১.
যদি জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীর সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার কোনটি? তাহলে নোবেল পুরস্কারের কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন। পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য এবং শান্তি এবং অর্থনীতি; এই ছয়টি শাখায় মানব কল্যাণে অবদানের জন্য যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামানুসারে।
১৮৯৬ সালে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করার পর আলফ্রেড নোবেল তার কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি। মৃত্যুর আগে একটি উইলে তিনি তার জীবদ্দশায় উপার্জিত সমস্ত আয় এবং সম্পত্তি নিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করার কথা বলে গিয়েছিলেন। যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্য; এই পাঁচ শাখায় মানবতার স্বার্থে যারা অবদান রাখবে, তাদেরকে এই ট্রাস্ট থেকে পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালে অর্থনীতি যোগ হয়। নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইট অনুসারে, ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মোট ৫৯০ জনকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
বিশ্বের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার অর্জন করা সহজ কোনো কাজ নয়। মাত্র চারজন ব্যক্তি এই পুরস্কারটি দু’বার করে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতি বছর অনেক প্রার্থীই নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। কিন্তু প্রতিটি শাখায় কেবল একজন বা একটি দল এই পুরস্কার প্রাপ্তির হাসি হাসেন। কোনো কোনো প্রার্থী আবার একাধিকবার মনোনয়ন পেয়ে থাকেন, কিন্তু একবারও এই পুরস্কার লাভের হাসি হাসতে পারেন না। আজ যার গল্প বলব, তার নাম আর্নল্ড জোহান্স সমারফেল্ড। তিনি এক-দুই বা তিনবার নয়, ৮৪ জন মনোনয়নকারীর পক্ষ থেকে নোবেল প্রাইজের মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু একবারও বিজয়ের হাসি হাসতে পারেননি!
২.
সমারফেল্ডের জন্ম ১৮৬৮ সালে, জার্মানির পূর্ব প্রুশিয়াতে। তিনি ১৮৯১ সালে কোনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি গ্রহণ করেছিলেন। পিএইচডি গ্রহণের পর তিনি তার দেশের সেবায় প্রায় এক বছরের মতো কাজ করেন। তারপরের ৮ বছর ধরে তিনি কাজ করেছেন সামরিক বাহিনীতে। এরপর ১৮৯৫ সালে, তিনি উচ্চতর গণিতের উপর শিক্ষকতা করার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সমারফেল্ডের প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছিল আরো পরে; ১৮৯৭ সালে যখন তিনি জার্মানির বার্গাক একাডেমির গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। এরপরে তিনি জার্মানির গণিত এনসাইক্লোপেডিয়ার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছিলেন ১৯২৬ সাল পর্যন্ত।
সমারফেল্ড আখেন কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত বলবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময়ে তিনি হাইড্রো ডাইনামিক্স থিওরি আবিষ্কার করেন। ১৯০৬ সালে সমারফিল্ড মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার বহু শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সুনাম কুড়িয়েছেন।
সমারফেল্ড এতবার মনোনীত হয়েও নোবেল জিততে পারেননি, কিন্তু তার বেশ কয়েকজন ছাত্র বিজ্ঞানে অবদান রেখে নোবেল জিতে নিয়েছে। আখেন কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সমারফেল্ডের ছাত্র, পিটার ডিবাই মলিকুলার স্ট্রাকচারের উপর গবেষণার জন্য ১৯৩৬ সালে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমারফেল্ডের ছাত্র ছিলেন হাইজেনবার্গ। হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্স আবিষ্কারের জন্য ১৯৩২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। মিউনিখেরই তার আরেক ছাত্র উলফগ্যাং পাউলি; ‘পাউলির বর্জন নীতি’ আবিষ্কারের জন্য ১৯৫৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, সমারফিল্ডের আরেক ছাত্র হান্স বেথ, স্টেলার নিউক্লিওসিন্থেসিস তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য ১৯৬৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন।
৩.
যুগের পর যুগ সমারফেল্ডের হাত ধরে এতজন গুণী বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন যে, তার এই কৃতিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন রেজোন্যান্স জার্নালে সমারফেল্ড সম্পর্কে বলেছিলেন,
“আমি তার একটা ব্যাপার দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি যে, সে নিরলসভাবে একের পর এক মেধাবী এবং তরুণ প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।”
বিখ্যাত গণিতবিদ মরিস ক্লাইন সমারফেল্ডকে নিয়ে বলেছিলেন,
“সমারফেল্ড আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং তড়িৎচুম্বক তত্ত্বের একজন অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষক এবং বিজ্ঞানের এসব শাখার বিকাশে একজন অগ্রপথিক। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ত্রিশ বছরে তিনি ইতিহাসের বেশ কয়েকজন মহান পদার্থবিজ্ঞানীকে শিক্ষাদান করেছেন।”
গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ম্যাক্স ব্রন বলেন,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ইউরোপীয় অনেক বিজ্ঞানী জার্মানি ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। সমারফেল্ড দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছিলেন, কীভাবে জার্মানি তার উজ্জ্বল এবং মেধাবী সন্তানদের হারাচ্ছে। কিন্তু তিনি দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল হয়ে জার্মানিতেই থেকে গিয়ে তার শিক্ষকতা চালিয়ে গিয়েছিলেন। হিটলার যোগ্যতা বিচার না করেই তার নিজের লোকদেরকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ দেয়া শুরু করেছিলেন। সমারফেল্ডকে বদলি করে, আখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের নতুন অধ্যাপক হিসেবে উইলিয়াম মুলারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যদিও মুলার ছিলেন একজন তথাকথিত অ্যারোডায়নামিক বিশেষজ্ঞ, উক্ত পদে নিয়োগ পাবার জন্য যার যোগ্যতা সমারফেল্ডের ধারেকাছেও ছিল না। তবুও সমারফেল্ড নিজে নিজে যতটুকু পেরেছেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপরে তার কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন।
৪.
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সূত্রমতে, সমারফিল্ড ইংরেজ নাগরিক উইলিয়াম উইলসনের সাথে যৌথভাবে সমারফিল্ড-উইলসন কোয়ান্টাইজেশন সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব, হাইড্রোডায়নামিক্স এবং এক্স-রে তরঙ্গতত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছিলেন। তিনি তরঙ্গ বলবিদ্যা এবং ধাতব পদার্থের ইলেক্ট্রন তত্ত্ব নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করে গেছেন, যা থার্মোইলেক্ট্রিসিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
নোবেল পুরস্কারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের নমিনেশন লিস্টে সমারফেল্ডের নাম মোট ৮৪ বার পাওয়া যায়। তিনি সর্বপ্রথম ১৯১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। এরপর ১৯১৮ সালে একবার, ১৮১৯ ও ১৮২০ সালে দু’বার, ১৯২২ সালে চারবার, ১৯২৩-২৪ সালে আবারও দু’বার করে, ১৯২৫ সালে ছ’বার, ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ সালে প্রতি বছর তিনবার করে, ১৯২৯ সালে ন’বার, ১৯৩০ সালে চারবার, ১৯৩১ সালে দু’বার, ১৯৩২ সালে পাঁচবার, ১৯৩৩ সালে আটবার, ১৯৩৪ ও ১৯৩৫ সালে ছয়বার করে, ১৯৩৬ সালে দু’বার, ১৯৩৭, ১৯৪০ ও ১৯৪৮ সালে আটবার করে, ১৯৪৯ ও ১৯৫০ সালে তিনবার করে এবং সবশেষে ১৯৫১ সালে চারবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
মোট ৮৪ বার তো নিজে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কর্তৃক মনোনীত হয়েছেনই, সমারফেল্ড নিজেও দু’বার নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নকারী ছিলেন। এর মধ্যে একবার ১৯২২ সালে তিনি আলবার্ট আইনস্টাইনকে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত করেছিলেন।
৫.
১৯৫১ সালে, ৮২ বছর বয়সে রাস্তা পার হবার সময়, ট্রাকের ধাক্কায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত হয়ে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন সমারফেল্ড। এর দু’মাস পর ২৬ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি হয়ত নিজে কখনো নোবেল পুরস্কার জিততে পারেনিনি, কিন্তু তার দীক্ষায় দীক্ষিত বহু ছাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়ে প্রমাণ করেছে যে, সমারফিল্ড আদতে একজন নোবেল পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানীদের কারিগর।