কোথা থেকে এলাম আমরা? কীভাবে উৎপত্তি ঘটেছে এই বিশ্বের? এই প্রশ্ন তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সকল এলাকার সকল সময়ের মানুষকে। তখন বিজ্ঞান ছিল না। আপাত চোখের পর্যবেক্ষণ আর অনুমানের উপর ভিত্তি করে তারা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। অনেক অনেক দিন পর্যন্ত সেসব উত্তরকেই সঠিক বলে ধরে নিয়েছিল ঐ অঞ্চল ও সংস্কৃতির মানুষেরা। কালের প্রবাহে বিজ্ঞানের বিপ্লব সংঘটিত হয়। জ্ঞানের প্রত্যেক কোনায় কোনায় দাপট দেখাতে শুরু করে বিজ্ঞান। ফলে সেসব ব্যাখ্যা রূপান্তরিত হয় গল্প আর উপকথায়। এরকম কয়েকটি উপকথা নিয়ে আলোচনা থাকছে এখানে।
আফ্রিকার একটি উপকথা দিয়ে শুরু করি। এর উৎপত্তি কঙ্গোর বান্তু উপজাতিদের মাঝে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টির একদম শুরুতে ভূমির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সমগ্র মহাবিশ্বে অস্তিত্ব বলতে শুধুমাত্র দেবতা ‘বোম্বা’ই ছিল। এছাড়া চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। একসময় বাধলো বিপত্তি, পেটের পীড়া দেখা দিলো বোম্বার। পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একসময় তিনি বমি করে দিলেন। তার বমি থেকে তৈরি হলো সূর্য। সূর্য থেকে নির্গত আলো জগতে বিদ্যমান অন্ধকারকে দূর করে দিলো। তখন সমগ্র পৃথিবী ছিল জলে নিমগ্ন। সূর্য থেকে নির্গত তাপের ফলে কিছু পরিমাণ জল শুকিয়ে নিয়ে ডাঙার জন্ম দিলো।
তখনো বোম্বার পেটের ব্যাথা পুরোপুরি ভালো হয়নি। থাকতে না পেরে তিনি আবারো বমি করলেন। এবারের ধাক্কায় বের হয়ে আসলো চাঁদ, নক্ষত্ররাজি, জাগতিক প্রাণী ও মানুষ। অর্থাৎ আজকের সকল মানুষ, সকল প্রাণী, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সবই তৈরি হয়েছে বোম্বার বমি থেকে।
তারপর আসি চৈনিক উপকথায়। চীনের অনেক পৌরাণিক গল্পেই ‘প্যান গু’ নামে একজন দেবতার কথা উল্লেখ থাকে। প্যান গু’র সমস্ত দেহ লোমশ এবং মাথা কুকুরের মাথার মতো। প্যান গু’র অনেকগুলো উপকথার মাঝে এটি একটি। সৃষ্টির একদম শুরুতে স্বর্গলোক ও মর্ত্যলোকের মাঝে কোনো পার্থক্য ছিল না। স্বর্গ ও মর্ত্যের সবকিছুই একসাথে তালগোল পাকিয়ে কালো রঙের বিশাল একটি ডিমের ভেতর আবদ্ধ ছিল। ভ্রূণ যেমন ডিমের ভেতর প্যাচিয়ে কুচকে থাকে, বিশাল ঐ ডিমের ভেতর প্যান গু’ও প্যাচানো ও কুচকানো অবস্থায় ছিল। বিশাল কালো ডিমের ভেতর এমন অবস্থায় থেকে একটানা ১৮ হাজার বছর ঘুমিয়েছিলেন তিনি।
ঘুম যখন ভাঙল তখন সেখান থেকে বের হতে চাইলেন। তার হাতে ছিল একটি কুড়াল, ঐ কুড়াল দিয়ে সজোরে ডিমের দেয়ালে আঘাত করলেন। শক্তিশালী আঘাতে ডিম ভেঙে যায় এবং তিনি বের হয়ে আসেন। এর ফলে ডিমের ভেতরের কিছু থলথলে উপাদানও বের হয়ে আসে। এর মাঝে কিছু পরিমাণ পদার্থ খুব দৃঢ় ছিল, যা থেকে পরবর্তীতে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। ডিম থেকে কিছু পরিমাণ আলোও নিঃসরিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে আকাশ সৃষ্টি করেছিল। এরপর পৃথিবী ও আকাশ ধীরে ধীরে স্ফীত হতে শুরু করলো। ডিম ভাঙার পর থেকে প্রতিদিন ৩ মিটার করে পরবর্তী ১৮ হাজার বছর পর্যন্ত স্ফীত হয়েছিল। স্ফীত হতে হতে আজকের অবস্থায় এসেছে।
ক্ষেত্রবিশেষে প্যান গু’র এই উপকথার কিছুটা হেরফের হয়। কোনো কোনো ভাষ্যে বলা হয়, পৃথিবী ও আকাশ একত্রে মিশে যাচ্ছিল, প্যান গু তার প্রবল শক্তি দিয়ে আকাশকে উপরের দিকে ঠেলে ধরে পৃথিবী থেকে আলাদা করে রাখছিলেন। এতে শক্তি ও সামর্থ্যের প্রচুর ব্যয় হতে থাকে। শক্তি ব্যয় হতে হতে এতটাই নিঃশেষ হয়ে যান যে একসময় তিনি মারা যান।
তার শরীরের অংশবিশেষই পরবর্তীতে মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদান তৈরি করে। তার নিঃশ্বাস থেকে তৈরি হয় বাতাস, কণ্ঠ থেকে তৈরি হয় বজ্রপাত, দুই চোখ থেকে তৈরি হয় চন্দ্র ও সূর্য, পেশি থেকে জন্ম দেয় উর্বর ভূমি, শিরা-উপশিরা থেকে তৈরি হয় নদী ও রাস্তা। তার ঘাম থেকে তৈরি হয় বৃষ্টি এবং চুল থেকে তৈরি হয় নক্ষত্ররাজি। পৃথিবীর মানবজাতি হচ্ছে তার দেহের উকুন ও মক্ষিকার বংশধর।
পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য প্যান গু’র আকাশকে ঠেলে ধরে রাখার গল্পটি আবার অনেকটা গ্রিক উপকথার এটলাসের গল্পের মতো। এটলাসও সমস্ত আকাশকে কাঁধে নিয়ে রেখেছিল, যেন তা উপরে আটকে থাকে। প্রাচীন মানুষদের ধারণা ছিল আকাশ তো কোনো খুঁটি ছাড়াই উপরে আটকে আছে। খুঁটি ছাড়া কোনো জিনিস আটকে থাকে কীভাবে? কাউকে না কাউকে তো উঁচু কোনো স্থান থেকে আকাশকে কাঁধে নিয়ে রাখতেই হবে!
এবার ভারত উপমহাদেশীয় উপকথায় প্রবেশ করি। বিশ্বজগতের উৎপত্তি নিয়ে ভারতীয় অঞ্চলে প্রচুর উপকথা প্রচলিত আছে। এদের মাঝে একটি এরকম- সৃষ্টির শুরুতে জগতে বিশাল এক অনস্তিত্বের সমুদ্র (Ocean of nothingness) ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সমুদ্রের পৃষ্ঠে কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল দানবীয় এক সাপ। অনস্তিত্বের সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে আসা গুনগুনানির শব্দে একসময় দেবতা বিষ্ণুর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দেখেন তলদেশ থেকে উঠে আসা একটি পদ্ম গাছ তার নাভির ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে। পদ্ম ফুলের মাঝে বসে আছেন বিষ্ণুর ভৃত্য ব্রহ্মা। তারপর তিনি ভৃত্যকে বললেন বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতে। আদেশ অনুসারে ব্রহ্মাও ঠিক তা-ই করলেন। তারপর জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করতেও বললেন। কথামতো হয়েও গেলো তা, আগেরটার চেয়ে এটা আরো সহজ কাজ।
গ্রিক পুরাণ থেকে কোনো উপকথা উল্লেখ না করলেই নয়। অন্ধকার থেকে দেবতা ক্যাওসের জন্ম হয়। ক্যাওস থেকে দেবী ইউরিনোম (Eurynome)-এর জন্ম হয়। তখন আকাশ, মর্ত্য ও সাগর একত্র অবস্থায় ছিল। জন্মের পর নিজের অবস্থান রাখার জন্য কোনো জায়গা পাচ্ছিলেন না। সেজন্য মর্ত্য ও সাগর থেকে আকাশকে পৃথক করেন। এরপর সাগরের জলধারায় একাকী নৃত্যে মগ্ন হয়ে গেলেন। অন্যদিকে আঁধার থেকে জন্ম নেয়া দেবতা ক্যাওস অন্ধকারের সাথে মিশে দিন-রাত্রি, আলো-আঁধারের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করলেন। ক্যাওস থেকে ওফিওন (Ophion) নামে একটি সাপেরও জন্ম হয়। দেবী ইউরিনোমের নৃত্য দেখে ওফিওন কামাসক্ত হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড আকর্ষণে কাছে টেনে নেয় দেবীকে। দেবী একটি পক্ষীর রূপ ধারণ করে একটি ডিম প্রসব করেন। ঐ ডিমকে সাত পাকে পেঁচিয়ে তা দিতে থাকে সর্প ওফিওন।
তা সম্পন্ন হলে ডিম দু’ভাগে ভাগ হয়ে সেখান থেকে জন্ম নেয় পৃথিবী, গাছপালা, নদী-নালা, প্রাণীকুল সহ অন্যান্য সকল কিছু। অর্থাৎ গ্রিক পুরাণ মতে সাপ ও পাখির মিলনে একটি ঐশ্বরিক অণ্ডের জন্ম হয়। সেই অণ্ড বিস্ফোরিত হয়ে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র। অনেকটা বিগ ব্যাং ধারণার মতোই যেন!
ফিচার ছবি: ডিভাইন আর্ট