শুরুর আগে
রবার্ট বিলোত। পেশায় কর্পোরেট ডিফেন্স অ্যাটর্নি। বড় বড় কোম্পানির হয়ে মামলা লড়াই তার কাজ। নিজ ক্ষেত্রে বেশ সফল এই মানুষটির কাছে একদিন এক গরুর খামারী অভিযোগ নিয়ে এল।
এ ধরনের কেস সামলানো আসলে তার কাজের মধ্যে পড়ে না। একে তো লোকটা একজন সাধারণ খামারী, তার মানে, এই কেস থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত সে অভিযোগ নিয়ে এসেছে দেশের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক কোম্পানির বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, এই কেস নেয়ার মানে শুধু নিজের আওতার বাইরে যাওয়াই নয়, নিজের পেশার সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ানো। যে ধরনের কোম্পানির হয়ে মামলা লড়ে, এই কেস নিলে তাদেরই বিরুদ্ধে যেতে হবে। সহজ কথায় যাকে বলে, ক্যারিয়ার সুইসাইড। নিজ হাতে পেশাগত জীবনকে জলাঞ্জলি দেয়া।
কোনো যুক্তি-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে জেনে-বুঝে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত বড় ঝুঁকি নেয়া সম্ভব না। বিশেষ করে, বিবাহিত কেউ হলে, নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে হলেও এ ধরনের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে হয়।
তবে সব মানুষ এরকম না। কিছু মানুষ থাকে, আর সব পরিচয়ের ছাপিয়ে যাদের কাছে মানুষ পরিচয়টাই বড় হয়ে ওঠে। তেমনি একজন মানুষ ছিলেন রব বিলোত। কেসটা তিনি নিয়েছিলেন। অসম্ভব ক্ষমতাশালী এক কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রবল প্রতিপত্তির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মাথা উঁচু করে, নির্ভয়ে।
চলুন ফিরে যাওয়া যাক ১৯৯৮ সালের সেই রোদ্দুর সকালে।
১
মিটিং চলছে। শুরুতেই উপস্তিত সবাই বিলোতকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ঘটনা অবশ্য এখনো ঘটেনি। মাসখানেক পরে ঘটবে। ট্যাফট স্টেটিনিয়াস এন্ড হলিস্টার ফার্মের একজন পার্টনার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হবে বিলোতকে। ৮ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার ফল। কাগজপত্রের ঝামেলার কথা বাদ দিলে, অনানুষ্ঠানিকভাবে সব কিছু ফাইনাল হয়ে গেছে। মিটিংয়ে অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা হচ্ছে না। আসলে, মিটিংয়ে তেমন জরুরি কিছুই আলোচনা হচ্ছে না। সামনের দিনগুলোর কাজকর্ম নিয়ে সবাই বসে একটু পরামর্শ করে নিচ্ছে।
এ সময়ই ফোনটা এল। অপরিচিত নাম্বার। ওর নাম্বারে সাধারণত অযথা কোনো কল আসে না। তাই মিটিংয়ের মাঝেই ফোনটা রিসিভ করল বিলোত। পার্কারসবার্গ থেকে উইলবার টেনেন্ট নামে একজন ফোন দিয়েছে। লোকটা পেশায় গরুর খামারী। এটুকু শুনেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল সে। কিন্তু কল যেহেতু ধরেই ফেলেছে, মুখের ওপরে তো আর কেটে দেয়া যায় না!
টেনেন্ট জানাল, ওর খামারের গরুগুলো সকাল-সন্ধ্যা করে মারা যাচ্ছে। সে মনে করে, ডুপন্ট কেমিক্যাল কোম্পানিই (DuPont Chemical Company) এর জন্য দায়ী। পার্কারসবার্গে ওদের পেন্টাগনের চেয়েও পঁয়ত্রিশ গুণ বড় এক জায়গা আছে। আছে বিশাল এক কারখানা। টেনেন্টের ধারণা, এই কারখানায় ব্যবহৃত কোনো রাসায়নিকের জন্যই এমনটা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে সাহায্য চাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে লোকটা। এই শহরের আইনজীবীরাই শুধু নয়, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, ডাক্তার এমনকি পশু চিকিৎসকদেরকে পর্যন্ত ডুপন্ট একরকম পকেটে পুরে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর একটা বলে কথা!
লোকটা রাগী গলায় প্রায় চিৎকার করে কথা বলছিল। কথার সুরে স্থানীয় টান এত প্রকট যে ঠিক করে বুঝতেও পারছে না বিলোত। রেখেই দিত, কিন্তু ওকে ফোন দেয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করল টেনেন্ট। বিলোতের দাদী, আলমা হল্যান্ডের কাছে ওর খোঁজ পেয়েছে। পার্কারসবার্গেই থাকেন আলমা। সেজন্য শেষ ভরসা হিসেবে বিলোতকে ফোন দিয়েছে সে। চাইছে, সে এই কেসটা নেবে।
এই কেস নেয়া বিলোতের পক্ষে সম্ভব না। কারণ, প্রথমত সে কর্পোরেট ডিফেন্স অ্যাটর্নি। কোম্পানিগুলোর পক্ষে কেস লড়া তার কাজ। বিরুদ্ধে কেস লড়ার অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান তার নেই। দ্বিতীয়ত, এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ার হলেও, ওর কাজ এটা প্রমাণ করা যে কোম্পানিগুলো পরিবেশ দূষণ করছে না। তৃতীয়ত, এই কেস নেয়া মানে তার জন্য নিজের পায়ে কুড়াল মারা।
সবমিলে লোকটাকে সে বলল, অন্যকোনো আইনজীবী খুঁজে দেবে সম্ভব হলে। কিন্তু এই কেস নেয়া তার পক্ষে সম্ভব না। জবাবে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, অন্যকোনো আইনজীবী খুঁজে দেয়ার জন্য সে ফোন দেয়নি। ওর সাহায্যের জন্য ফোন দিয়েছে। এরমধ্যেই ফোন রেখে দিল বিলোত। মিটিং যতই অগুরুত্বপূর্ণ হোক, সেখানে ওকে থাকতে হবে। বাইরে বসে ফোনে কথা বললে আর পার্টনার হওয়া লাগবে না।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। হয়নি, কারণ, দাদীর সূত্র ধরে আসার ব্যাপারটা ওর মাথায় খোঁচাচ্ছিল। কাজেই পরদিন অফিস বাদ দিয়ে পার্কারসবার্গে গাড়ি ছোটাল রবার্ট বিলোত। উদ্দেশ্য, আলমা হল্যান্ডের বাসা।
আলমা হল্যান্ডের বয়স হয়ে গেছে। একা থাকেন, কোনোমতে জীবনের শেষ দিনগুলো টেনে যাওয়া আরকি। কলিংবেল শুনে একটু অবাকই হলেন তিনি। তার কাছে তো কারো আসার কথা না! দরজা খুলে দেখলেন, নাতী দাঁড়িয়ে আছে!
বিলোতের প্রশ্নের জবাবে জানালেন, টেনেন্টকে তিনি চেনেন। না, এই বুড়ো বয়সে এসে প্রেম করার শখ জাগেনি। টেনেন্টের সঙ্গে তিনি প্রেম করছেন না। প্রতিবেশী হিসেবেই চেনেন লোকটাকে। ছোটবেলায় বিলোতকে টেনেন্টের খামারে নিয়েও গেছেন। অ্যালবাম খুলে ধরলেন। স্মৃতির পাতায় পেছনে ফিরে যাওয়া।
ছবিগুলো ওর ৭ বছর বয়সের। টেনেন্টের খামারে ছোটবেলায় বিলোত ঘোড়ায় চড়েছে, শিখেছে গরুর দুধ দোহন করাসহ আরো অনেক কিছু। অ্যালবাম চোখ বুলাতে গিয়ে রবার্ট বিলোত টের পেল, এই কেস তাকে নিতে হবে। নিয়তি তার নির্ধারিত হয়ে গেছে অনেক আগেই।
২
উইলবার টেনেন্টের খামার বিশাল জায়গাজুড়ে। গল্পটা টেনেন্ট বলছিল ট্যাফট স্টেটিনিয়াস এন্ড হলিস্টার-এ, বিলোতের অফিসে বসে। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে থমাস টার্প- ট্যাফটের একজন সিনিয়র পার্টনার এবং বিলোতের সুপারভাইজার।
টেনেন্টের ভাষ্যমতে, বাবা যখন ছেলেবেলায় ওদের ছেড়ে চলে যান, চার ভাই মিলে এই খামার শুরু করেছিল ওরা। তখন ওদের গরু ছিল ৭টা। কালের পরিক্রমায় ওদের খামার বড় হয়েছে। এমনও সময় গেছে, যখন এই খামারের ৬০০ একরের বেশি জমিতে ২০০-র মতো গরু চরে বেড়াত।
খামারটা কিন্তু আরো বড় ছিল। উইলবারের বড় ভাই জিম টেনেন্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে, সে ও তার স্ত্রী ডেলা অর্থাভাবে একরকম বাধ্য হয়েই ডুপন্টের কাছে ৮০-র দশকে ৬৬ একর জায়গা বিক্রি করে দেয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জিমের অসুস্থ হওয়ার পেছনেও সেই ডুপন্ট। টেনেন্ট সেদিন বলেছিল, যুক্তি অন্তত তাই বলে। পরে জানা গিয়েছিল, টেনেন্ট সেদিন ভুল কিছু বলেনি।
ওয়াশিংটন ওয়ার্কস নামে পার্কারসবার্গে ডুপন্টের বিশাল এক কারখানা আছে। ১৯৬৪ সালে সেখানে কাজ নিয়েছিল জিম। এই কাজ করতে গিয়েই রহস্যময় কোনো রোগে আক্রান্ত হয় সে। উপসর্গগুলো ছিল ফ্লু-এর মতো। ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, হাত আঠা আঠা হয়ে যাওয়া, প্রেশার কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ও শরীরের তাপমাত্রা নেমে যাওয়া ইত্যাদি। ডাক্তাররা এসব উপসর্গের পেছনে পরিচিত কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
১৯৭৯ সালের দিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় জিম ট্যানেন্টকে। ফলে অর্থাভাব দেখা দেয় তাদের। এমনও দিন গেছে, যখন ডাক্তার ডেলাকে বলে দিয়েছেন, তার স্বামী পরেরদিনের সূর্য হয়তো দেখতে পাবে না। এভাবেই, দিনের পর দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিল জিম। তারপর, ১৯৮০ সালের দিকে ডুপন্ট ওদের ৬৬ একর জায়গা কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রথমে রাজী না হলেও, ৩ বছর পর, ১৯৮৩ সালে বাধ্য হয়ে জায়গাটা বিক্রি করে দেয় তারা। চুক্তি হয়েছিল, ডুপন্ট এটাকে ‘ক্লাস-২ ল্যান্ডফিল’ হিসাবে ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ওয়াশিংটন ওয়ার্কস কারখানার বিভিন্ন বর্জ্য এখানে ফেলবে তারা, কিন্তু এতে রাসায়নিক বা বিষাক্ত কিছু থাকবে না।
ডুপন্টের কেনা জমি এবং টেনেন্টদের খামারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ড্রাই রান নামের একটি ক্রিক। খামারের পশুরা সেখান থেকেই পানি খেত। স্থানীয় সবার বাসায় পানির সাপ্লাইও যেত সেখান থেকেই। ডুপন্ট তাদের কেনা জমির নাম দিয়েছিল এই ক্রিকের নামে, ড্রাই রান ল্যান্ডফিল। আর, ওদের বর্জ্য ফেলতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল পশুগুলো। কোনো কোনোটা এত পাগলামি করত যে গুলি করে মারতে হয়েছে নিজ হাতে বড় করা পশুগুলোকে। উইলবার টেনেন্ট বলেছিল, ১৫৩টার মতো গরু মারা গেছে ওদের। পরবর্তীতে জিম জানায়, টেনেন্ট পরিবার প্রায় ২৫০ গরু হারিয়েছে ডুপন্টের কারণে।
সমস্যা শুধু গরু নিয়ে ছিল না। এলাকার মানুষ অদ্ভুত সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল একের পর এক। অনেকের দেহে বাসা বেঁধেছিল মরণব্যাধি ক্যান্সার। মানুষকে ব্যবচ্ছেদ করেনি উইলবার, কিন্তু পশুদের করেছিল। বেশ কিছু ভিডিও টেপ নিয়ে এসেছিল সে সাথে করে।
বিলোত সেই ভিডিও টেপ দেখলেন। শুরুর দিকেই দেখা গেল, একটা লম্বা পাইপের মুখ এসে পড়েছে ক্রিকে। ওটা থেকে সবুজ রঙের পানি বেরিয়ে আসছে। বুদবুদ ও ফেনা তৈরি হচ্ছে পানিতে। উইলবার বলছিল, ‘ওরা চায়, মানুষের গরু তার নিজের জমিতে দাঁড়িয়ে এসব খাবে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট কিংবা অন্যকোনো মন্ত্রণালয়ের কেউ এসে ওদের লাগাম টেনে ধরা উচিৎ’।
ভিডিও কিন্তু চলছিল। পুরানো দিনের ভিডিও টেপ। মাঝে মাঝে খড়খড় শব্দ। এর মধ্যেই দেখা গেল, একটা কালো রঙের মৃত গরুর বাছুর শুয়ে আছে। ওটার চোখ দুটো জ্বলজ্বলে নীল! ভিডিওতেই উইলবার বলছিল-
‘এই ফার্মে আমি এভাবে একশ তিপ্পান্নটা গরু হারিয়েছি। পার্কারসবার্গের যত পশু-ডাক্তারকে আমি ফোন দিয়েছি, তাদের বেশিরভাগ আমার ফোনটা ফেরায়নি পর্যন্ত। যারা ফিরিয়েছে, তারা কেউ এর মধ্যে আসতে রাজি না। সেজন্য আমাকেই বাধ্য হয়ে এগুলো ব্যবচ্ছেদ করতে হয়েছে।’
বেশ কিছু মৃত জন্তুকে ব্যবচ্ছেদ করতে দেখা গেল ভিডিওতে। কোনোটার দাঁত কালো হয়ে গেছে, কোনোটার কিডনি ফুলে গেছে অস্বাভাবিকভাবে, লালের বদলে বিচিত্র নীল-সবুজ-বেগুনি ইত্যাদি রঙ দেখা যাচ্ছে জন্তুগুলোর ভেতরে। (উইলবার ট্যানেন্টের করা ভিডিওটি নিচে দেয়া হলো। যাদের সহ্যক্ষমতা কম, তাদের প্রতি ভিডিওটি না দেখার অনুরোধ রইল। ভিডিও সূত্র: The Intercept।)
ভিডিও টেপ এবং উইলবারের তোলা কিছু ছবি দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল বেশ কয়েক ঘণ্টা। তারপর, রবার্ট বিলোত নিজেকেই বললেন, ‘দিস ইজ ব্যাড। খুব খারাপ কিছু হচ্ছে এখানে।’ হ্যাঁ, সেই মুহূর্তেই কেসটা নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
৩
ট্যাফটের মতো বিখ্যাত ল’ফার্মে যোগ দেয়ার জন্য যে ধরনের অভিজ্ঞতা ও সিভি থাকা দরকার, তা ছিল না রবার্ট বিলোতের। বিখ্যাত কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি তিনি। বাবা ছিলেন বিমান বাহিনীর লেফট্যানেন্ট কর্নেল। প্রায়ই বিভিন্ন এয়ায়রফোর্স বেসে বদলি করা হতো তাকে। সেজন্য এক অনার্স শেষ করতে করতে আটবার কলেজ বদল করতে হয়েছিল বিলোতকে। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশে অনার্সকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ধরা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপারটা সেরকম না। সহজ করে বললে, সেখানে অনার্স মানে কলেজ। তারপর মাস্টার্স কিংবা পিএইচডির জন্য যেতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শেষ পর্যন্ত নিউ কলেজ অব ফ্লোরিডা থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি পেলেন বিলোত। চেয়েছিলেন সিটি ম্যানেজার হবেন। কিন্তু বাবা তাকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে, পড়াশোনার শেষ দিকে তিনি নিজেও ভর্তি হয়েছিলেন ল’-স্কুলে। সেজন্যই পরবর্তীতে ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিস ডক্টর ডিগ্রি নেন তিনি, যোগ দেন ট্যাফটে।
আগেই বলেছি, বিলোত ছিলেন এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ার। ট্যাফটে থমাস টার্পের টিমে ছিলেন তিনি। যদিও তার কাজ ছিল বড় বড় রাসায়নিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে, তারা যে পরিবেশ দূষণ করছে না-তা প্রমাণ করা। কিন্তু বিলোত এই কাজটা করতেন মন থেকে। থিওকোল (Thiokol) এবং বি কেমিক্যাল (Bee Chemical) এর মতো যে কোম্পানিগুলোর হয়ে তিনি কাজ করেছেন, তারা আসলেই বিষাক্ত বর্জ্য ভালভাবে নিষ্কাষণ করত।
বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে ‘সুপারফান্ড’ নামে পরিচিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ট্যাফটের মতো কোম্পানিগুলোর জন্য এটা একটা বড় ক্ষেত্র ছিল। কারণ, এই নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে হলে পরিবেশ দূষণ ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যাপারে বেশ গভীর ধারণা থাকতে হয়। সহজ কথায়, এই কাজ সবার জন্য না। কিন্তু বিলোত তার কাজে ছিলেন দারুণ দক্ষ। সেজন্যই আট বছর কাজ করার পর ট্যাফট তাকে পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
কাজের ফাঁকে আর কিছু করার সময়ই পেতেন না বিলোত। সেজন্য এক সহকর্মী তাকে একরকম জোর করেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আরেক আইনজীবী সারাহ বার্লেজের (Sarah Barlage) সঙ্গে। বড় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কর্মীরা মামলা করলে, সারাহ সেসব কোম্পানির পক্ষে কাজ করেন। পরবর্তীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সারাহ বলেছিলেন, ‘আমি ভীষণ বাচাল প্রকৃতির, আর ও একদম কথাই বলে না সেভাবে। দারুণ মিলে গেল আমাদের।’ পরে, ১৯৯৬ সালে সারাহর সঙ্গে বিলোতের বিয়ে হয়। সারাহ-বিলোত দম্পতির মোট তিন সন্তান। বিয়ের দুই বছর পর, ১৯৯৮ সালে তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। ঘটা করে এসব বলার কারণ, ব্যক্তি রবার্ট বিলোতের ব্যাপারে পাঠক এ থেকে কিছুটা ধারণা পাবেন।
বিলোত যখন এই কেস নিতে চাইলেন, ট্যাফট পড়ল বিপাকে। কোনো কোম্পানির নামে মামলা দেয়া তাদের কাজের ধরনের সাথে যায় না। কিন্তু থমাস টার্প বিলোতকে সমর্থন দিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ‘আমরা কোম্পানিগুলোকে ডিফেন্ড করি ঠিকই, কিন্তু সেটা করি তারা আইন মেনে চলছে-এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর। আর, এসব কাজ আমাদেরকে সময়ের সাথে সাথে আরো ভালো আইনজীবী করে তুলেছে বলেই আমার বিশ্বাস।’
৪
সরাসরি মামলা দেয়ার আগে ব্যাপারটা একটু বুঝে দেখা দরকার। সেজন্য ল্যারি উইন্টার নামে এক আইনজীবীর সাহায্য চাইলেন বিলোত। থমাস এন্ড ব্যাটল নামে এক ফার্মে কাজ করতেন উইন্টার। এই ফার্ম দীর্ঘদিন ধরে ডুপন্টের প্রতিনিধিত্ব করছে। বিলোত যখন উইন্টারের সাহায্য চান, ততদিনে ওই ফার্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুরু করেছিলেন নিজস্ব ল’ফার্ম। কিন্তু তারপরেও বিলোতের কথা শুনে অবাক হন উইন্টার। তাকে বাধা দিতেও চেষ্টা করেন। লাভ হয়নি। বিলোত ততদিনে মনস্থির করে ফেলেছেন।
১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে ডুপন্টের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টে ফেডারেল স্যুট দায়ের করলেন বিলোত। এর জবাবে ডুপন্টের হয়ে আইনজীবী বার্নার্ড রাইলি তাকে জানালেন, ছয় সদস্যের এক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এতে ডুপন্টের পক্ষ থেকে তিনজন ও এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির (Environmental Protection Agency – E.P.A) পক্ষ থেকে তিনজন পশু-ডাক্তার থাকবেন। কিছুদিন পরে তারা রিপোর্ট দিলেন। সেখানে বলা হলো, ‘বাজে খাবার, অযত্ন এবং ঠিকভাবে মাছি নিয়ন্ত্রণ না করায় পশুগুলোর এরকম অবস্থা হয়েছে’ (Poor nutrition, inadequate veterinary care and lack of fly control)। অর্থাৎ, পশুগুলো মরার পেছনে ট্যানেন্টরাই দায়ী। তারা জানে না, খামার কীভাবে চালাতে হয়।
উইলবার ট্যানেন্ট এ কথা শুনে ক্ষেপে গিয়েছিল। কিন্তু বিলোতের এর বেশি কিছু তো করার নেই। অন্যান্য ক্লায়েন্টের জন্য যা যা করে, এক্ষেত্রেও সে তা-ই করেছে। অনুমতি চেয়েছে এই জমির বিভিন্ন কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখার, তদন্ত কমিটি গঠনের এবং এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র যেন তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তাও নিশ্চিত করেছে। কাগজ এসেছে ট্রাক ভরে। ট্যাফটের পুরো একটা স্টোররুম ভরে গেছে সেই কাগজে। এরমধ্য থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজা একই কথা। তা-ই করেছে বিলোত, যথাসম্ভব খুঁজে দেখেছে। কিন্তু পাওয়া যায়নি কিছুই। এদিকে, এগিয়ে আসলে এই ফেডারেল স্যুটের ট্রায়ালের দিন।
অবশেষে, বেশ কয়েকদিনের টানা পরিশ্রমের পর ‘সুঁচ’ পাওয়া গেল। ইপিএর কাছে পাঠানো ডুপন্টের এক চিঠিতে PFOA নামে কিছু একটার কথা উল্লেখ আছে। এতদিনের কর্মজীবনে এই নাম কখনো শোনেনি বিলোত। সরকারিভাবে অনুমোদিত এবং নিষিদ্ধ রাসায়নিকের তালিকাতেও নেই এই নাম। নেই ট্যাফটের নিজস্ব রাসায়নিকের তালিকাতেও।
এক অভিজ্ঞ রাসায়নবিদের কাছে পরামর্শ চাইতে গেল বিলোত। জানা গেল, ভদ্রলোক নিজেও এর নাম শোনেননি। তবে কাছাকাছি একটা নাম শুনেছেন, PFOS। সাবানের মতো এক ধরনের জিনিস এটা। 3M নামের এক বিখ্যাত কোম্পানি তাদের ‘স্কচগার্ড’-এ এটা ব্যবহার করে। দামী কার্পেট বা অন্যান্য ঘরোয়া আসবাবপত্রের গায়ে স্কচগার্ডের প্রলেপ দেয় তারা। এটি পানি ও দাগ নিরোধক হিসেবে কাজ করে।
এতক্ষণে একটা ছেঁড়া সুতার যেন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। ডুপন্টের কাছে PFOA সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র চাইলেন বিলোত। তার প্রস্তাব নাকচ করে দিল ওরা। ২০০০ সালে সেসব কাগজপত্র হাতে পাওয়ার জন্য কোর্ট অর্ডারের আবেদন করলেন বিলোত। অনেক চেষ্টা করেও সেটা থামাতে পারেনি ডুপন্ট। বিলোতের আবেদন গৃহীত হলো। ফলস্বরূপ আরেক ট্রাকভর্তি কার্টন এসে পৌঁছাল ট্যাফটের অফিসে। প্রায় ১১০,০০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট। এর মধ্যে ছিল ডুপন্টের কনফিডেনশিয়াল প্রাইভেট রিপোর্ট, মেডিক্যাল ও হেলথ রিপোর্ট এবং কনফিডেনশিয়াল বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার খবর। ডুপন্টে কর্মরত বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাগুলো করেছিলেন। ততদিনে বিলোত PFOA নামের রহস্য ভেদ করেছেন। পারফ্লুওরো অক্টানোয়িক এসিড (Perfluoroooctanoic acid)।
পরবর্তী কয়েকমাস লেগে গেল সব কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখতে এবং এদেরকে ক্রমান্বয়ে সাজাতে। এ সময় তার বাসায় যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যেত। অফিসের ফোনে কল ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন বিলোত। তার নিজের ভাষ্যমতে-
‘এতদিনে আমি গল্পটা দেখতে শুরু করেছি। সম্ভবত আমিই প্রথমবারের মতো এই সব কাগজ ঘেঁটে দেখেছি। জেনেছি, ওরা দীর্ঘদিন ধরেই জানত, খারাপ কিছু ঘটছে। সব দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।’
বিলোত আসলে কমিয়ে বলেছিলেন। ‘খারাপ’ এবং ‘হতভম্ব’ শব্দ দুটো এই ঘটনার ব্যাখ্যায় যথেষ্ট না। আর, এর সব প্রমাণ ওরা পাঠিয়ে দিয়েছিল বিলোতের কাছে। বিলোতের মতে, ওদের নিজেদেরও বোধ হয় ধারণা ছিল না, ওরা কী পাঠিয়েছে। অবিশ্বাস্য এবং ভয়ংকর নির্মমতা ঘটিয়ে বসেছিল ডুপন্ট। আর, এর শুরুটা হয়েছিল আরো ৫০ বছর আগে।
(২ পর্বে সমাপ্ত ঘটনার বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন এখানে)