ঝেং শি: ইতিহাসের সফলতম জলদস্যুর আখ্যান

বর্তমান বিশ্বে জলদস্যুদের একাধিপত্যের কথা খুব বেশি একটা শোনা যায় না। একটা সময় বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুর ভিড়ে জলদস্যুদের জাহাজদখল কিংবা অপহরণের খবর বেশ ঘটা করে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান করে নিত। অপহরণের পর জলদস্যুদের সাথে মুক্তিপণ নিয়ে দরকষাকষি, অতঃপর বিরাট মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তিপ্রদান– এসব ছিল একসময়ের নিত্যদিনের ঘটনা। সে সময় গত হয়েছে।

ঝাঁকড়া চুল। এক চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। একটি পা খোঁড়া। রুক্ষ মেজাজ। ঘাড়ে একটি ঈগল পাখি। জলদস্যু বলতে আমাদের মনে এরকম একজন ব্যক্তির অবয়ব ফুটে ওঠে। হলিউডের বিখ্যাত ‘পাইরেটস্ অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ মুভিতে জনি ডেপের দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে জলদস্যুদের জীবন সম্পর্কে আমরা বাঙালিরা একটু হলেও ধারণা পেয়ে গেছি। তাদের রোমাঞ্চকর জীবনযাপন সবসময়ই থ্রিলারপ্রিয় মানুষের আগ্রহের বিষয় ছিল।

ফ্রান্সিস ড্রেক, ব্ল্যাকবার্ড কিংবা ক্যাপ্টেন কিড– জলদস্যুদের জগতে বড় বড় নাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ইতিহাসের সফলতম জলদস্যু একজন নারী! ঝেং শি নামের এই চীনা নারী দক্ষিণ চীন সাগরে বলা চলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন।

সননসহস
শিল্পীর তুলিতে কুইন ঝেং শি; image source: deviantart.com

ঝেং শি-এর শৈশব-জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। চীনের গুয়াংডং (বর্তমান নাম ক্যান্টন) প্রদেশে ১৭৭৫ সালে জন্মেছিলেন এই নারী। ‘ঝেং শি’ তার আসল নাম নয়। ‘ঝেং শি’ শব্দদ্বয়ের অর্থ ‘ঝেং এর বিধবা স্ত্রী’। তার প্রথম স্বামীর নাম ছিল ঝেং য়ি।

জনশ্রুতি রয়েছে, তরুণী ঝেং শি দেখতে অনেক সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সেই গুয়াংডু প্রদেশে একটি ভাসমান পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন।

ঝেং শি যখন তরুণী, তখন চীনে প্রবল প্রতাপে জলদস্যুগিরি করে বেড়াতো ঝেং য়ি নামের একজন দস্যু। এই দস্যুরাজের সাথেই পরবর্তীতে ঝেং শির বিয়ে হয়। তবে কীভাবে তাদের বিয়ে হলো, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

হতিতজচজ
গুয়াংডং (বর্তমানে ক্যান্টন) প্রদেশ, যেখানে ঝেং শি জন্মেছিলেন, তার একটি চিত্র; image source: atlasobscura.com
Artist name: Unknown

অনেকে বলেন, সেই দস্যুরাজের বাহিনী ঝেং শির ভাসমান পতিতালয়ে আক্রমণ চালায়। তারা ঝেং শির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাদের নেতা সেই দস্যুরাজ ঝেং য়ির কাছে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ঝেং য়ি তাকে বিয়ে করেন।

কেউ কেউ আবার বলেন, ঝেং য়ি সরাসরি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যা-ই হোক, যত বিতর্কই থাকুক না কেন, দস্যুরাজ ঝেং য়ি ও সুন্দরী ঝেং শি যে ১৮০১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন– এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে তাদের বিয়েতে একটি অদ্ভুত শর্ত ছিল। শর্তটি এরকম, সুন্দরী ঝেং শি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, লুট করা মালামালের বিভাজনসহ সবকিছুতেই অর্ধেক অধিকার লাভ করবেন।

ঝেং য়ি সেই সময়ের নামকরা দস্যু ছিলেন। তার নের্তৃত্বে কুখ্যাত ‘লাল নৌবহর’ দক্ষিণ চীন সাগরে ত্রাস ছড়াত। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী জলদস্যু গ্রুপগুলোর সাথে জোট তৈরি করেন। ফলে একটি বিশাল দস্যু-জোট তৈরি হয়, যে জোট ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এই জোটের সাহায্যে ঝেং য়ি ম্যাকাউ-এর পর্তুগিজ বন্দরে অবরোধ জারি করেন। পর্তুগিজরা তাদের সমৃদ্ধ নৌশক্তি নিয়ে বাধা দিতে আসলে উল্টো পরাজিত হয়ে ফিরে যায়।

ততগগ
চীনা দস্যু জাহাজ। এরকম প্রায় ১৮০০ জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে চলতেন ঝেং শি; image source: atlasobscura.com

কিন্তু এর মধ্যেই ট্রাজেডি ঘটে যায়। ঝেং য়ির ভাগ্য খারাপ। বিয়ে করার ছয় বছর পরই তিনি ভিয়েতনামে ঝড়ের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।

দস্যুরাজ ঝেং য়ির মৃত্যুর পর তার অধীনে যে বিরাট দস্যুদল ছিল, তার নের্তৃত্বে কে আসবেন, তা নিয়ে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিধবা ঝেং শি পুরো দস্যুদলের নের্তৃত্বের ভার গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করেন প্রয়াত দস্যুরাজের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড চ্যাং পাও। এরপরের গল্প শুধুই ঝেং শির সাফল্যগাঁথার।

প্রয়াত স্বামীর সময়ে যে জোট ছিল, সুন্দরী দস্যুরানী ঝেং শি তা অব্যাহত রাখেন। তার অধীনে যে বিরাট দস্যুদল ছিলো তাদের জন্য কিছু সংস্কার চালু করেন।

ঝেং শি নিয়ম করেন, লুটের ফলে দস্যুদের হাতে যে মালামাল হস্তগত হবে, তার ২০% লুটকারী জাহাজ পাবে। বাকি ৮০% দস্যুদের সামগ্রিক তহবিলে জমা হবে।

এছাড়াও আরও নিয়ম করা হয়, সমুদ্র উপকূলীয় গ্রামগুলোতে আক্রমণ করার পর যেসব নারীদের বন্দী করা হবে, তাদের মধ্যে যারা দেখতে সুন্দরী নয়, তাদের কোনো ক্ষতিসাধন ব্যতিরেকেই মুক্তি দিতে হবে। আর সুন্দরী বন্দীদের চাইলে বিয়ে করা যাবে, তবে শর্ত আছে। কোনো নারীকেই তার ইচ্ছার বিপরীতে যৌনসঙ্গমে বাধ্য করা যাবে না। সেই নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।

এছাড়াও আরও বেশ কিছু নিয়ম আরোপ করা হয়, যেগুলো মান্য করা প্রতিটি দস্যুর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এই নিয়মগুলো না মানলে প্রথমে কান কাটা হতো। পরবর্তীতে মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো।

ঝেং শির কঠোর নের্তৃত্বের ফলে তার বিশাল নৌবহর তৈরি হয়। ধারণা করা হয়, তার লাল নৌবহরে প্রায় আঠারোশ জাহাজ ছিল! আর এসব জাহাজ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার অধীনে ছিল আরও সত্তর হাজার জলদস্যু! ছোটখাট সাম্রাজ্যই বলা যায়!

সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোতে তার দস্যুবাহিনী নিয়মিত আক্রমণ করত। ফলে সমুদ্র তীরবর্তী বিশাল অঞ্চলে ঝেং শির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। এসব অঞ্চল থেকে তিনি তার দস্যুবাহিনীর মাধ্যমে কর আদায় করতেন।

একসময় ঝেং শির আধিপত্য এত বেশি অঞ্চলে বিস্তৃত হয় যে, চীনা রাজবংশের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চীনা রাজবংশ ব্রিটেন এবং পর্তুগালের সাহায্য নিয়ে তাকে পরাস্ত করতে নৌ-অভিযান প্রেরণ করে। কিন্তু ঝেং শির বিশাল বাহিনীর কাছে তারা টিকতেই পারেনি। শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয় তাদের। এমনকি সম্মিলিত রাজকীয় বাহিনীর ষাটটি জাহাজ দখল করে নেয় ঝেং শির দস্যুরা।

উপায়ান্তর না দেখে চীনা রাজবংশ সুন্দরী দস্যুরাণী ঝেং শিকে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। সমঝোতা অনুযায়ী, লুটের মালামাল নিজের কাছে রাখার নিশ্চয়তা পান। যেসব অঞ্চলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেসব রাজবংশের হাতে ন্যস্ত করেন। এছাড়াও সমঝোতার ফলাফল হিসেবে দস্যুরানী তার ‘ডান হাত’ খ্যাত চ্যাং পাওকে বিয়ে করেন। অদ্ভুত শোনালেও সত্য, চ্যাং পাও তার পালিত পুত্র ছিল!

মসমসনস
পাইরেটস্ অব দ্যা ক্যারিবিয়ান’ মুভিতে যেভাবে ঝেং শি’কে দেখানো হয়েছে; image source: newhistorian.com

কিন্তু হঠাৎ করেই কেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দস্যুরানী সরকারের সমঝোতা প্রস্তাবে সাড়া দিলেন?

অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, প্রয়াত ঝেং য়ির সময় যে দস্যুগ্রুপগুলো নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এটি একটি কারণ। এছাড়াও ঝেং শির ‘সমুদ্রে ভেসে ভেসে বেড়ানো’ জীবন আর ভালো লাগছিল না। তাই তিনি রাজবংশের সমঝোতা প্রস্তাবে সায় দেন।

সমঝোতার পর তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তিনি তার শৈশবের এলাকায় ফিরে যান এবং গোপনে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৪৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

একজন সাধারণ দেহব্যবসায়ী থেকে ইতিহাসের সফলতম দস্যু হওয়া– ঝেং শির জীবনে সবকিছু সহজ ছিল না। ভাগ্যের ছোঁয়াও যে একেবারেই ছিল না, সেটিও অস্বীকার করা যাবে না। তবে তিনি যে একজন শক্তিমান ও গোছালো নারী ছিলেন, এ বিষয়টি একদম পরিস্কার। সেই সময়ে একজন নারীকে প্রধান হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা চীনের মানুষের ছিল না, কিন্তু তার ক্যারিশমাটিক নের্তৃত্ব ও ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তিনি তা সম্ভব করেছিলেন।

Related Articles

Exit mobile version