প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন অটোমান সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল, তখন মধ্যপ্রাচ্য শাসনের ম্যান্ডেট গিয়ে পড়লো দুই বিজয়ী শক্তি, ফ্রান্স আর গ্রেট ব্রিটেনের হাতে। ফ্রান্স লেবানন এবং সিরিয়া নিল, ব্রিটেন নিল ইরাক। এসব রাষ্ট্রে তারা নিয়মমাফিক তাঁবেদার শাসক ও রাজাও নিয়োগ দিয়েছিলো। মতলবটা ছিল এই যে, তেলসমৃদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে দারুণ গুরুত্ববহ মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
তবে ভাবলেই তো হবে না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ, বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক আর মিশর তখন রাজনৈতিকভাবে দারুণ সচেতন। তারা নিজেদের দেশে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত আরব যুবকেরা গোঁড়া ধর্মমত ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ চায় দেশের নিয়ন্ত্রণ ধর্মনিরপেক্ষ আর সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী দলগুলোর হাতে যাক। তবে এসব চিরচেনা দাবির আড়ালে আরো জাঁকালো একটি দাবি এসব আধুনিক আরবদের মাথায় ঘুরতো, সেটা হলো- মরক্কো থেকে ইরাক, সিরিয়া থেকে ওমান পর্যন্ত একটি একক আরব রাষ্ট্র তৈরি করা। এখন ব্রিটিশ সমর্থনপুষ্ট রাজা আর আমিরের দল এহেন আবদার যে মানবে না তা বলাই বাহুল্য। কাজেই এসব আধুনিক তরুণদের ওপরে চলতো ব্যাপক ধরপাকড়।
১৯৩০ সাল,প্যারিস। মাইকেল আফ্লাক নামের এক সিরীয় খ্রিস্টান ছাত্রের সাথে দেখা হলো সালাহ আল দিন আল বিতর নামের আরেক ছাত্রের। দুজনই সদ্য সমাপ্ত সিরীয় মহাবিদ্রোহ খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯২৫-২৭ সালব্যাপী এই বিদ্রোহে সিরীয় জনগণ প্রবল বিক্ষোভ করে ফরাসী শাসনের বিপক্ষে। আফ্লাক আর সালাহ বুঝলেন, দেশ স্বাধীন হবে কিছুদিনের মধ্যেই। কাজেই সেই স্বাধীন দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সিরিয়ায় ফেরত এলেন। চাকরি নিলেন একটি স্কুলে। এখানেই ১৯৪০ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আরব ইহইয়া মুভমেন্ট’ নামের একটি রাজনৈতিক দল।
ওদিকে প্যারিস ফেরত আরেক বুদ্ধিজীবী জাকি আল আরসুজি ততদিনে ‘আরব বাথ পার্টি’ নামের একটি দল খুলে বসেছেন। তবে জাকি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। ক্রমেই তার দলের লোকেরা মাইকেল আফ্লাকের দলে ভিড়তে থাকলে শেষমেষ তিনিও মাইকেল আফ্লাকের দলে চলে যান। দুই পার্টি মিলে নাম হল ‘আরব বাথ মুভমেন্ট’ বা বাথ পার্টি। আফ্লাক আর সালাহ দলের গঠন ব্যবস্থাটা দেখতেন আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাটা চলতো জাকি আল আরসুজির তত্ত্বাবধানে।
কী এই বাথিজম? এর মানেই বা কী আর এটি দ্বারা কোন রাজনীতি নির্দেশ করা হয়? উত্তর পেতে হলে দেখতে হবে বাথিজম এর অর্থ কী।
বাথ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। এর অর্থ ‘রেনেসাঁ’। সোজা কথায় বাথিজম একটি সংযুক্ত আরব রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করে যেটি হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করবার পাশাপাশি নিজের জনগণের জন্য সোশ্যালিজম কায়েম করাটাই বাথ পার্টির উদ্দেশ্য। অবশ্য বাথ পার্টিকে কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, কারণ বাথিস্টরা আবার সোভিয়েত বা চীনা ধাঁচের সমাজতন্ত্র পছন্দ করে না। কাজেই বাথিস্ট চিন্তাভাবনা আরবি তথা ইসলামী ধাঁচে মোড়ানো থাকবে, এই ছিল এই মতবাদের মোদ্দাকথা। তিন মূর্তিতে বাথ পার্টি গঠন করলো। আপাতত এর দুটো শাখা থাকলো। একটি সিরিয়ায় এবং আরেকটি ইরাকে।
ক্ষমতা দখল
১৯৫৪ এর নির্বাচনে বাথ পার্টি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে মাঠে নামলো সিরিয়ায়। এদিকে কম্যুনিস্ট পার্টিরও তখন রমরমা অবস্থা। এই দুই দলের চাপে আর মিশরের গামাল আব্দেল নাসেরের ইচ্ছায় ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা হল ‘সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র’। মিশর, ইয়েমেন আর সিরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত এই কিম্ভুত রাষ্ট্রটি বেশিদিন টেকেনি, ১৯৬১ সালে সিরীয় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং সংযুক্ত আরব যুক্তরাষ্ট্রের আয়ত্ত থেকে বেরিয়ে যায়।
সিরীয় সেনাবাহিনী বহুদিন ধরেই বাথ পার্টির নিয়ন্ত্রণ কব্জা করছিলো। ওদিকে ১৯৬১ এর অভ্যুত্থানের পর সিরীয় সেনারা দেশের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন পুতুল সরকারের হাতে। তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলো না। দলাদলি আর অসন্তোষের জের ধরে দেশের তরুণ আর্মি অফিসারেরা এবারে সরাসরি ক্ষমতা দখল করলেন ১৯৬৩ সালে। বাথ পার্টি এই ‘৮ই মার্চের বিপ্লবে‘ পুরোদমে অংশ নিয়েছিলো।
আরবদের মধ্যে দলাদলিটা বড্ড বেশি। বাথ পার্টির দুটি ভাগ ছিল। একদলের সব নেতারা সামরিক বাহিনীর। আরেক দলের নেতারা সিভিলিয়ান মাইকেল আফ্লাক, সালাহ বিতর প্রমূখ। এই দুই ভাগের মধ্যে হরদম রেষারেষি চলতো। এরই জের ধরে ১৯৬৬ সালে ঘটলো আরেক দফা অভ্যুত্থান। আফ্লাক সহ সকল সিভিলিয়ান নেতারা পালিয়ে গেলেন ইরাকে। ফলে বাথ পার্টি সম্পূর্ণ আলাদা দুই ভাগ হয়ে গেলো।
ইরাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরো জটিল। ব্রিটিশ পুতুল, হাশেমাইট রাজাদের তাড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার আল কাসিম ক্ষমতা দখল করেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৩ সালে কাশিমকে বাথ পার্টির সদস্যরা খুন করে দেশের মূল ক্ষমতা হস্তগত করে। জেনারেল আহমেদ আল বকর দেশের ক্ষমতা ধরলেন শক্ত হাতে।
শাসনকাল
সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার ঝামেলাটা সিরীয় বাথ পার্টির সদস্যরা টের পেলেন কিছুদিনের মধ্যেই। ১৯৬৬ সালে ক্ষমতায় এসে জেনারেল সালাহ জাদিদ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণায় বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। একটি সংযুক্ত আরব রাষ্ট্র গঠনের বিশেষ খায়েশও তার মাঝে দেখা গেল না। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে সিরীয় বিমানবাহিনীর এক পাইলট, জেনারেল হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতা দখল করলেন।
হাফিজ আল আসাদও বাথ পার্টিরই সদস্য ছিলেন। মৃদুভাষী হাফিজ শক্ত হাতে ৩০ বছর ধরে সিরিয়া শাসন করেন। তিনি সিরিয়াকে ক্রমেই মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে নিতে থাকেন। নিজের গোত্র আলাওয়াতিদের হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ এনে দেন। গোটা দেশে নিজের ধ্যান ধারণা আর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা প্রচার করার পাশাপাশি নিজের ক্ষমতাও অনেক বাড়িয়ে নেন। ১৯৭৬-৮২ সাল ব্যাপী হামা অভ্যুত্থান দমন করে তিনি খ্যাতিচ্যুত হন। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়।
হাফিজ আল আসাদের কনিষ্ঠ ছেলে বাশার আল আসাদ প্রায় ১৮ বছর ধরে সিরিয়ায় ক্ষমতায় আছেন। তিনিও বাবার অনুসৃত পথ ধরেই দেশ চালাচ্ছেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের জের ধরে সিরিয়ার বিক্ষোভ শুরু হয়। ক্রমে তা রুপ নেয় গৃহযুদ্ধে। রাশিয়া আর ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাশার আল আসাদ বর্তমানে নিজের ক্ষমতা অনেকটা সংহত করে নিয়েছেন। সিরিয়ার মূল ভূখন্ডের ৫৭ শতাংশ এখন বাশার আল আসাদের নিয়ন্ত্রণে। অধিকাংশ জনগণও তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় রয়েছে।
ইরাকি বাথ পার্টির ভাগ্য বেশ রক্তক্ষয়ী। জেনারেল আহমদ আল বকরকে তাড়িয়ে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় আসেন সাদ্দাম হোসেন। শুরুর দিকে তিনি বেশ সুশাসকই ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ নেতা কি দেশ শাসন করে তৃপ্ত থাকতে পারেন? কুর্দিদের বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভিযান, গ্যাস হামলা, ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮), উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং গোটা নব্বই এর দশক জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় চালান এই নেতা। স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত দুই পক্ষের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে পারলেও পরবর্তীতে তিনি অনেক একঘরে হয়ে পড়েন। ২০০৩ সালে মার্কিন অভিযানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। বিচারে তার ফাঁসি হয়। ইরাকে বাথ পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাদ্দামের অনুগত ইজ্জত ইব্রাহিম আল দৌরি বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ড বাথ সদস্যদের নেতা।
১৯৬৬ সালে যেসব সিভিলিয়ান সিরীয় নেতা পালিয়ে ইরাকে এসেছিলেন তাদের অনেককেই ইরাকি বাথ পার্টিতে উচ্চপদে আসন দেওয়া হয়েছে। মাইকেল আফ্লাক হন সেক্রেটারি জেনারেল। তবে প্রায় সব পদই ছিল নাম মাত্র। আদতে ক্ষমতা পুরোটাই ছিল সাদ্দাম হোসেনের হাতে। ১৯৮৯ সালে মাইকেল আফ্লাকের মৃত্যু হয়।
এসব ছাড়াও লেবানন, লিবিয়া, কুয়েত, সৌদি আরব, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় বাথ পার্টির আঞ্চলিক শাখা খোলা হয়েছিল। ইরাকি আর সিরীয় বাথ পার্টির বিভাজনের সাথে সাথে এদের মধ্যেও নানা দল-উপদল সৃষ্টি হয় বিধায় সামষ্টিক শক্তি হিসেবে এই শাখাগুলো তেমন সাফল্য পায়নি।
পরিশেষে
বাথ পার্টি আদতে কতটা সফল সেটা ইতিহাস বিবেচনা করবে। আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, তারা ক্ষমতা দখল করেছে দুটি দেশে- ইরাক ও সিরিয়ায়। ইরাকে শাসন করেছে ৩৫ বছর আর সিরিয়ায় তারা সেই ১৯৬৬ সাল থেকে গদিতে। তবে দুই ক্ষেত্রেই দলের নিয়ন্ত্রণ সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদদের হাত থেকে চলে গিয়েছে সেনা শাসকদের হাতে। দেশ দুটির ইতিহাস তাই একের পর এক যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সংকটের কালিমায় ঠাসা। একটি বিপুল, সংযুক্ত আরব রাষ্ট্র গঠনের চেয়ে একে অপরের পিঠে ছুরি মারার মতলব করেই কাটিয়ে দিয়েছে সরকারগুলো। সিরিয়া আর ইরাকের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছিলো যে, ২০০৩ সালের মার্কিন আগ্রাসনের সময়ও সিরিয়া সাদ্দামের পাশে দাঁড়ায়নি।
তবে একটি কৃতিত্ব বাথ পার্টির নেতাদেরকে না দিলেই নয়। নানা জাতি উপজাতিতে ঠাসা দুটি রাষ্ট্রকে তারা অনেকাংশেই সামলে রাখতে পেরেছিল এই পার্টি। আজকের ইরাকের বিশৃংখল অবস্থার দিকে তাকালেই বাথিস্ট শাসনের শক্তি সম্বন্ধে একটু আঁচ করা যাবে। পাশাপাশি অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় বাথিস্ট রাষ্ট্রগুলো ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনায় অনেকটা অগ্রসর। নারী শিক্ষা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সহ অনেক ক্ষেত্রেই বাথিস্ট সরকারের সাফল্য উপেক্ষা করা অসম্ভব। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এর দিকেও বাথিস্টদের বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়। তবে যে স্বপ্ন দেখে মাইকেল আফ্লাক এবং তার অনুসারীরা বাথ পার্টি গঠন করেছিলেন তা সাকার হওয়ার সম্ভাবনা আজ অনেকটাই শূন্য। সংঘবদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ আরব রাষ্ট্র গঠন হওয়ার মতো পরিস্থিতি আজ আর মধ্যপ্রাচ্যে নেই বললেই চলে।
ফিচার ইমেজ: wikimedia commons