৃত্যু হয়।

জোসেফ থমসনের আফ্রিকা অভিজান

উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ‘স্ক্রামবেল অফ আফ্রিকা’র স্থায়িত্বকালে অধিকাংশ ইউরোপিয়ান শক্তি চাচ্ছিলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যত রকম শক্তি প্রয়োজন তা প্রয়োগ করে আফ্রিকাকে উপনিবেশে পরিণত করবে। ঐ সময়টাতে একজন স্কটিশ জিওলজিস্টের জন্য আফ্রিকা ভ্রমণটা কঠিনই হওয়ার কথা। কিন্তু জোসেফ থমসন এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়েও কোনো প্রকার ঝামেলার সম্মুখীন না হয়ে এবং নিজের দলের কাউকে না হারিয়ে আফ্রিকা অভিযান শেষ করে। থমসন বলতেন, “He who goes slowly goes safely; he who goes safely goes far”

Joseph_Thomson

স্যার জোসেফ থমসন; Image Source: revolvy.com

বেশ লক্ষ্যণীয় যে, থমসন তার আলাদা আলাদা ছয়টি অভিযানে প্রায় পনেরো হাজার মাইল জায়গা উন্মোচন করেন যা তখনকার মানচিত্রে অপ্রকাশিত ছিল। তিনি রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির জন্য কেনিয়া, নাইজেরিয়া এবং মরক্কোর অধিকাংশ জায়গা খুঁজে বের করেন।তার মধ্যে মাউন্ট কিলিমানজারো, তানগানয়িকা লেক উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কেনিয়াতে তার নামে নামকরণ হওয়া একটি ঝর্ণা আছে।

এই অভিযাত্রী তার অভিজান শুরু করেন মাত্র একুশ বছর বয়সে। মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি।

ডেভিড ডগলারের নর্থ আমেরিকার পর্বত অভিযান

ডেভিড ডগলার একজন স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উনিশ শতকের দিকে তার নর্থ আমেরিকা ভ্রমণের সময় তিনি পথিমধ্যে অসংখ্য নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ আবিষ্কার করেন এবং এর প্রায় একশত প্রজাতির উদ্ভিদের সাথে ব্রিটেনবাসীর পরিচয় করিয়ে দেন। তার নামে একটা দেবদারু গাছও রয়েছে। তবে তার এ সকল অর্জনকে ছাড়িয়ে তাকে  আরো বেশি  বিখ্যাত করে তোলে ১৮২৪ সালের নর্থ আমেরিকার পর্বতমালায় অভিযান।

David_Douglass00

ডেভিড ডগলার; Image Source: hgcd.info

১৮২৪ সালে রয়াল হর্টিকালচারাল সোসাইটি তাকে আবার উদ্ভিদ আবিষ্কারের কাজে প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের দিকে অভিযানে পাঠায়। ১৮২৬ সালে বসন্তের সময়ে ডগলার আথাবাসকা পাস হয়ে মাউন্ট ব্রাউন নামের একটি শৃঙ্গ আরোহন করেন এবং নর্থ আমেরিকার প্রথম পর্বত আরোহী হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করেন।

 

The article is written in Bangla language. This is about the forgotten explorers and expeditions in the history.

References:

1) listverse.com/2015/03/30/10-forgotten-explorers-and-their-expeditions/
2) en.wikipedia.org/wiki/Richard_Francis_Burton
3) en.wikipedia.org/wiki/John_Ainsworth_Horrocks
4) en.wikipedia.org/wiki/Joseph_Thomson_(explorer)
5) en.wikipedia.org/wiki/Pedro_%C3%81lvares_Cabral
6) en.wikipedia.org/wiki/David_Douglas_(botanist)

Featured Image: dailymotion.com

Related Articles

Exit mobile version