১
জালাল খান, রাজা মানসিংহ, ভগবান দাস আর টোডর মলের নেতৃত্বে একে একে প্রেরিত সম্রাট আকবরের সবগুলো কূটনৈতিক মিশনই যখন ব্যর্থ হলো, তখন যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। যুদ্ধের জন্য মুঘল সেনাবাহিনী আর রানা প্রতাপ সিংহের সিসোদিয়া রাজপুত বাহিনী- দুই পক্ষই সেনা-সমাবেশ শুরু করল।
আকবরের নির্দেশে মেবারের পূর্বদিকের শহর মণ্ডলগড়ে মুঘল সৈন্যরা রাজা মানসিংহের নেতৃত্বে সমবেত হওয়া শুরু করলেন। অন্যদিকে রাজপুতরা ঘাঁটি গেড়ে অপেক্ষা করছিলেন আরাবালি পাহাড়ের ঢালের হলদিঘাঁটি গিরিপথের কাছাকাছি। ১৫৭৬ সালের জুনের মাঝামাঝির দিকেই মুঘল সৈন্যরা মণ্ডলগড় থেকে সেনাছাউনি তুলে হলদিঘাঁটিতে এসে ছাউনি ফেললেন।
মুঘলদের এই সেনাবাহিনী এক কথায় ছিল একটি বহুজাতিক সেনাবাহিনী। উজবেক, তুর্কি, কাজাখ যোদ্ধা থেকে শুরু করে এই বাহিনীতে রাজপুত আর সাধারণ হিন্দু যোদ্ধারাও ছিলেন। হলদিঘাঁটির এ যুদ্ধে অংশ নেয়া মুঘল সৈন্যের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজারের মাঝামাঝি। যদিও বাদাউনি স্পষ্ট ভাবেই মুঘল সৈন্যদের সংখ্যা দশ হাজার বলেছেন।
অন্যদিকে, রাজপুত সেনাবাহিনীতে তিন হাজার অশ্বারোহী সৈন্যসহ, আফগান আর ভিল উপজাতির কিছু তীরন্দাজসহ মোট পাঁচ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যক সৈন্য ছিলেন। বাদাউনির সূত্রমতে, রাজপুত বাহিনীতে তিন হাজার জনই ছিলেন অশ্বারোহী যোদ্ধা, আর ৪০০ জন ভিল উপজাতির তীরন্দাজ। এছাড়াও আফগান সৈন্য আর পদাতিক সৈন্য ছিলেন রাজপুত বাহিনীতে, যাদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
যা-ই হোক, যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান নিয়েই দুই বাহিনী সৈন্য-বিন্যাসে ব্যস্ত হয়ে গেল। অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে দুটি বাহিনী মোতায়েন করে মুঘল সেনাবাহিনীর মূল অংশের কমান্ডে থাকলেন রাজা মানসিংহ স্বয়ং নিজে। দুটি অগ্রবর্তী বাহিনীর একটির কমান্ডে রইলেন সৈয়দ হাশিম বারহা, অন্যটির নেতৃত্বে রইলেন আসফ খান আর জগন্নাথ কাচবাহা। মুঘল সেনাবাহিনীর বাম বাহুর কমান্ডে রইলেন বাদাখশানের মোল্লা কাজী খান বকশি।
বাদাখশানিরা ছাড়াও এই বাহিনীতে রাজপুত যোদ্ধা আর শেখজাদারা ছিলেন। আর ডানবাহুর নেতৃত্বে ছিলেন বারহার সৈয়দরা। বাহিনীর পেছনদিকে মেহতার খানকে মোতায়েন করা হলো। মধুসিং কাচবাহার কমান্ডের পেছনে একটি রিজার্ভ ফোর্সও রাখা হলো।
অন্যদিকে, রানা প্রতাপ নিজ বাহিনীকে মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করে নিজে মূল বাহিনীর কমান্ডে থাকলেন। রাজপুত বাহিনীর ডানবাহুর কমান্ডে রইলেন বামা শাহ আর গোয়ালিয়রের রাজা রাম সিং তানবার। ঝালা সৈন্যদের দিয়ে গঠিত বাম বাহুর কমান্ড পেলেন ঝালা মানসিং। অগ্রবর্তী বাহিনীর কমান্ডে থাকলেন হাকিম খান সুরি, জয়মল রাঠোরের পুত্র রাম দাস রাঠোর আর ভিম সিং দাহিয়া। সবার পেছনে রাও পুঞ্জি রইলেন রিজার্ভ ফোর্সের কমান্ডে।
২
যুদ্ধের তৎপরতা শুরু হয় ১৮ জুন ভোরের দিকেই (কোনো কোনো সূত্রমতে যুদ্ধটি ২১ জুন শুরু হয়েছিল)। শুরুতেই হাকিম খান সুরি, রাম দাস রাঠোর সরাসরি হামলা চালালেন মুঘল সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী বাহিনীর বাম ইউনিটের ওপরে। রাজপুতদের এই বাহিনীটিই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী ছিল। বলতে গেলে অগ্রবর্তী এই বাহিনীটিকেই প্রতাপ সিংহ ‘গেম চেঞ্জার’ বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
হলোও তাই। রাজপুত অগ্রবর্তী বাহিনীটি মুঘল সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী বাহিনীর বাম অংশকে মোটামুটি বিধ্বস্ত করে তাণ্ডব চালাতে এগিয়ে গেল ডান ইউনিটের দিকে। রাজপুতদের আক্রমণের প্রাথমিক ঝড়টুকু ঠেকাতে ব্যর্থ হলো ডান ইউনিটটিও। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, হাকিম খান সুরি আর রাম দাস রাঠোর মুঘল সেনাবাহিনীর পুরো অগ্রবর্তী বাহিনীকে ভেদ করে মূল যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকে পড়লেন।
রাজপুতদের অগ্রবর্তী বাহিনী যখন মুঘল অগ্রবর্তী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন একই সময়ে আক্রমণ চালানো হলো মুঘল সেনাবাহিনীর বামবাহুটির উপর। এই বাহুটিও বিপর্যস্ত হলো। যদিও এই দুইটি খণ্ডযুদ্ধে রাজপুতদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল ছিল, কিন্তু তার জন্য তাদের রক্তও ঝরাতে হয়েছিল প্রচুর।
এদিকে রাজপুত বামবাহুর ঝালারা ঝাঁপিয়ে পড়ল মুঘল সেনাবাহিনীর ডানবাহুর উপরে। বারহার সৈয়দদের দুর্ধর্ষ সাহসিকতায় ডানবাহু ঝালাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হলো।
বামবাহু আর অগ্রবর্তী ইউনিটের বিপর্যয় দেখে পেছন থেকে মেহতার খানকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বাম দিকের নিরাপত্তায় মোতায়েন করে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন রাজা মানসিংহ। একই সময়ে প্রতাপ সিংহও তার পুরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে এসে মুখোমুখি হলেন রাজা মান সিংহের। প্রচণ্ড মুখোমুখি যুদ্ধ হলো দুই বাহিনীর মধ্যে। বিপুল সংখ্যক রাজপুত নিহত হলো এই যুদ্ধে। রানা প্রতাপ সিংহ এবার প্রমাদ গুনতে লাগলেন।
৩
যুদ্ধক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখতে রানা প্রতাপ এবার বাহিনীর সাথে আনা হাতি দুটি সামনে ঠেলে দিলেন। বেশ কিছু মুঘল সৈন্যের প্রাণ নেওয়ার পর একটি হাতির মাহুত গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাতিটি রাজপুতদের দিকেই পালিয়ে গেল। অন্য হাতিটিকে মুঘল সেনাবাহিনীর একজন মাহুত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। রানা প্রতাপ সিংহের এই চেষ্টাটিও ব্যর্থ হলো।
রাজপুত বাহিনীর হাতি ব্যবহারের মাধ্যমে খেলায় ফিরে আসার চেষ্টাটি ব্যর্থ হলে রাজপুতরা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় মুঘলরাও মরিয়া হয়ে লড়তে থাকে। কেউ কাউকে একটুও ছাড় দিতে রাজি নয়।
এদিকে ভয়াবহ এই লড়াইয়ে রাজপুতদের সবগুলো ইউনিটই একে একে বিক্ষিপ্ত হতে শুরু করল। এসময় থেকে রাজপুতদের পরাজয় স্পষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ যুদ্ধের এ পর্যায়ে রানা প্রতাপ সিংহ আহত হলেন।
ঝালা মানসিং বুঝতে পারলেন পিছুটান দেওয়ার সময় হয়েছে। বেঁচে থাকলে আবার যুদ্ধ করা যাবে; কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রানা প্রতাপ সিংহকে বাঁচাতে হবে। প্রতাপ সিংহ এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরলে রাজপুতদের একটু হলেও আশা থাকবে।
তিনি দ্রুত রানাকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে এলেন। এরপর রানার পোশাকেই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গেলেন, যাতে মনে হয় রানা এখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই আছেন। তিনি এই কাজটি করলেন, যাতে আহত রানা যতটা সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারেন।
৪
প্রাথমিকভাবে ঝালা মানসিংহের এই কৌশল কাজে দিল। ঝালা মানসিংহকে প্রতাপ সিংহ মনে করে সবগুলো মুঘল ইউনিট তাকে ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেলো, প্রতাপ সিংহ আসলে যুদ্ধক্ষেত্রেই নেই; আহত হয়ে অনেক আগেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছেন!
একই সময়ে রাজপুত সৈন্যরাও বিষয়টি টের পায়। মুহূর্তেই রাজপুতদের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গেল। ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ রাজপুত সৈন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছে। যারা বেঁচে ছিলেন, এবার তারাও ধীরে ধীরে পালাতে শুরু করলেন। রাজপুত যোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিতে ভিল উপজাতির তীরন্দাজেরা মুঘল সৈন্যদের ওপর বৃষ্টির মতো তীরবর্ষণ শুরু করল।
এদিকে রাজপুতরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালানো শুরু করলেও মুঘল সেনাবাহিনী শেষপর্যন্ত আর তাদের তাড়া করল না। টানা তিনঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধের প্রভাবে পুরো রাজকীয় বাহিনী ভীষণ রকমের ক্লান্ত ছিল। তাছাড়া মুঘল জেনারেলরা রাজপুতদের ধাওয়া করতে গিয়ে সেনাবাহিনী বিক্ষিপ্ত করতে চাইছিলেন না। তবে পালিয়ে যাওয়া রাজপুতরা আবার জড়ো হয়ে রাতে আক্রমণ করতে পারে- এই আশঙ্কায় সারা রাতই পুরো সেনাবাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হলো।
৫
হলদিঘাঁটির এ যুদ্ধে রানা তার প্রায় অর্ধেক শক্তি হারিয়ে পিছু হটলেন। অন্যদিকে, প্রায় ৫০০ রাজপুত সৈন্যসহ আরো মুসলিম আর সাধারণ হিন্দু মিলে মোট ৭০০ সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে মুঘল সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
হলদিঘাঁটির এ যুদ্ধটি কৌশলগত দিক দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের শোচনীয় পরাজয়ের পর রাজপুতদের মধ্যে সিসোদিয়া গোত্রটির একাংশ রানা প্রতাপের নেতৃত্বে আবার এ যুদ্ধেই সরাসরি মুঘল সাম্রাজ্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। মুঘল সেনাবাহিনীর জয়ে তাদের শেষ সম্ভাবনাটুকুও বাতাসে মিলিয়ে যায়।
যা-ই হোক, পরেরদিন সকালে রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী গোগুন্দায় পা রাখেন। কিন্তু শহরটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসে প্রতাপ সিংহ দ্রুত পুরো শহর খালি করে ফেলেছিলেন।
রসদ সংকটে পড়ার আশঙ্কায় শহরে রক্ষায় অল্প কিছু সৈন্য মোতায়েন করে মানসিংহ গোগুন্দা থেকে পিছু হটে আজমিরের দিকে যাত্রা করলেন। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি আজমিরে গিয়ে সম্রাট আকবরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজপুতদের পরাজিত করায় তিনি মানসিংহের প্রশংসা করেন; একই সাথে রানাকে ধরতে না পারায় ভর্ৎসনাও করেন।
আকবর এবার নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ে গোগুন্দায় এসে ছাউনি ফেলেন। আশেপাশের যতটুকু এলাকা মুঘল অধিকারে আনা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর নিরাপত্তায় বিভিন্ন জায়গায় সেনাঘাঁটি করেন। এরপর ইদার, সিরোহী আর ঝালরসহ রানা প্রতাপের মিত্র রাজাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান প্রেরণ করেন।
এদিকে রানা নিজে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন আরাবালি পাহাড়ের গভীরে। রানাকে আর পাহাড় থেকে টেনে বের করা যম্ভব হয়নি। আকবর নভেম্বরের শেষের দিকে মেবার থেকে ফিরে এলেন। আকবরের মেবার ত্যাগের পর পরই রানা প্রতাপ পাহাড় থেকে বের হয়ে গোগুন্দা আর উদয়পুর দখল করে নিলেন।
৬
পরবর্তীকালে আকবর আরও কয়েকবার রানাকে ধরতে ছোটখাট অভিযান চালালেন। কিছু সাফল্য পেলেও মোটের ওপর অভিযানগুলো সফল হয়নি। সম্রাট আকবরের সেনাপতি শাহবাজ খান পরপর দুইবার উদয়পুর আর গোগুন্দাসহ রানার বেশ কিছু এলাকা জয় করলেও রানাকে ধরতে পারেননি। হলদিঘাঁটির যুদ্ধের পর থেকে রানা আর কখনোই মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতেন না। বরং তিনি পালিয়ে পালিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে বিগত যুদ্ধগুলোতে রানা প্রতাপ সিংহ সামরিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক দিক থেকে বেশ বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন। এরপর সামরিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য মুঘল-বিরোধী একটি জোট গড়ে তুললেন।
ইদারের নারায়ণ দাস, ঝালোরের তাজ খান আর রাও সুলতান সিরোহীসহ স্থানীয় বিভিন্ন রাজপুত নেতাদের নিয়ে গঠন করা হলো নতুন জোটটি। এরপর শুরু হলো মুঘল সেনাবাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা।
মুঘল সেনাবাহিনী বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করেও রানাকে সরাসরি কোনো সম্মুখ যুদ্ধে নামাতে পারেনি। অন্যদিকে, রানার এ গেরিলা কৌশল কাজে দিয়েছিল। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী এ ধরনের গেরিলা লড়াইয়ে অভ্যস্ত ছিল না। ফলে প্রতাপ সিংহের এই গেরিলা কৌশলের সামনে পুরো বাহিনী অসহায়বোধ করতে লাগল।
৭
রানা প্রতাপের এই চোরাগোপ্তা হামলা চলল টানা প্রায় দুই দশক, ১৫৯৭ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। হলদিঘাঁটের সেই যুদ্ধের পরপরই, ১৫৭৯ সালের দিকে সম্রাট আকবর পূর্ণ মনোযোগ দেন হিন্দুস্তানের উত্তরাঞ্চল আর মধ্য এশিয়ার দিকে। মেবারের দিকে বড় আকারের কোনো অভিযান প্রেরণের সুযোগ আর তিনি পাননি।
এই সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যহার করলেন রানা প্রতাপ। মেবারের পশ্চিমাংশের প্রায় পুরোটাই আবার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন তিনি। তবে চিতোরসহ মেবারের পূর্বাঞ্চল তিনি আর কখনোই অধিকার করতে পারেননি।
১৫৯৭ সালের ১৯ জানুয়ারি একটি শিকার অভিযানে গিয়ে আহত হয়ে মারা যান রানা প্রতাপ সিংহ। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার পুত্র অমর সিংহকে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজপুতদের নেতৃত্বে বসিয়ে যান। অমর সিংহও কয়েক বছর মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেলেন।
১৬০৫ সালে সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর্যন্ত মেবার মুঘল অধীনতা স্বীকার করেনি। সম্রাট হিসেবে আকবর পুত্র জাহাঙ্গীর ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর বেশ কয়েকবার ছোট ছোট অভিযান পাঠালেন মেবারে। সরাসরি কোনো ফল না আসলেও দীর্ঘদিনের টানা যুদ্ধে মেবার ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, সময়ের পরাশক্তি হয়েও এত বছরেও রাজপুত সমস্যা মিটাতে না পারার বিষয়টি মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য আত্মসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মোট কথা, এই পর্যায়ে এসে দুই পক্ষই একটি শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাকর সমাধান চাইছিল।
শেষপর্যন্ত সম্রাট জাহাঙ্গীর আর রানা অমর সিং-এর সম্মতিতে ১৬১৫ সালে গোগুন্দাতে একটি শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হলো। এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অবশেষে মেবার মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে নতি স্বীকার করল। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, সিসোদিয়া রাজপুতদের মুঘলদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এমনকি রানা অমর সিংহকে মুঘল রাজদরবারে হাজিরা দেওয়া থেকেও অব্যহতি দেওয়া হয়।
এছাড়াও, মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে সিসোদিয়া রাজপুতদের প্রতি আন্তরিকতা দেখানোর জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীর চিতোর দুর্গসহ চিতোরের আশেপাশের এলাকা মেবারকে দিয়ে দিলেন। তবে চিতোর দুর্গের জন্য আলাদা শর্ত ছিল- রাজপুতরা দুর্গটি ব্যবহার করতে পারবেন না! রাজপুতরা এই শর্তটিও মেনে নিলেন। হলদিঘাঁটির যুদ্ধের পর টানা ৩ যুগের যুদ্ধাবস্থা শেষে মেবার অবশেষে শান্তির দেখা পেল।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]