“বিশ্ব ইতিহাসে এই যুদ্ধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন যুদ্ধ নেই।”
The barbarian Invasion, 1990, Vol- 2, Page: 441
জার্মান সামরিক ঐতিহাসিক হ্যান্স ডেলব্রাক টুরসের যুদ্ধ নিয়ে উল্লেখিত মন্তব্যটি করেছিলেন। এ নিয়ে আরো স্পষ্ট অভিমত দেন এডওয়ার্ড গিবন তার The History of the Decline and Fall of the Roman Empire গ্রন্থে,
এই যুদ্ধে চার্লস্ বিজয়ী না হলে উমাইয়া সৈন্যবাহিনী স্বচ্ছন্দে জাপান থেকে রাইন পর্যন্ত জয় করতে পারত, এমনকি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ড পর্যন্ত। রক অব জিব্রাল্টার থেকে লোয়ার নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রযাত্রার এক হাজার মাইল দীর্ঘ রেখা। অনুরূপ লাইনের পুনরাবৃত্তি ঘটলে স্যারাসিনরা পৌঁছে যেত পোল্যান্ডের সীমান্ত ও স্কটল্যান্ডের উচুভূমিতে। নীল ও ফোরাতের চেয়ে রাইন বেশি অগম্য ছিল না।
প্রকৃত অর্থেই ম্যারাথন থেকে ওয়াটারলু পর্যন্ত ইতিহাসের সিদ্ধান্ত মূলক যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে ৭৩২ সালে টুরসের যুদ্ধ অন্যতম। ইউরোপের ভবিষ্যতকেই শুধু না; পরবর্তীতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সম্পর্কের ধরণ কেমন হবে, তার ইঙ্গিত আসে এখান থেকেই। দীর্ঘদিন ধরে বিজয়ে অভ্যস্ত আরবদের ইউরোপের মাটিতে এই পরাজয় ছিল কাঠফাটা রোদ্দুরে হঠাৎ বৃষ্টির মতই বিস্ময়কর।
টুরসের যুদ্ধ
সময়টা ৭৩২ সালের ১০ই অক্টোবর। আর স্থানটা বর্তমান ফ্রান্সের পয়েটিয়ার্স ও টুরস শহরের মধ্যবর্তী মুসাইস লা বাটাইলি নামক গ্রাম। রচিত হয়ে গেলো ইতিহাসের গতিমুখ বদলে দেয়া এক আখ্যান। কর্ডোবার উমাইয়া গভর্নরের নেতৃত্বে আরব বাহিনীর সাথে ফ্রান্সের রাজা চার্লসের নেতৃত্বে ফ্রাঙ্কিশ ও বুরগুন্ডিয়ানদের মধ্যে সংঘর্ষ।
ফরাসীদের কাছে ব্যাটল অব টুরস নামে পরিচিতি পেলেও আরবদের কাছে ‘মাআরাকাতে বালাতুশ শুহাদা’ বা শহীদী সৌধের যুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃত হয়। সৈন্য সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও মুসলিমদের সংখ্যা বেশি ছিল বলেই দাবি করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ পল ডেভিসের মতে, মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ৮০ হাজার এবং ফরাসি সৈন্য ৩০ হাজার। যদিও ভিক্টর ডি হ্যানসন উভয়পক্ষে সৈন্য সংখ্যা প্রায় সমান এবং তা ৩০ হাজারের কাছাকাছি বলে যৌক্তিকতা দেখাতে চেয়েছেন।
যা-ই হোক, আরব শিবিরে ব্যাপক প্রাণহানি এবং স্বয়ং গভর্নর আবদুর রহমান আল-গাফিকীর মৃত্যৃ ঘটে। শত্রুর সামনে প্রবল প্রতাপ প্রদর্শনের কারণে চার্লস ‘মার্টেল’ বা হাতুরী উপাধি লাভ করেন।
এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্যারোলিনিয়ান সাম্রাজ্য (৭৫০-৮৮৮) প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হয়। পরবর্তী কয়েক শতকের জন্য ইউরোপে মুখ্য হয়ে উঠে ফ্রান্সের আধিপত্য। পল ডেভিস মনে করেন,
পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্সের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা মহাদেশটার ভবিষ্যতকে আকৃতি দিয়েছে, আর সেই ক্ষমতাকে নিশ্চিত করেছে টুরসের যুদ্ধ। (100 Decisive Battles From ancient Times to the Present, 1999, California, Page: 106
আখ্যানের পটভূমি
ইসলামের ইতিহাসে উমাইয়া আমলকে বলা হয় সম্প্রসারণের যুগ। ততোদিনে বিশাল পারসিক সাম্রাজ্য পদানত। আস্তে আস্তে অধিকৃত হল সিরিয়া, আর্মেনিয়া ও উত্তর আফ্রিকাসহ বাইজান্টাইনীয় সাম্রাজ্যের বৃহত্তর অংশও। ৭১১ সালে জিব্রাল্টারে তারিক বিন জিয়াদের অবতরণের মাধ্যমে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম আরবদের অভিযান শুরু। ৭১৯ সালে আল-আন্দালুসের গভর্নর আল-সাম ইবনে মালিক আল-খাওলানি সেপটিমানিয়া অধিকার করেন।
পরের বছর রাজধানী স্থাপন করেন নারবোনিতে, মুসলিমরা যাকে আববুনা বলত। দ্রুতই তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল ভিসিগথ কাউন্টদের অধীনে থাকা আলেট, বেজিয়ার্স, আগদি, লোদেভি, ম্যাগুয়েলিনি ও নিমেসের উপর। কিন্তু ৭২১ সালেই টুলো অবরোধ করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বিপর্যস্ত হন একুয়াটাইনের ডিউক অডোর কাছে। আল-সাম মারত্মকভাবে আহত এবং নারবোনিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উমাইয়ারা দ্রুত পূর্ব দিকে ঘুরে আঘাত হানে এবং ৭২৫ সাল নাগাদ পৌঁছে যায় অটুন পর্যন্ত। দক্ষিণে উমাইয়া এবং উত্তরে ফ্রাঙ্কদের হুমকির মুখে ৭৩০ সালের দিকে ডিউক অডো চুক্তি করেন বারবার নেতা উসমান ইবনে নাইসার সাথে। কর্ডোবার আমির আবদুর রহমান গজিয়ে উঠা শত্রু উসমানকে আগে দমন করেন। তারপর মনোযোগী হন অডোর প্রতি।
৭৩২ সালে আরব বাহিনী লোয়ার নদী অভিমুখে উত্তর দিকে এগিয়ে যান। একুয়াটিনের ডিউক অডোর সাথে আবদুর রহমান আল-গাফেকির সংঘর্ষ হয়। এটি বোরদাউক্সের যুদ্ধ নামে ইতিহাসে পরিচিত। ১১ বছর আগে টুলোর যুদ্ধে বিজয়ী হলেও এবার শোচনীয়ভাবে পরাজীত হন অডো। কোন মতে পালিয়ে বাদবাকি ডিউকদের নিয়ে ফ্রাঙ্কিশ নেতা চার্লসের দরবারে আশ্রয় নেন। বলা বাহুল্য, ফ্রাঙ্কিশদের সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময়ে তার অধীনে ছিল উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রান্স (অস্ট্রাসিয়া, নিউস্ট্রিয়া ও বুরগুন্ডি), পশ্চিম জার্মানির অধিকাংশ এবং নিম্নভূমিসমূহ। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফ্রান্সই পশ্চিম ইউরোপে সত্যিকার শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছিল। অডোর বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে চার্লস আরবদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। উমাইয়ারা ভাবতেও পারেনি তার শক্তি ও প্রস্তুতির ব্যাপারে। তার মাশুল গুণতে হয় খুব নির্মমভাবেই।
তৎপরতা এবং যুদ্ধ
৭৩২ সালের গ্রীষ্মেই আবদুর রহমান আল-গাফিকী পিরোনিজ অতিক্রম করেন। বোরদাউক্সের যুদ্ধে অডোকে পরাজিত করার বিহ্বলতায় তারা দ্রুতই চার্লসের পেতে রাখা ফাঁদে পা দেয়। আসলে রণনিপুণ চার্লস একটা উচু জায়গা চেয়েছিলো, যেন উমাইয়ারা আক্রমণ করতে এলে পাহাড় বেয়ে আসতে হয়। আবদুর রহমান শীতের অপেক্ষা না করায় রমজানেই যুদ্ধ শুরু হল।
চার্লস নিজের পছন্দ মত যুদ্ধক্ষেত্রে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বাহিনীকে পরাজিত করেন। গোড়াতেই ফ্রাঙ্কিশ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে একটি গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় উমাইয়া শিবিরে। এতে করে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা জন্ম নেয়। আদতে চার্লসের কোন অশ্বারোহী বাহিনী ছিল না। উমাইয়া বাহিনী বারবার তীব্র আক্রমণে এগিয়ে এলেও চার্লসের দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনী সুকৌশলে তা প্রতিহত করে। পল ডেভিস বলেছেন,
চার্লসের বাহিনীর মূল অংশই মূলত পেশাদার পদাতিক বাহিনী। তারা ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও নিবেদিতপ্রাণ। গোটা ইউরোপ অভিযানে চার্লসের সাথী হয়েছিল তারাই।
এদিকে অডো মূল মুসলিম শিবিরে অগ্নিসংযোগ করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। শত্রুকে পেছনে তান্ডব চালাতে থাকেন, অবশিষ্ট ডিউকরা তখন দক্ষিণ ফ্রাঙ্কিশ বাহিনীর দক্ষিণ বাহুতে অবস্থান নেন। উমাইয়া সৈন্যরা চার্লসকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। উল্টা সুক্ষ্ম চতুরতার সাথে চার্লস তাদের পিছু হটে যেতে বাধ্য করেন।
পশ্চাদপসরণ বন্ধ করতে আবদুর রহমান এগিয়ে এলে শত্রু দ্বারা ঘেরাও হয়ে যান এবং সেই অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন। বিশৃঙ্খলা ও হতাশার মধ্যে রাতে ইয়েমেন, দামেস্ক, আফ্রিকা ও স্পেনের গোত্রসমূহ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সৈন্য পালিয়ে যায়। আমিরেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। পরদিন সতর্ক অবস্থানে থাকলেও যুদ্ধ আর হয়ে উঠেনা। নাটকীয় জয় পায় ফ্রাঙ্কিশ বাহিনী।
যুদ্ধ পরবর্তী হিসাব-নিকাশ
Encyclopedia Britannica এর ভাষ্য মতে, টুরসের যুদ্ধে উমাইয়াদের নিহত সৈন্য সংখ্যা ১০ হাজারের মত, যেখানে ফ্রাঙ্কিশ বাহিনীতে মাত্র ১ হাজার। চার্লসকে মার্টেল বা হাতুরি উপাধি দেয়া হয় উমাইয়া বাহিনীকে গুড়িয়ে দেবার জন্য। বীরত্ব প্রকাশের জন্য দাবি করা হয়, ৩ লাখ ৭৫ হাজার আরবকে হত্যা করা হয়েছে, আদতে যা ভিত্তিহীন। চার্লস মার্টেল জার্মান মিত্রদের তাড়িয়ে দিয়ে বিজয় চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ করেন। অন্যদিকে আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর সৃষ্ট শুন্যস্থান পূরণ করার মত যোগ্যতম বলে প্রমাণিত হয়নি। যদিও ৭৩৬ সালে তার পুত্র গলে আরেকটি অভিযান চালায়। তথাপি পিরোনিজের ওপাশে তারা আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
চার্লস লোম্বার্ডের রাজা লিউটপ্রান্ডের সহযোগিতায় একে একে দখল করেন মন্টিফিরিন, আভিগনন, আরলেস প্রভৃতি অঞ্চল। পরবর্তীতে নারবোনিতে বেরি নদীর তীরে শক্তিশালী উমাইয়া বাহিনীকে পরাজিত করলেও নারবোনি শহর দখল করতে ব্যর্থ হন। ৭৩৫ সালে একুয়াটাইনের ডিউক অডোর মৃত্যুর পর চার্লস তার রাজ্যকে নিজের রাজ্যের সাথে একীভূত করতে চাইলেও অভিজাতরা অডোর পুত্র হুনল্ডকে ডিউক হিসাবে ঘোষণা দেন। যদিও দিনশেষে হুনল্ড চার্লসকে প্রভু হিসাবে স্বীকার করে নেন।
৭৩৫ সালে আল-আন্দালুসের নতুন গভর্নর উকবা বিন আল হাজ্জাজ টুরসের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় অভিযান চালনা করেন। আরলেস ও এভিগনন দখল করেন। চার্লস ৭৩৬ এবং ৭৩৯ সালে দুইবার সেপটিমানিয়া আক্রমণ করলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বস্তুত টুরসের যুদ্ধেরও ২৭ বছর পর পর্যন্ত নারবোনি ও সেপটিমানিয়া উমাইয়াদের অধীনে থাকে। ৭৫০ সালে জাবের যুদ্ধে উমাইয়া খেলাফতের পতন ও আব্বাসীয় খেলাফতের সূচনা ঘটে। এই ঘটনা ও বিচ্ছিন্নতার কারণে ৭৫৯ সালে পেপিন দ্যা শর্টের কাছে আত্মসমর্পন করে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নারবোনি।
শেষ করবার আগে
টুরস বিজয়ী চার্লস মার্টেলের নাতি শার্লেমন পিরোনিজের উত্তরে নিরঙ্কুশ শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন। উমাইয়া আমলে হারানো খ্রিষ্টান অঞ্চলসমূহ পুনরুদ্ধার করার জন্য রিকনকোয়েস্টা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। আর এজন্য উমাইয়াদের শত্রু আব্বাসীয়দের সাথে তার মিত্রতা প্রতিষ্ঠিত হয়। খলিফা হারুন অর রশিদ ও শার্লেমানের মধ্যকার সম্পর্ক ছিলো প্রবাদ প্রতীম। পরবর্তীতে উত্তর-পূর্ব স্পেনে ফ্রাঙ্কিশ সম্রাটেরা ৭৮৫ সালে গিরোনা ও ৮০১ সালে বার্সেলোনা দখল করে। মার্কা হিস্পানিকা নামে প্রতিষ্ঠিত এই রাজ্য বাফার জোন হিসাবে কাজ করতো। সেই সূত্র ধরেই পা পা করে এগিয়ে যেতে তারা। অবশেষে ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় রিকনকোয়েস্টা আন্দোলন।